অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন চালকল মালিক ও আড়তদাররাঅস্বাভাবিক মুনাফা করছেন চালকল মালিক ও আড়তদাররা

নিউজ ডেস্কঃ
বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধানের সরকার নির্ধারিত দাম ছিল ২৬ টাকা। সেই ধান কৃষকের কাছ থেকে চালকল মালিক ও ফড়িয়ারা কিনছেন ১৫ টাকারও কম দামে। প্রতি মণ ধান কিনতে তাদের ব্যয় হচ্ছে ৬০০ টাকারও কম। প্রতি মণ ধান থেকে তৈরি হয় ২৭ কেজি চাল, যা সরকারের কাছে হাজার টাকায় বিক্রি করছেন তারা। সে হিসেবে প্রতি মণ ধানে ৪০০ টাকা অর্থাৎ অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন চালকল মালিক ও আড়তদাররা।

২০১৯ সালের বোরো মৌসুমে ধান-চালের দাম, উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহ পদ্ধতির ওপর একটি গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই)। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই মৌসুমে চালকল মালিকরা কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি ধান ১৪ টাকা ৯৭ পয়সা দামে কিনেছেন, যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় ১১ টাকা কম। আবার সেই ধান প্রক্রিয়াজাত করে ন্যূনতম ৩৬ টাকায় বিক্রি করেছেন তারা।

শুধু মিলার নয়, ট্রেডার্স বিশেষ করে ফড়িয়া, ব্যাপারী, আড়তদাররাও ধান সংগ্রহকালে কৃষকদের দামে ঠকিয়েছেন। কৃষকের কাছ থেকে তারা ধান কিনেছেন প্রতি কেজি ১৫ টাকা ২৬ পয়সায়। বাজারের প্রায় ৯২ শতাংশ ধান ট্রেডার্সরাই কিনে থাকেন। ফলে এ শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের কাছেই সবচেয়ে বেশি ঠকেছেন কৃষক।

মিলার ও ট্রেডার্সদের অতিমুনাফার প্রবণতা থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে হলে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম সম্পূর্ণ সরকারিভাবে পরিচালিত করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকার কৃষকের সব ধান কিনে নিলে গত বোরো মৌসুমে ধানের বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। এতে কৃষকরা আরো লাভবান হতে পারতেন। এমনকি ধানের দাম সরকার নির্ধারিত ২৬ টাকার নিচে হলেও প্রকৃত বাজারমূল্য উন্নত হতে পারত এতে।

আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আখতার আহমেদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি ধান ১২-১৬ টাকায় কেনা মোটেও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত নয়। নগদ অর্থের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে মৌসুমের শুরুতেই কম দামে ধান বিক্রি করেন কৃষক। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন মিলার ও ফড়িয়ারা। মিলারদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বাজার থেকে সবচেয়ে কম দামে ধান কিনতে পারা, বিশেষ করে হাইব্রিড ধান। বাজারে এ ধানটির কোনো ক্রেতা থাকে না বলে মিলাররা অনেক ক্ষেত্রে ১২ টাকার নিচে ধানটি কিনতে পারেন। পরবর্তী সময়ে এ ধান প্রক্রিয়াজাত করে ৩৬ টাকায় সরকারের কাছে বিক্রি করেন তারা, যা থেকে তাদের অস্বাভাবিক মুনাফা হয়।

কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ধান কেনায় আর্দ্রতা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। সে প্রতিবন্ধকতা মেটাতে হলে আর্দ্রতা অনুসারে দাম নির্ধারণ করে কৃষকের কাছ থেকেই কিনতে হবে। আর্দ্র ধান শুকানোর কাজে চার্জের বিনিময়ে মিলারদের যুক্ত করতে হবে। সেটি করা গেলে কৃষকরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি মিলাররাও ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবেন। সরকারের ক্রয়প্রক্রিয়ায়ও দক্ষতা আসবে এতে।

মিলার ও ট্রেডার্সদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা। কেননা বোরো চাষে যুক্ত কৃষকের প্রায় ৪৭ শতাংশই ক্ষুদ্র কৃষক। এসব কৃষকের জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৪৯ একর। অন্যান্য শ্রেণীর কৃষকের তুলনায় তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন গত বোরো মৌসুমে। এ শ্রেণীর কৃষকরা ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে তাদের মোট বোরো ধানের প্রায় অর্ধেক বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে এ সময়ে ধানের দাম কম থাকায় ন্যায্যমূল্য পাননি তারা।

শুধু ক্ষুদ্র কৃষক নয়, দাদন নিয়ে ধান চাষ করেছেন এমন অন্য শ্রেণীর কৃষকরা দাম কম পেয়ে ক্ষতির শিকার হন। বোরো আবাদে যুক্ত কৃষকের ৩৩ শতাংশই বর্গাচাষী ও দাদন নিয়ে আবাদকারী কৃষক। জমির মালিকদের দ্রুত নগদ অর্থ পরিশোধের তাড়া থাকে তাদের। বর্গা বা ভাগচাষীর সংখ্যা মোট কৃষকের প্রায় ২৬ শতাংশ। এ শ্রেণীর কৃষককেও জমির ভাড়া বাবদ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এজন্য তারাও কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন।

ক্ষুদ্র ও বর্গাচাষীদের লোকসান কমাতে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হলেও সে কার্যক্রমে সরকারের অংশগ্রহণ খুবই কম। ২০১৯ সালের ক্রয় মৌসুমে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করেছেন মাত্র ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কৃষক। এ সময় মোট ধান সংগ্রহ করা হয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬২ টন, যা ২০১৯ বোরো সংগ্রহ মৌসুমে মোট বোরো ধান উৎপাদনের মাত্র ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের উত্থানের কারণেই ধানের দামে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। সেজন্য বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া সরকারের ধান সংগ্রহ বৃদ্ধি করতে হলে মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতেই কৃষকরা যাতে ধান মজুদ বা সংরক্ষণ করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করতে হবে। সে সঙ্গে বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকা বিপণন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করার ওপরও জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও চলতি মৌসুমের বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। প্রায় ২০ লাখ টনের বেশি সংগ্রহ লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় সময়সীমা আরো ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের সংগ্রহ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্যই হলো কৃষকের দাম নিশ্চিত করা এবং সরকারের খাদ্য মজুদ শক্তিশালী অবস্থানে রাখা। আর সরকারের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালিত হয় বোরো মৌসুমে। চলতি বোরো মৌসুমে বাজারে ভালো দাম পাওয়ার কারণে বাজারে তারা বিক্রি করছে। নিজেদের মজুদ রেখে কিছু অংশ সরকারের কাছে বিক্রি করছে। কৃষকরা ন্যায্যমূল্যে যাতে মিলার ও ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেন, এজন্য সরকারি সংগ্রহ মূল্য মৌসুমের বেশ আগেই জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর সুফল এবারের মৌসুমে পাওয়া গেছে। আমরা কৃষকের সর্বোচ্চ ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখব।

সুত্রঃ বনিক বার্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *