কৃষিবিদ জুয়েল রানা
কোভিড-১৯ নামক এক ভয়াবহ ভাইরাসে সৃষ্ট মহামারীতে আজ দেশে দেশে মানুষের অস্তিত্বের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, এক অচেনা পৃথিবী মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে। করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি নিয়ে যখন সবাই শংকিত তখন বাংলাদেশের সামনে হাজির হতে যাচ্ছে বন্যা, ডেঙ্গু। কর্মসংস্থান হারিয়ে হাজারো মানুষ দিশেহারা। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানভেদে লকডাউন করা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরিধানসহ অন্যান্য সকল স্বাস্থ্য সতর্কতা অবলম্বনে ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এই ভাইরাস দিনকে দিন প্রাণঘাতী হয়েই চলেছে। জীবনকে যাপনের ব্যক্তিগত, সামাজিক যে নিয়ম-পদ্ধতিতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম, সব আজ ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যে ১০ লাখের উপর মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। প্রচুর ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যুতে হসপিটালগুলোতে আতংক বিরাজ করছে, অনেক ক্ষেত্রে মিলছে না কাংখীত স্বাস্থ্যসেবা। গতবছরের অভিজ্ঞতা বলছে, যে কোন সময় ডেঙ্গুর আউটব্রেক শুরু হতে পারে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে এক নতুন যুদ্ধের ময়দানে আমরা অবতীর্ণ হয়েছি। এ যুদ্ধ অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে টিকে থাকার, এ যুদ্ধ সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে ঘুরে দাড়াবার। এই যুদ্ধে যুদ্ধসরঞ্জামে সজ্জিত সৈন্য নয়, দরকার দেশপ্রেমিক ডাক্তার, স্বাস্থকর্মী,খাদ্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মী-বিজ্ঞানী, গবেষক ও সচেতন নাগরিক। আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি যে আমাদের প্রকৃত হুমকি আজ শত মেইল দূরের সীমান্তে নয় বরং নিজস্ব গন্ডির ভিতরে যেখানে নিঃশ্বাস নিই,সেই বাতাস; প্রিয়জনদের সেই হাত যা স্পর্শ করি প্রতিনিয়ত। আজ আবারো দেশপ্রেমে বলীয়ান হবার সুযোগ এসেছে। স্বাধীনতার পর আরো একবার অদৃশ্য শত্রু জনজীবনে আতংক ছড়াচ্ছে। ১৯৭১ সালে আমাদের আধুনিক অস্ত্র ছিলোনা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছিলো না তারপর ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা তাদেরই উত্তরসূরী-এই সত্য মনে রাখতে হবে।
এই সংকটকালে দেশপ্রেমকে প্রমোশনাল ইন্সট্রুমেন্ট হিসাবে ব্যবহারের সময় এসেছে। রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভর করে জনগণের সহযোগিতার উপর। দেশপ্রেম এই সহযোগিতার মনোভাব তৈরিতে নাগরিকদের শুধু মোটিভেটই করেনা পাশাপাশি যে কোন ত্যাগ স্বীকারের তাকে উদ্বুদ্ধ করে। ফ্রান্স, ইটালী সহ বেশ কিছু দেশ ইকোনমিক প্যাট্রিওটিজম বা অর্থনৈতিক দেশপ্রেমকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশের কৃষকদের কাছে থেকে পণ্য ক্রয়ে নাগরিকদের আহবান জানিয়েছে। এতে করে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্যের পাশাপাশি দেশীয় পণ্যের কনজাম্পশন বেড়েছে যা অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনছে।
কোভিড-১৯ আতংকে অনেক সময় ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছেনা –এমনটিও আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। কিউবার মত জটিল ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের দেশে অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তারবৃন্দ করোনার সময় ফিরে এসেছেন। চিকিৎসা সেবা দিতে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। এমনকি বিভিন্ন দেশে কিউবা ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী প্রেরণ করেছে করোনা চিকিৎসার জন্য। ফিদেল ক্যাস্ত্রো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করেছিলেন যার মাধ্যমে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌছে দিতে পেরেছেন।
দেশপ্রেম সেই ধারণা যার মাধ্যমে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, দেশপ্রেম সেই আবেগ-অনুভূতির তাড়না যার মাধ্যমে দেশের জন্য সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজটি করতেও মানুষ দ্বিধা করি না। কাজের মাঝেই দেশপ্রেমের প্রকাশ। প্রকৃত দেশপ্রেমিক তারাই যারা নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাদের নিরাপদ রাখতে সামনে এগিয়ে এসেছেন। দেশপ্রেমকে বর্তমান সংকটের সাথে সম্পৃক্ত করার দাবী রাখে বৈকি। মাস্ক পরিধান করা নাগরিক আজ দেশপ্রেমিকের প্রতীক। মাস্ক পরিধানের অর্থ শুধু আপনি নিজের বা পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল তা নয় বরং সমাজ, দেশের প্রতিও সমান দায়িত্বশীল।
কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা কৃষকের মুখটিই আজ দেশপ্রেমিকের সবচেয়ে চেনা অবয়ব। অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে রাতদিন কাজ করা মানুষজনই আজ আমাদের নায়ক। চীনাদের দেশপ্রেমের কারণেই আজ তারা করোনা যুদ্ধে সফলতার সাথে টিকে আছে। ভিয়েতনাম চীন সীমান্ত সংলগ্ন একটি উন্নয়নশীল দেশ। করোনা আক্রমণের একেবারে শুরুতেই দেশটি দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং নিজ বাসায় অবস্থান, হাত ধোয়াকে দেশপ্রেম প্রদর্শনের প্রতীক হিসাবে প্রোপাগান্ডা চালায় যা খুব আশাব্যাঞ্জক ফলাফল এনে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পৃথিবীকে স্থায়ীভাবে বদলে দিবে। তাই, দেশপ্রেমকেও নতুন করে অনুধাবন ও সংগায়িত করা সমীচীন। জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মীবৃন্দই আজ দেশপ্রেম প্রদর্শনে সর্বাগ্রে।
যে কোন ক্রাইসিস যেমন আতংক ছড়ায় তেমনি ইতিবাচক ভাবনার দুয়ার ও উন্মোচন করে। জাতীয় সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর পারফরম্যান্স নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিকতায় ভরা সমন্বয়হীন,মাথাভারী কেন্দ্রীভূত পদ্ধতি পরিবর্তন সময়ের দাবী। নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে করোনা পরবর্তী সময়ে জন-আকাংখা পুরণে সক্ষম প্রতিষ্ঠান চাই আমাদের। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, …”সরকারি কর্মচারীদের বলি…মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ, বৃটিশ কলোনী নয়। পাকিস্থানের কলোনী নয়। যে লোককে দেখবে, তাঁর চেহারা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মত। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তোমারা মাইনে পাও……।” বিদ্যমান আমলাতন্ত্রের উপর বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিলো না, তিনি রাজনৈতিক কর্তৃত্বাধীন জন-অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি বারবার সিস্টেম পরিবর্তনের কথা বলেছেন। সেই কাজেও তিনি হাত দিয়েছিলেন।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিতরে বৈষম্য আর অসন্তোষ সৃষ্টি করে মানুষের জন্য যারা সত্যিকার অর্থে কাজ করতে চায় তাদের ডিমোটিভেট রাখার নেপথ্যের যে সিস্টেম দায়ী তাকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। বড় দেরি করে হলেও জাতির পিতা দর্শন বাস্তবায়ন দেশের জন্য অপরিহার্য। ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারী মহান জাতীয় সংসদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ”দ্বিতীয় বিপ্লব” কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কিছু বিষয় আলোকপাত করে ভাষণে বলেছিলেন, “ এখন এক নতুন জীবন সৃষ্টি করতে হবে। উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। মানুষকে মোবিলাইজ করতে হবে……।”
এই বিপর্যয়ের সময়ে দেশপ্রেমই পারে নতুন উদ্দীপনায় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সংকট মোকাবেলায় শক্তি ও সাহস যোগাতে।
লেখক: আইপিএম স্পেশালিষ্ট, পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঢাকা। ইমেইলঃ jewellbau@yahoo.com