নিউজ ডেস্কঃ

করোনার কারণে শিল্প, কলকারখানা, পরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সব বন্ধ থাকলেও বন্ধ হয়নি কৃষি ও কৃষকের উৎপাদন কর্মকাণ্ড। সফলভাবে হাওরের বোরো ধান কাটতে পারা এবং এখন পর্যন্ত ধানের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মনে কিছুটা উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। আলু, গম আগেই তোলা হয়ে গেছে। আউশ ধান ও পাট বোনা হয়েছে। ভয় ছিল তরমুজ নিয়ে। কিন্তু সরকারের সময়মতো হস্তক্ষেপে জরুরি পণ্য পরিবহনব্যবস্থা চালু করায় দক্ষিণবঙ্গের কৃষকেরা ভালো দাম পেয়েছেন। এখন আম আসছে। দেখার বিষয়, কতটা সফলভাবে আমও বাগান থেকে বাজারে পৌঁছে দেওয়া যায়। অন্যদিকে বন্যা-খরা মাথায় নিয়ে আউশ আমন ফসলের অনিশ্চয়তা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

অন্য চিত্রটিও কম দুশ্চিন্তার নয়। করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া প্রায় দুই কোটি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। এর ফলে গ্রামের আবাসন, কর্মসংস্থান ও খাদ্য জোগানের ওপর বেশ একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যেই লাখ লাখ ছোট–বড় খামার তাদের উৎপাদিত পোলট্রি, দুধ ও মাছ সময়মতো বিক্রি করতে না পারায় পুঁজি হারিয়েছে। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এল ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ধ্বংসলীলা। দক্ষিণবঙ্গের বহু বেড়িবাঁধ ভেঙে নোনাপানি ঢুকে পড়েছে, যা আগামী ফসল চাষ বিঘ্নিত করবে। সব মিলিয়ে খাদ্য-পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ অর্থনীতির এমন একটা নাজুক পরিস্থিতিতে আসছে জাতীয় বাজেট। এই বাজেটে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য কেমন বাজেট দেখতে চাই, মোটা দাগে তার একটি পথরেখা এখানে তুলে ধরতে চাই।

১। এবারের বাজেটটি গতানুগতিকতার বাইরে এসে সরাসরি গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও কৃষি উৎপাদনমুখী হতে হবে। বিপুলসংখ্যক ঘরে ফেরা মানুষকে এই সর্বংসহা গ্রাম ও কৃষি বিপদে যেকোনো সংকটে আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্যের জোগান দিয়েছে, এবারও দিচ্ছে। যাঁরা গ্রামে ফিরেছেন, তঁাদের অনেকে িশগগিরই শহরে ফিরে এসে আয়–রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। অতএব, বাজেটে এমন সব কাজের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে, যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হয়।

এর মধ্যে পড়ে কৃষি ও গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারকাজ। যেমন রাস্তাঘাট ও মাটির কাজ বাড়াতে হবে। হাজামজা পুকুর, খাল, নদী খনন। একমাত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনেই প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার সেচনালা এবং প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পানিনিষ্কাশনের খাল রয়েছে। বরেন্দ্র এলাকায় রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার পুকুর। সারা দেশে লক্ষাধিক খাসপুকুর ও জলাভূমি রয়েছে। ফিশারিজ বিভাগের অধীনে আছে দেড়–দুই লাখ মরা খাল। এগুলোর খননকাজ শুরু করতে পারলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ পাবেন এবং গরিবের আয়–রোজগার হবে। সেই সঙ্গে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা সেচ, মাছ চাষ ও অন্যান্য কাজে লাগানো যাবে। তবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আপাতত খননকাজে ভেকো মেশিন ব্যবহার না করাই যুক্তিযুক্ত হবে।

২। এবারের বাজেটে গ্রামীণ অবকাঠামো মেরামতকাজের ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত হবে। এলজিইডির আওতায় আছে প্রায় আড়াই লাখ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক ও বহু ক্ষুদ্র সেচখাল। সেই সঙ্গে এখন যুক্ত হলো ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধগুলো। প্রায় চার হাজার কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ আছে, যার অনেক জায়গায় এমনিতেই ভাঙা ছিল। এগুলোর আশু সংস্কারকাজের ওপর বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ ও জোর দেওয়া সংগত হবে। রাস্তাঘাট গ্রামীণ সড়ক মেরামতকাজে যেমন একদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের, বিশেষ করে মহিলাদের কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে পরিবহন, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও যোগাযোগব্যবস্থা গতি লাভ করায় গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠবে।

৩। এবারের বাজেটে একটা নতুন উদ্যোগ আসতে পারে, পদ্মা যমুনা মেঘনা নদীর তিন–চার লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য চরাঞ্চলে অর্থকরী ফসলের আবাদ শুরু করে। আগামী বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর এসব জমিতে পেঁয়াজ, রসুন, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টিআলু, সূর্যমুখী, ধনে—এসব ফসল লাগানোর উদ্যোগ নেওয়ার বিপুল সুযোগ রয়েছে। প্রথমে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, বর্তমানে পাম্পকিন প্লাস নামে একটি সংস্থা রংপুর অঞ্চলের বিশাল বালুচরগুলোতে কয়েক বছর যাবৎ নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত ভূমিহীন কৃষকদের দ্বারা মিষ্টিকুমড়া আবাদ করে সফলতা দেখিয়ে চলছে। এর জন্য বাজেটে বরাদ্দ পেলে ও দিকনির্দেশনা থাকলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ কাজটিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে আশা করা যায়।

৪। গ্রামের বহু মহিলা ইতিমধ্যে কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন। কিন্তু আশানুরূপ বিক্রি করতে পারেন না বলে শোনা যায়। বাজেটে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া উচিত এবং তারা যাতে এগুলো অধিক পরিমাণে বিক্রি করতে পারেন, সে জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন।

৫। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য বিশেষ ভর্তুকি দিয়ে সরকার এবার অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে কৃষিমন্ত্রীর বিশেষ তৎপরতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। জানা গেছে, সরকার ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদিত হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পাওয়ার পর যাতে এবারের এডিপিভুক্ত হয়ে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

৬। প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যখামারিদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণের যে ঘোষণা ইতিমধ্যে এসেছে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের স্বার্থে এবারের বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থসংস্থান থাকা দরকার। আরেকটি কাজও বাজেটে উল্লেখ থাকতে পারে—সুলভে খাদ্য বিতরণ। চলমান কর্মসূচির মধ্যে চাল, ডাল, আলুর সঙ্গে ডিম, গুঁড়া দুধ ও শুকনা মাছও অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৭। এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া দরকার কৃষি বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জোগান-শৃঙ্খলের পুনঃস্থাপন। এর জন্য গ্রামীণ হাটবাজারের ভৌত কাঠামো, কমিউনিটি গুদাম ও সংরক্ষণ, কোল্ডস্টোরেজ ব্যবস্থা ইত্যাদি নতুন করে নির্মাণ ও উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও যাতে এদিকে এগিয়ে আসতে পারে, তার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ব্যবস্থা থাকা যুক্তিযুক্ত হবে। গ্রামের হাটবাজারে লাখ লাখ পাইকার, ফড়িয়া, ব্যাপারী ও আড়তদার, যারা কৃষকের অল্প অল্প পরিমাণ পণ্যসামগ্রী একত্র করে বিপণনকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, তাদের অনেকেই অতটা শিক্ষিত নয়। এ বাজেটে এই অবহেলিত অথচ অপরিহার্য মার্কেটিং এজেন্টদের জন্য পুঁজির সংস্থান ও ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেখতে চাই।

৮। শেষ করার আগে বলতে চাই, এবার একটি ব্যতিক্রমী বছর। তাই এবারের বাজেটটিও হতে হবে এক ব্যতিক্রমী বাজেট। প্রায় তিন কোটি গ্রামীণ পরিবারের মানুষকে নিত্যদিন খেত–খামারের কাজে এবং পণ্য কেনাবেচা করতে হাটবাজারে যেতে হচ্ছে করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। তাদের জন্য স্বাস্থ্যসচেতনতা পরামর্শের পাশাপাশি এ বাজেটে ন্যূনতম কিছু স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও রোগ প্রতিরোধকারী ভিটামিন-সি এর ব্যবস্থা রাখা সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে।

এম এ সাত্তার মণ্ডল: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য এবং বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য

সুত্রঃ প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *