নিউজ ডেস্কঃ
কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। তবে এই কঠিন সময়েও দানাদার শস্যের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সেই সঙ্গে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থা ঠিক রাখা, কৃষকের পণ্যের দাম ও উপকরণ সহায়তা নিশ্চিত করা ছাড়াও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ সামনের দিনে বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এফএও বাংলাদেশ কার্যালয়। ‘র্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট অব ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি ইন দ্য কনটেক্স অব কভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে চলতি অর্থবছরে চালের চাহিদা থাকবে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টন এবং গমের চাহিদা থাকবে ৫৫ লাখ টন। সব মিলিয়ে দানাদার খাদ্যশস্যের চাহিদা থাকবে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টন। এ চাহিদার বিপরীতে চলতি অর্থবছরে উৎপাদন দাঁড়াবে ৩ কোটি ৯৯ লাখ টন। ফলে প্রায় ২৫ লাখ টন শস্য উদ্বৃত্ত থাকবে।
করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্যশস্যের নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় স্বস্তি দিয়েছে নির্বিঘ্নে বোরো ধান কাটা সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি। এরই মধ্যে দুই কোটি টন বোরো চাল কৃষকের ঘরে উঠে গেছে। মোট আবাদের ৯৫ শতাংশের বেশি ধান কাটা হয়েছে। যদিও বোরো ধানের সময় শ্রম সংকট, কাটা ও মাড়াই মেশিনের সংকট ছিল। এছাড়া গত আমন মৌসুমেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আমন উৎপাদন হয়েছে। সব মিলিয়ে চালের উৎপাদন পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কারণে দেশ দানাদার খাদ্যশস্য উদ্বৃত্তে রয়েছে।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত মন্ত্রণালয়ের অধিক সতর্কতা ও প্রস্তুতির কারণে দেশে দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদনে কোনো ঘাটতি থাকবে না। কৃষকের নিরন্তর আগ্রহ এক্ষেত্রে বেশ কাজে দিয়েছে। তবে সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর পরবর্তী মৌসুমের আমন ধান কৃষক যেন সঠিকভাবে আবাদ করতে পারে, সে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এখন কৃষকের আর্থিক অসংগতি তৈরি হয়েছে। এজন্য কৃষকের সব ধরনের উন্নত বীজ ও অর্থায়ন সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি কোনো ধরনের উপকরণ সংকটে যেন কৃষক না পড়ে, সেটির নিশ্চয়তা দিতে হবে। এখন কৃষককে যেকোনো হয়রানি বা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তাহলেই পরবর্তী বছরের জন্য খাদ্যশস্যের মজুদ পরিস্থিতি ধরে রাখা সম্ভব হবে।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ডিএএম), খাদ্য অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ছাড়াও বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতি ভালো থাকার কারণে বেসরকারি ও সরকারি পর্যায়ে দানাদার খাদ্যশস্যের প্রাপ্তি পর্যাপ্ত থাকবে। পরবর্তী এক মাসের ভোগের পরও মজুদ পরিস্থিতি ভালো থাকবে। আগামী ছয় মাস ভোগের জন্য খাদ্যশস্যের যতটুকু প্রয়োজন সেটিও পর্যাপ্ত রয়েছে। গত মৌসুমে আমনসহ অন্যান্য ভালো ধানের আবাদ হওয়ার কারণে ছয় মাস পরও দানাদার খাদ্যশস্যের ঘাটতিজনিত সংকট হবে না। তবে এক্ষেত্রে সরবরাহ সংকট কাটাতে প্রস্তুতি থাকতে হবে। পরবর্তী আমন মৌসুমে আগাম ফ্লাস ফ্লাড এমনকি ধান কাটা ও মাড়াইজনিত সংকট তৈরি হতে পারে। তবে দানাদার খাদ্যশস্যের চেয়ে সরবরাহ সংকটে বেশি পড়তে পারে পোলট্রি, ডেইরি ও মত্স্যজাত পণ্য। এছাড়া সামনের দিনে উৎপাদন ধরে রাখার জন্য উপকরণের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
ধান ও গমের বাইরে অন্যান্য শস্য বিশেষ করে ভুট্টা, তেল ও ডালজাতীয় শস্যের উৎপাদন পরিস্থিতি লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ ভালো রয়েছে। তবে সরবরাহ ও পরিবহন সংকটের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া আবার কৃষক পর্যায়ে পণ্যের দাম কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। করোনাকালীন সময়ে দানাদার খাদ্যশস্যসহ বেশকিছু পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সাধারণ ছুটির মধ্যে কৃষক পর্যায়ে বিভিন্ন সবজির দাম ২৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। কেননা লকডাউন পরিস্থিতিতে মাত্র ১৫ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল করেছে। এছাড়া কৃষক পর্যায়ে তেলের কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছিল। সবজির উৎপাদন পরিস্থিতি ভালো হলেও লকডাউনে সরবরাহ সংকট চরমে পৌঁছে। বিশেষ করে রাজধানীতে সবজি প্রবেশ করতে পারেনি। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন রাজধানীতে প্রায় আট হাজার টন সবজি প্রবেশ করলেও লকডাউনের সময় সেটি দুই-তিন হাজার টনে নেমে আসে। ফলে কৃষক পর্যায়ে দাম কমে যায়। আবার রাজধানীতে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি পায়।
এফএওর পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, এফএওর মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি এখনো আমরা পাইনি। তবে এটুকু বলতে পারি, ধান-গমসহ প্রয়োজনীয় শস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ত্রুটি বা অদক্ষতা আমরা রাখছি না। প্রাথমিকভাবে করোনাকালে বোরো ধান আমাদের বড় স্বস্তি দিয়েছে। এখন চলমান আউশ মৌসুমে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছি। এরই মধ্যে উত্তরাঞ্চলে আউশ আবাদে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হতে পারে। অন্যদিকে আগামী আমন মৌসুমের জন্য কৃষকের উপকরণ সহায়তা থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছি। আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয় এলে বিকল্প করণীয় বিষয়েও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আগাম বন্যা বা ফ্লাস ফ্লাড যাতে আমন বীজতলার ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য বিকল্প প্রস্তুতি রাখা আছে। সবজির উৎপাদন বাড়াতে বসতবাড়িতে আবাদে ব্যাপকভাবে প্রণোদনা শুরু হয়ে গেছে। করোনাকালে কৃষকের আর্থিক সংগতি ধরে রাখতে বড় ধরনের ঋণ ও প্রণোদনা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। আমরা শুধু উৎপাদন নয়, বিপণনও যাতে সুষ্ঠু হয় সেদিকে নজর দিচ্ছি।
দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন পরিস্থিতি ভালো থাকলেও দাম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এফএও। মে মাসের শেষের দুই সপ্তাহে প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ডিএএমের তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা দেখিয়েছে, ২৬ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিলের মধ্যে বেশকিছু পণ্যের দামে পার্থক্য ছিল। এর মধ্যে চালের দাম বৃদ্ধি পায় ২০ শতাংশ, আলুর ২০, ডালের ৩৫, ডিমের ৮, মাছের ১০ ও পেঁয়াজের দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
এফএওর প্রতিবেদনে সার্বিক আমদানি পরিস্থিতিও বেশ ভালো বলে অভিহিত করা হয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত ৫৮ লাখ টন দানাদার খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে চার লাখ টন হয়েছে সরকারিভাবে। এছাড়া ৫৪ লাখ টন গমের আমদানি হয়েছে বেসরকারি খাতে। তবে বাংলাদেশে গমের ভোগ বাড়ছে, যদিও গমের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় বেশ ঘাটতি রয়েছে। মূলত বেসরকারি পর্যায়ে গমের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দেশে গমের ভোগ বাড়ছে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা