কৃষিবিদ জুয়েল রানা
বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর আঘাতে দেশে দেশে অর্থনীতিতে যখন টালমাটাল পরিস্থিতি তখন সবার নজর এখন খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার উপর। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ভবিষ্যৎ এখন অনেকাংশে নির্ভর করছে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী সফলতার উপর। সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মিঃ নরম্যান বরল্যগ বলেছিলেন, “You can not build a peaceful world on empty stomach and human misery.” উক্তিটির যথার্থতা হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করার সময় বুঝি এসেছে!
খাদ্য উৎপাদনের দৃষ্টিভংগিতে নয় আমরা যদি পেশা হিসাবে কৃষিকে দেখি তাহলে বলা যায় কৃষি একটি বিপদগ্রস্ত পেশা কারণ এদেশে প্রান্তিক কৃষকই সংখ্যাগুরু।
খুব কম মানুষ খঁজে পাওয়া যাবে যারা পেশা হিসাবে কৃষিকে বেছে নিতে চান।কৃষি একটি থ্যাংকলেস,ঝঁকিপুর্ণ, শ্রমঘন গ্রামীণ কার্যক্রম। বর্তমান তরুন প্রজন্ম তার পূর্বপুরুষের পেশাকে অনুসরণ করতে চায়না। প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদাসম্পন্ন এবং কম আয়সম্পন্ন বৃত্তি গ্রহণ করলেও কালেভদ্রে শিক্ষিত তরুণদের কৃষক হতে দেখা যায়। সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে,তাহলে বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ কেমন হবে?
করোনা কালীল অথবা করোনা পরবর্তী কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাই বা কেমন হবে? জলবায়ুগত পরিবর্তন ও বর্ধিত জনসংখ্যা বিপরীতে খাদ্য চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রথাগত কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে আধুনিক ডিজিটাল কৃষি উৎপাদন ও বিপনন ব্যবস্থার আভাস ইতোমধ্যে আমরা প্রতক্ষ্য করছি পাশাপাশি এর সুফল ও এখন দৃশ্যমান। কৃষি মন্ত্রণালয় গত ২৩ মে ২০২০ “ফুড ফর নেশন” নামে একটি অনলাইন প্লাটফর্ম চালু করেছে।এর মাধ্যমে কৃষক /উদ্যোক্তারা তাদের কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য সম্পর্কে জানতে পারবে এবং এখান থেকে ভোক্তা/উদ্যোক্তা সরাসরি নির্দিষ্ট পণ্য ক্রয় করতে পারবে।মোবাইলে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির মাধ্যমে এই প্লাটফরমে একসেস করা যাচ্ছে।করোনাকালীন কৃষিপণ্যের অপচয় রোধ করে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে এটি একটি চমৎকার আইডিয়া
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ চীন, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পেরেছে। নতুন নতুন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে আমরাও ভবিষ্যতের কৃষিকে বদলে দিতে পারি। যেহেতু কোভিড ১৯ একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে তাই ডিজিটাল স্মার্ট কৃষি প্রবর্তন নিয়ে এখনই প্রস্তুতি নেবার সময়।
আমাদের জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮ একটি যুগোপযোগী কৃষিনীতি। সরকারের ভিশন কতটা সুদূরপ্রসারী তা জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮ এর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই প্রতীয়মান হয়। কৃষিনীতির তৃতীয় অনুচ্ছেদে প্রিসিশন কৃষি প্রবর্তনের পাশাপাশি ন্যানোটেকনোলজির মত প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও জিয়াইএস টেকনোলজি ব্যবহার করে ক্রপ জোনিং, রিমোট সেনসিং ব্যবহার করে মৃত্তিকার তথ্য-উপাত্ত, জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি ও আর্থ-সামাজিক ডাটা সংগ্রহ করার কথাও বলা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন করে ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার (সিএসএ) প্রবর্তনের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। বৈশ্বিক বাস্তবতা এবং দক্ষিণ এশিয়া বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় জাতীয় কৃষিনীতিটি আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন বললে ভূল হবেনা। আমরা দেখতে চাই কিভাবে কৃষি ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে করোনাকালীন শ্রমিক সংকট কাটিয়ে অতি দ্রুততম সময়ে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা সর্বোপরি খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে টেকসই রুপ দিতে পারে।
প্রিসিশন কৃষি হলো এমন একটি এপ্রোচ যার মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল ও মাটির স্বাস্থ্য বজায় রেখে সর্বোচ্চ ফলন পেতে ঠিক কি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান এবং সেচসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ তা নির্ণয় করে তারপর সেগুলো প্রয়োগ করা। অপ্রয়োজনীয় ব্যায় কমিয়ে কৃষিকে আরো টেকসই, লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব করাই এর উদ্দেশ্য। প্রিসিশন কৃষিকে স্যাটেলাইট কৃষি বা স্মার্ট কৃষি ও বলা হয়।
প্রিসিশন কৃষিতে ব্যাপকভাবে আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) ব্যবহৃত হয়।বলতে গেলে প্রিসিশন কৃষির মূল নিয়ামকই আইওটি। আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংস হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কিছু যন্ত্রপাতি মানুষের সহায়তা ছাড়াই যুক্ত হয়ে আন্তঃযোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ডাটা/তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারে। এক্ষেত্রে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার হয়ে থাকে। আইওটি ব্যবহার করে আবহাওয়া-জলবায়ুর তথ্য বিশ্লেষন করে মনিটরিং থেকে শুরু করে ফসলের চারা রোপণের সঠিক সময় নির্ধারণ,জমির আর্দ্রতা নিরুপণ করে সেচ প্রদান,পুষ্টি উপাদানের সঠিক পরিমান নির্ণয়পূর্বক সার প্রয়োগ এবং ফসল কর্তন পর্যন্ত অনেক কার্যক্রম মানুষের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই করা যায়। সিস্টেম ডেভেলপ করাতে পারলে ফিজিক্যালী জমিতে উপস্থিত না হয়েই উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যায়। কিছু উদাহরণ দিলে বিষয়গুলো আরো স্পষ্ট হবে।
ভারত,চীনসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়েছে। মোবাইল টেকনোলজি ও ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ব্যবহার করে কৃষক তার জমিতে না গিয়েও বাড়িতে বসে সেচ মেশিন চালু ও বন্ধ করতে পারে। পাশাপাশি জমিতে ময়েশ্চার সেনসর স্থাপন করে পানির পরিমান নির্ণয় করে সেই ডাটা বিশ্লেষন করে সেচ প্রদান করা যায়।এতে করে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির ব্যাপক অপচয় রোধ করা সম্ভব।
ফসলের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় রিমোট সেনসিং এবং অপ্টিক্যাল সেনসর বা ড্রোনের ব্যবহার বিভিন্ন দেশে দিনদিন বাড়ছে। চীনে শ্রমিক সংকট মেটাতে ব্যাপকভাবে ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। চীন কৃষিকদের করোনা ঝুকি কমিয়ে মহামারীর এই সময়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোকা-মাকড়,রোগ-বালাইয়ের আক্রমন মনিটরিং, ফসলের বৃদ্ধি,স্বাস্থ্যের নির্ভূল তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষনপূর্বক সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃষককে সক্ষম করে তোলা যায়।ড্রোন ব্যবহার করে জমিতে সার,কীটনাশক প্রয়োগের উদাহরন এখন প্রচুর। জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) টেকনোলজি ব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ থাইল্যান্ড। দেশটি কৃষি ম্যাপিং করে মৌসুম ভিত্তিক মৃত্তিকার উপযোগিতা নির্ণয় করে ফসল ফলাচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চল উপযোগী ফসল নির্ধারনে কৃষি ম্যাপিং উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। ভারত ও শ্রীলংকা স¤প্রতি জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়িয়েছে।
আমাদের দেশে বোরো মৌসুমে সেচ কাজে বিপুল পরিমাণ ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। বিশেজ্ঞরা ইতোমধ্যে ভারী ধাতু যেমন, আর্সেনিক, সীসা ইত্যাদির উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছেন।
পৃথিবীতে ন্যানোসায়েন্সের উদ্ভব হয় আশির দশকে। এর এক দশক পরই ১৯৯০ এ-র মাঝামাঝি সময়ে চীন এই প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে। ফলমূল,শাক-সব্জির সংরক্ষকাল বাড়ানো এবং খাদ্যের গুনাগুণ বৃদ্ধিতে তারা এ-ই টেকনোলজি ব্যবহার করছে। ন্যানোটেকনোলজির সাহায্যে শুধু ভারী ধাতুর দূষণ রোধ নয় বরং বিষাক্ত কীটনাশকের প্রভাব কমানো সম্ভব। কৃষিবর্জ্য রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে এবং সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে ন্যানোপার্টিক্যালস ভূমিকা রাখতা পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকা,আলজেরিয়া,নাইজেরিয়া ও মিশর নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ফসল ইমেজিং করছে।স্মার্ট কৃষির প্রবর্তনে এখন তারা স্পেসকেও ব্যবহার করছে। ইসরায়েল আরো আগে থেকেই তাদের কৃষিতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে।
পৃথিবীর একপ্রান্তে যখন স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভারবিহীন গাড়ি আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এক দৃশ্যমান বাস্তবতা তখন প্রযুক্তির ছোঁয়া কৃষিতেও লাগবে এটাই স্বাভাবিক। পলিসি ফর্মুলেশনেও অনেক দেশ এখন ইনোভেটিভ আইডিয়া বের করেছে। গত বছর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষনের সময় কৃষিতে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে তাদের কর্মকান্ড দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। থাইল্যান্ড জাতীয় পর্যায়ে একটি মডেল গ্রহণ করা হয়েছিলো “থাইল্যান্ড ৪” নামে। দেশটিকে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত করতে এই মডেলে কৃষিতে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক কার্যক্রম।
প্রথমদিকে একে অনেক উচ্চাভিলাসী লক্ষ্যমাত্রা বললেও পরবর্তীতে থাইল্যান্ড কৃষিতে এনেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। স্মার্ট কৃষির পাশাপাশি সমবায়ভিত্তিক কৃষির প্রবর্তন করে তারা কৃষিতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। চিংড়ী এবং পোল্ট্রি খামারগূলোতে দেখেছি আইওটি ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আর্দ্রতা,আলো নিয়ন্ত্রণ করছে।প্রাথমিকভাবে কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীন হলেও উদ্যোক্তারা যখন এ-র সুফল দেখতে পেলো তখন ব্যাপকভাবে স্মার্ট প্রযুক্তিগুলো গ্রহন করলো। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে প্রান্তিক কৃষি থেকে থাইল্যান্ড বাণিজ্যিক কৃষিতে রুপান্তরিত হলো। ৯০ ভাগ কৃষি পরিবার খামার যান্ত্রিকীকরণের আওতায় চলে এসেছে। সম্প্রতি তারা আইওটি ব্যবহার করছে, রোবটিক্স ব্যবহার শুরু করেছে।
দেশটির সবচেয়ে চমৎকার কর্মসূচীর নাম “ইয়াং স্মার্ট ফারমার(ওয়াইএসএফ)”। কর্মসূচীটি বাস্তবায়ন করছে দেশটির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তরুণদের আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সক্ষম করে গড়ে তোলা হচ্ছে যাতে লাভবান একজন কৃষি উদ্যোক্তা হিসাবে তৈরি হতে পারে। ওয়াইএসএফ দের বিদেশেও বিভিন্ন প্রশিক্ষণে প্রেরণ করা হয়। তাদের অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেয়ার করেন,সরকারি সকল দপ্তর থেকে এই তরুণদের সহযোগিতা দেওয়া হয়। সম্প্রতি থাইল্যান্ড সেনাবাহিনীর সাথে সম্প্রসারণ দপ্তরের কোলাবোরেশন হয়েছে এই মর্মে যে, সেনাসদস্যবৃন্দ এই কর্মসূচীর সাথে নিজেদের যুক্ত করবেন এবং পরবর্তীতে নিজেরা একেকজন উদ্যোক্তা হবেন। কৃষিতে এমন কর্মসূচী প্রশংসনীয়। কৃষিকে পেশা হিসাবে মর্যাদার আসনে আসীন করাটাও প্রয়োজন।
একদিকে অধিক জনসংখ্যার চাপ অন্যদিকে কৃষি জমির অকৃষি খাতে ব্যবহার বৃদ্ধি ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় চ্যালঞ্জ হয়ে দেখা দিবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা চলমান রয়েছে। তাই কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী একজন প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানীও বটে, নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর হাত ধরেই দেশের কৃষি বদলে যাবে। পরিবেশবান্ধব টেকসই আর সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে কৃষিই হবে আগামী দিনের অর্থনীতির ভিত।
লেখক: কৃষিবিদ জুয়েল রানা, আইপিএম স্পেশালিস্ট, বিসিএস (কৃষি), পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প, ডিএই,খামারবাড়ি, ঢাকা।
সুত্রঃ কৃষি প্রতিদিন।