নিউজ ডেস্কঃ
আমাদের দেশে আলু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। সাধারণত ধান ও গমের পরই আলুর স্থান। বর্তমান চাষের জমির পরিমাণ ও ফলনের হিসেবে ধানের পরই আলুর স্থান। একেক সময়ে একেক জমিতে সর্বাধিক উৎপাদনের কারণে দিন দিন আলু চাষে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ আলু চাষে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। জেনে নিন আলু উৎপাদনের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে।
মাটি নির্বাচন: যে কোনো মাটিতে আলু চাষ করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ থেকে দোআঁশ মাটি আলু চাষের জন্য উত্তম। উঁচু থেকে মাঝারি উচুঁ জমি যেখানে সেচ ও নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে সে সকল জমি নির্বাচন করতে হবে। জমিটি অবশ্যই রৌদ্র উজ্জ্বল হতে হবে। মাটিতে জো আসার পর আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে প্রস্তুত করতে হবে।
আড়াআড়িভাবে কমপক্ষে ৪টি চাষ দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জমিতে বড় মাটির ঢেলা না থাকে এবং মাটি ঝুরঝুরে অবস্থায় আসে। কারণ বড় মাটির ঢেলা আলুর সঠিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে এবং অনেক সময় অসম ও বিকৃত আকার তৈরি করে। জমি তৈরির সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে জমিতে সুষম সেচ প্রয়োগ করা যায়। সে জন্য জমির উপরিভাগ সমতল করতে হবে।
জাত পরিচিতি: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত আলুর মোট ৮৩টি জাত অবমুক্ত করেছে যার মধ্যে খাবার আলু, প্রক্রিয়াজাতকরণের উপযোগী আলু, রপ্তানিযোগ্য আলু, আগাম আলু ও সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় এমন আলুর জাত আছে। খাবার আলুর জন্য ডায়মন্ট, কার্ডিনাল (ফলন: ২৫-৩৫ টন, প্রতি হেক্টরে); আগাম জাত হিসেবে গ্রানোলা, বারি আলু-৭৪, ৭৫ (ফলন: ২০-৪০ টন, প্রতি হেক্টরে); রপ্তানি উপযোগী গ্রানোলা,
বারি আলু-৪৬ (ফলন: ২০-৩৫ টন, প্রতি হেক্টরে); প্রক্রিয়াজাতকরণ উপযোগী এসটেরিক্স, লেডি রোসেটা, কারেজ, মেরিডিয়ান (ফলন: ২০-৩৫ টন, প্রতি হেক্টরে); মড়ক রোগ প্রতিরোধী বারি আলু-৪৬, ৫৩, ৭৭, এ্যালোটি, ক্যারোলাস (ফলন: ৩০-৪০ টন, প্রতি হেক্টরে); দীর্ঘ সময় দেশীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা যায় আইলসা, প্রোভেন্টো, বারি আলু-৬২, ৭৬ (ফলন: ৩০-৪০টন, প্রতি হেক্টরে); তাপ সহিষ্ণু বা দেরিতে রোপণ উপযোগী বারি আলু-৭২ বা ৭৩ (ফলন: ২০-২৪টন, প্রতি হেক্টরে)।
বীজআলু শোধন: কোল্ড স্টোরেজ থেকে বীজআলু বের করার পর ৪৮ ঘণ্টা প্রি হিটিং কক্ষে রাখতে হবে। বীজআলু বাড়িতে আনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বস্তা খুলে ছড়িয়ে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য স্বাভাবিকভাবে বাতাস চলাচল করে এমন ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। কারণ বীজ কোল্ড স্টোরেজ থেকে বের করে বস্তা বন্ধ অবস্থায় রাখলে ঘেমে পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কোল্ড স্টোরেজে রাখার আগে বীজ শোধন না হয়ে থাকলে অঙ্কুর গজানোর আগে বীজআলু দাদ বা স্ক্যাব এবং বস্ন্যাক স্কার্ফ রোগ প্রতিরোধের জন্য ৩% বরিক এসিড দিয়ে শোধন করে নিতে হয়। এ জন্য ১ লিটার পানিতে ৩০ গ্রাম হারে বরিক এসিড মিশিয়ে বীজআলু ১০-১৫ মিনিট চুবিয়ে পরে ছায়ায় শুকাতে হবে। পলিথিন সিটের উপর আলু ছড়িয়ে স্প্রে করেও কাজটি করা যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন আলুর সব অংশ ভিজে যায়। সাধারণত বিঘা প্রতি অর্থাৎ ৩৩ শতকে ২শ থেকে ২শ ১০ কেজি বীজআলু প্রয়োজন হয়।
রোপণ পদ্ধতি: অঙ্কুর গজানোর পর ১ম কুঁড়িটি ভেঙে দিতে হবে। কারণ ১ম কুঁড়ি ভেঙে দেয়ার পর অন্যান্য কুঁড়ি সমানভাবে বৃদ্ধির সুযোগ পায়। ৩০-৪০ গ্রাম ওজনের আস্ত আলু বীজ হিসেবে ব্যবহার করা উত্তম। কেটেও বীজ লাগানো যেতে পারে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রতিটি কাটা অংশে কমপক্ষে ২টি চোখ বা কুঁড়ি থাকে। বীজ লাগানোর ২-৩ দিন আগে আলু কেটে ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিলে কাটা অংশের ওপর একটা প্রলেপ পড়ে। ফলে মাটি বাহিত রোগ জীবাণু সহজে বীজে প্রবেশ করতে পারে না।
অন্যভাবে ছাই মেখেও কাজটি করা যেতে পারে। এতে আলুর পচন অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। প্রতিটি আলু কাটার পর সাবান পানি দ্বারা ছুরি বা বটি পরিষ্কার করা উচিত যাতে রোগ জীবাণু এক বীজ থেকে অন্য বীজে না ছড়ায়। বীজআলু আড়াআড়িভাবে না কেটে লম্বালম্বিভাবে কাটতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫ কার্তিক থেকে ১৫ অগ্রহায়ণ অর্থাৎ নভেম্বর মাস আলু রোপণের উপযুক্ত সময়।
সার ব্যবস্থাপনা: দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটির উর্বরতা বিভিন্ন রকমের, এ জন্য সারের চাহিদা সকল জমির জন্য সমান নয়। স্থান ভেদে বিঘা (৩৩ শতক) প্রতি ইউরিয়া ৪৪-৪৮ কেজি, টিএসপি ২৭-৩০ কেজি, এমওপি ৩৩-৪০ কেজি, জিপসাম ১৩-১৬ কেজি, জিংক সালফেট ১ কেজি-১ কেজি ৩শ গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট (যে মাটিতে ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি আছে) ১৮-২০ কেজি, বোরন ৮শ গ্রাম-১ কেজি, গোবর ১২শ-১৩শ কেজি দিতে হবে।
গোবর ও জিংক সালফেট শেষ চাষের সময় জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক ইউরিয়া, সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও বোরন সার রোপণের সময় সারির দুই পাশে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ দ্বিতীয়বার মাটি তোলার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর সঙ্গে সঙ্গে সার ও বীজ মাটি দিয়ে ভেলি তুলে ঢেকে দিতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা : বীজ রোপণের পর জমিতে ভালো রস না থাকলে সেচ দেয়া উত্তম, তবে খেয়াল রাখতে হবে ক্ষেতে কোনোভাবেই পানি না দাঁড়ায়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পানিতে ভেলির ২/৩ অংশ পর্যন্ত পানিতে ডুবে যায়। ২-৩টি সেচ প্রয়োগ করা প্রয়োজন হতে পারে (২০-২৫ দিনের মধ্যে স্টোলন বের হওয়ার সময়, ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে গুটি বের হওয়া পর্যন্ত এবং পরে আলু বৃদ্ধির সময়)।
জমি থেকে আলু উঠানোর ৭-১০ দিন আগে মাটি ভেদে সেচ প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে, দাদ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আলু রোপণের পর ৩০-৫০ দিনের সময়ে জমিতে কোনো অবস্থায় রসের ঘাটতি এবং ৬০-৬৫ দিনের পর রসের আধিক্য হতে দেয়া যাবে না।
আলুর জমি সব সময় আগাছা মুক্ত রাখা উচিত। আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার করে দুই সারির মধ্যবর্তী স্থান কুপিয়ে উপরি সার প্রয়োগ করতে হবে। সার মিশ্রিত মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোপানোর সময় যাতে আলুর শিকড় বা স্টোলন না কাটে এবং মাটি দেয়ার সময় গাছের পাতা মাটি চাপা না পড়ে। ৫৫ থেকে ৬০ দিন পর প্রয়োজন হলে পুনরায় আগাছা পরিষ্কার করে মাটি তুলে দিতে হবে।
বীজআলুর জমিতে বিজাত বাছাই: মানসম্পন্ন বীজআলু উৎপাদনে রগিং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিকভাবে রগিং করা না হলে বীজআলুর গুণাগুণ কমে যায়। এ জন্য গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত নিয়মিত আলুর জমিতে বিভিন্ন জাতের মিশ্রিত গাছ, অস্বাভাবিক এবং রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে।
ভাইরাস রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আলু গাছ আলুসহ তুলে অন্যত্র মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। সকাল এবং বিকাল রগিংয়ের জন্য উপযুক্ত সময়। সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে রগিং করতে হবে যেন পাতায় সব লক্ষণ স্পষ্ট বুঝা যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন রোগাক্রান্ত গাছ কোনোক্রমেই কোনো সুস্থ গাছের সঙ্গে না লাগে এবং শ্রমিকের হাতের স্পর্শ দ্বারাও যেন সুস্থ গাছে রোগ সংক্রমণ না হয়।
হামপুলিং: হামপুলিং হলো গাছ টেনে উপড়ে ফেলা। হামপুলিংয়ের ৭-১০ দিন আগে থেকে সেচ বন্ধ করতে হবে। তবে বালি মাটি হলে ৫ থেকে ৭ দিন আগে সেচ বন্ধ করা ভালো। বেশি দিন আগে সেচ বন্ধ করলে বালি মাটির আলুতে হিট ইনজুরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হামপুলিং করার সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে গাছ খেত থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
যদি পর্যাপ্ত রস না থাকে তবে গাছ দ্বারা পিলি ঢেকে দিতে হবে। ফলে হিট ইনজুরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। ফসল তোলার পরে আলুর আকার ও ফলন দেখে হামপুলিংয়ের তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। হামপুলিংয়ের পর মাটি ও আলুর অবস্থার ওপর নির্ভর করে ৭-১০ দিন পর্যন্ত মাটির নিচে রেখে আলুর ত্বক শক্ত করতে হবে। আলুর ত্বক শক্ত হয়েছে কি না তা দেখার জন্য আলু তুলে বৃদ্ধাঙুলি দ্বারা আলুর ত্বকে চাপ দিতে হবে। চামড়া না উঠলে বুঝা যাবে কিউরিং হয়েছে। অথবা চটের বস্তায় ২ থেকে ৩ কেজি নমুনা আলু উঠিয়ে ঝাকুনি দিতে হবে। যদি চামড়া না উঠে তবে বুঝা যাবে কিউরিং হয়েছে।
সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা: শুষ্ক, উজ্জ্বল ও ভালো আবহাওয়াতে আলু উত্তোলন করতে হবে। এক সারির পর এক সারি কোদাল বা লাঙ্গল দিয়ে আলু উঠাতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আলু আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। আলু উঠানোর পর প্রখর রৌদ্রে রাখা যাবে না। মাঠে প্রাথমিক বাছাইয়ের মাধ্যমে কাটা, ফাটা, ক্ষতিগ্রস্ত, আংশিক পঁচা আলু বাতিল হিসেবে পৃথক করতে হবে- যেন ভালো আলুর গাদার সঙ্গে মিশ্রিত হতে না পারে। বস্তায় অথবা চট দ্বারা আবৃত ঝুড়িতে করে সতর্কতার সঙ্গে আলু অস্থায়ী শেডে আনতে হবে।
আলুর বস্তা বা ঝুড়ি আছড়িয়ে ফেলা যাবে না, কারণ তাতে আলুর চামড়া উঠে যেতে পারে বা থেতলে যেতে পারে। আলু উৎপাদন মাঠের কাছাকাছি ছায়াযুক্ত ঠান্ডা ও সহজে বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে অস্থায়ী শেড তৈরি করতে হবে। মাঠ থেকে কেবল মাত্র প্রাথমিক বাছাইকৃত আলু শেডের মেঝেতে বিছিয়ে রাখতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আলুর স্তূপ ৪৫ সেন্টিমিটারের বেশি উঁচু না হয়। এ অবস্থায় কমপক্ষে ৩-৫ দিন কিউরিং করতে হবে।
সংরক্ষণ করার জন্য আলু অবশ্যই ভালোভাবে বাছাই করা দরকার। বাছাই ভালো হলে সংরক্ষণ এবং রপ্তানিযোগ্য আলুর মান ভালো হবে। রোগাক্রান্ত, আঘাতপ্রাপ্ত, আংশিক কাটা, ফাটা, অসম আকৃতির ও অতীব সবুজায়নকৃত আলু সঠিকভাবে বাছাই করে পৃথক করতে হবে।
সুত্রঃ জাগো নিউজ