খাবারের চাহিদা পূরণে মাটির পাশাপাশি চাষাবাদের মতো করে পানিতেও চাষাবাদ হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না নোনা পানিও। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চাহিদা কম থাকলেও বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এমন অনেক অপ্রচলিত খাবার উৎপাদন ও প্রচলনে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)।
বিএফআরআই এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, মাছের পাশাপাশি জলজ সম্পদ নিয়েও আমরা কাজ করছি। এখন স্বাদু পানির পাশাপাশি সুবিশাল ব্লু ইকোনমি নিয়েও কাজ করছি। বর্তমানে দেশে কম প্রচলিত কিন্তু বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে এ রকম খাদ্য উপকরণ নিয়েও কাজ করছি। মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি বিভিন্ন ‘সি-উইডস’ তথা সমুদ্র-শৈবাল, কুচিয়া, কাঁকড়া, ঝিনুক-শামুক এবং কচ্ছপের বাণিজ্যিক চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা চলছে।
‘সি-উইডস’ বা সামুদ্রিক আগাছা:
স্বাদ, গুণ ও পুষ্টিমানে ভরপুর এ খাদ্য পৃথিবীর অনেক দেশে ব্যাপক পরিচিত হলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে বাংলাদেশে নেই এর পরিচিতি ও প্রচারণা।
পুষ্টিবিদদের মতে, এই ‘সি-উইডস’ সংযোজন যে কোনো ধরনের খাবারকে সুস্বাদু তো বটেই-এর পুষ্টিগুণও বাড়িয়ে দিতে পারে অনেক। অজ্ঞতাই যে এই নির্লিপ্ততার কারণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সমুদ্রসীমা জয় করা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে ‘সি-উইডস’ তথা সমুদ্র শৈবাল। শুধু খাদ্য তালিকায় নয়, প্রসাধনী ও ডেকোরেশন- এই তিন আঙ্গিকে এর ব্যবহার বহির্বিশ্বে বেশ মর্যাদার বলে বিবেচিত। ‘সি-উইডস’ পণ্য মিয়ানমারের অন্যতম একটি রফতানি পণ্য। অথচ বাংলাদেশের জলসীমার ‘সি-উইডস’ মানের দিক দিয়ে বিশ্বের এক নম্বরে।
কুঁচিয়া:
সাপের মতো দেখতে হলেও কুঁচিয়া এক প্রকার মাছ। ইহা বাংলাদেশে কুইচ্চা, কুঁইচা, কুঁচে, কুঁচো ইত্যাদি নামে পরিচিত। বাংলাদেশের হাওর, বাওড়, খাল-বিল, পচা পুকুর, ধানক্ষেতে এবং বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে কুঁচিয়া মাছ দেখতে পাওয়া যায়। কুঁচিয়া মাছের শরীর লম্বা বেলনাকৃতির। আপাতদৃষ্টিতে কুঁচিয়া মাছকে আঁশবিহীন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ইহার গায়ে ক্ষুদ্রাকৃতির আঁশ বিদ্যমান যার বেশিরভাগ অংশই চামড়ার নিচে সজ্জিত থাকে।
খাদ্য হিসেবে কিছু কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কুঁচিয়াকে অস্পৃশ্য মনে করে। যদিও ইহা শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অ্যাজমা রোগ, ডায়াবেটিস, বাতজ্বর, পাইলসসহ অনেক রোগ সারাতে মহৌষধের মতো কাজ করে। তাছাড়া পরিবেশের খাদ্য জালে কুঁচিয়ার অনন্য অবদান রয়েছে। ধান ক্ষেতের ফসল অনিষ্টকারী পোকার লার্ভা, শামুক, কৃমি ইত্যাদি খেয়ে কুঁচিয়া কৃষকের উপকারী বন্ধু হিসেবে কাজ করে। অনেক পচা-গলা জৈবপদার্থ খেয়ে পরিবেশে মানবসমাজের বিশেষ বন্ধু হিসেবে ভূমিকা রাখে।
ঝিনুক ও শামুক:
বিদেশ ও দেশীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় ‘বাংলাদেশে ঝিনুক ও শামুক সংরক্ষণ, পোনা উৎপাদন এবং চাষ প্রকল্প’ শুরু হয়েছে। ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ, কক্সবাজার, চাঁদপুর, বগুড়া, যশোর ও বাগেরহাটে গবেষণা চলছে।
অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঝিনুক ও শামুকের পোনা উৎপাদন ও চাষ প্রযুক্তির উদ্ভাবন, বাংলাদেশে ঝিনুক ও শামুকের পপুলেশন ডিনামিক্স এর ওপর বেইজ-লাইন তৈরি, ঝিনুক ও শামুক সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা তৈরি এবং প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাদু পানি ও লোনাপানিতে ১৬ প্রজাতির ঝিনুক পাওয়া যায়। ঝিনুকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হলো মুক্তা তৈরি। ঝিনুকের খোলস থেকে চুন তৈরি এবং ঝিনুকের মাসল অংশ হাঁস-মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের অনেক দেশে ঝিনুকের মাংসল অংশ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে সাধারণত আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা ঝিনুকের মাংসল অংশ খেয়ে থাকে। সামুদ্রিক ঝিনুক (ওয়েস্টার) একটি দামি সীফুড হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং অনেক দেশে এর ওপর ভিত্তি করে খামার গড়ে উঠেছে।
১৯৯০ এর দশকে ভারতে সামুদ্রিক ঝিনুকের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। মানুষ ও জলজ পরিবেশ উভয়ের জন্য ঝিনুক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলাশয় থেকে শৈবাল, জৈব পদার্থ এবং দ্রবীভূত ক্ষতিকারক উপাদান যেমন- ভারী ধাতু দূরীকরণে ঝিনুকের ভূমিকা রয়েছে। এইভাবে ঝিনুক প্রাকৃতিক পানি পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। জলজ খাদ্য শৃঙ্খলের ক্ষেত্রে ঝিনুক একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং এরা জলজ খাদ্য শিকলের বিভিন্ন লেভের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে ঝিনুক চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
অপরদিকে, দেশের বিভিন্ন জলরাশি যেমন পুকুর, খাল, বিল, হাওর ও বাওরে প্রায় ৪৫০ প্রজাতির শামুক পাওয়া যায়। এ মধ্যে Pila globosa (আপেল শামুক) ও Viviparus bengalensis (পন্ড স্নেইল) ব্যাপক মাত্রায় পাওয়া যায়।
শামুকের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ শামুকের মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত কিছু আদিবাসী ভিন্ন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শামুকের মাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণে অভ্যস্ত নয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গলদা চিংড়ির খাদ্য হিসেবে দিনে প্রায় গড়ে ৬৬.৫ কেজি/হেক্টর শামুকের মাংস ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলোয় বসবাসরত উপজাতী জনগোষ্ঠিরা ক্ষুদ্র পরিসরে শামুকের চাষ করছে।
কাঁকড়া:
দেশে আশির দশক থেকে রফতানি পণ্য হিসেবে চাষাবাদ করা হচ্ছে। উপকূলের ৪৮০ কিলোমিটার এলাকায় লোনাপানিতে ১২ প্রজাতির কাঁকড়া দেখতে পাওয়া গেলেও শিলা কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবন এলাকা থেকে বর্তমানে প্রতিবছর ৩৭৫ টন কাঁকড়া রফতানি হয়ে থাকে। এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদে ৩-৪ মাসের মধ্যেই বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে।
কচ্ছপ:
মানুষের খাদ্য হিসেবে কচ্ছপের ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকায় অতিরিক্ত আহরণ ও পরিবেশের বিপর্যয়ের দরুন বাংলাদেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন।
দেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। তবে এদের মধ্যে ১১টি প্রজাতি মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় যার ৪টি বিদেশে রফতানি করা যায়। বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- রুফড টার্টল বা মাজহারি কাইট্টা, স্পটেড ফ্ল্যাপ-শেল টার্টল বা শুনধি কাসিম, পিক্ক সফ্ট শেল টার্টল বা ধুম কাসিম এবং এশিয়াটিক সফ্ট শেল টার্টল বা সিম কাসিম।
দেশে কচ্ছপ চাষের কলাকৌশল উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা এখনও তেমন পরিচালিত হয়নি। ফলে কচ্ছপের বাণিজ্যক উৎপাদন এবং মুনাফা সম্পর্কিত তথ্যাদি অত্যন্ত অপ্রতুল। উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নরম খোলসধারী কচ্ছপ চাষকালে বছরে এদের দেহের ওজন ৫০০-৬০০ গ্রাম হয়ে থাকে।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কচ্ছপ চাষ অনেকাংশে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত বাচ্চা ও সম্পূরক খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই এ চাষ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কচ্ছপের কৃত্রিম প্রজনন, ব্যাপক পোনা উৎপাদন ও সম্পূরক খাদ্য তৈরির কৌশল বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক পরিবেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নিমিত্ত জাতীয় পর্যায়ে টাস্ক ফোর্স গঠন বা এ জাতীয় অন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
সুত্রঃ বারতা২৪