কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
- ‘গাহি তাহাদের গান,
ধরণীর হাতে দিলো যারা আনি,
ফসলের ফরমান।
শ্রমকিনাঙ্ক কঠিন যাদের, নির্দয় মুঠি তলে,
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয়, ডালি ভরে ফুলে ফলে’’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম
কোভিড-১৯ বা করোনা মহামারীর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ আজ লকডাউনের বেড়াজালে বন্দি। এই অবস্থায় পৃথিবীর খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বায়নের এই প্রভাব বাংলাদেশের কৃষি তথা কৃষকের জীবনযাত্রায় পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তাই বলে কি থেমে যাবে সবকিছু! না, ঘুরে দাড়াতে বাংলার কৃষককে। কবি নজরুলের বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কঠিন কিণাঙ্কে ফলাতে হবে সোনার ফসল।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা সবাই কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে জানি। তিনি শুধু কবি নন, তিনি ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের এক রূপকার। তিনি প্রতিটি পেশাজীবী মানুষকে লিখনীর মাধ্যমে উজ্জীবিত করেছিলেন। সমাজের মানুষকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষক সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কাজী নজরুল ইসলামের আন্তরিকতা ছিল অনেক। প্রিয় কবি নজরুল ইসলামের মাঝে কৃষকের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা ছিল। কৃষক সমাজের কল্যাণে ও উন্নয়নে কৃষকের গান লিখে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা অগ্রগামী করে কৃষক সমাজের কল্যাণে তাঁর লিখনী বিস্তৃত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি, প্রতিবাদী কবি। সমাজে চাপা পড়া, অবহেলার শিকার মানুষদের জন্য তিনি লিখেছেন। তাদের মর্যাদার জন্য সোচ্চার হয়েছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর পরিবারসহ আত্মীয়-পরিজনের অধিকাংশই ছিলেন কৃষিজীবী। গ্রামের সেই কুসংস্কারে আবর্তিত জীবনধারায় তাঁকে নানা বৈচিত্র্যে বেড়ে উঠতে হয়েছে। তিনি সকল শ্রেণীর মানুষকে সম-মর্যাদায় আনতে লিখে গেছেন অবিরত। মুটে, মজুর, কৃষক, কামার-কুমার সকলের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি অসংখ্য কবিতা, গান, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়সহ নানা বৈচিত্র্যের লেখার মধ্য দিয়ে জাগ্রত করেছেন।
প্রিয় কবি নজরুল ইসলামের মাঝে কৃষকের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা ছিল। কৃষক সমাজের কল্যাণে ও উন্নয়নে কৃষকের গান লিখে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা অগ্রগামী করে কৃষক সমাজের কল্যাণে তাঁর লিখনী বিস্তৃত হয়েছে। কৃষকের গান শুনে কৃষকদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে প্রেরণা। নজরুলের এ সর্বজনীন ভাবনা নিঃসন্দেহে আধুনিক। বিশেষ করে পত্রিকার নাম ‘লাঙল’ দিয়ে চাষা, মজুর, কৃষকদের অবস্থান সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লাঙল প্রতীকের মাধ্যমে নজরুল সর্বজনীন হয়ে উঠেছেন। কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কৃষকদের ‘জীবনবন্দনা’ লিখে নিঃসন্দেহে গণমানুষের কবি হয়ে উঠ
নজরুল ‘কৃষক প্রজা সমিতি’ (পার্টি), ‘নবযুগ’ এবং ‘লাঙল’ পত্রিকার’ সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন। লাঙল (১৯২৫) পত্রিকাটির লোগো ছিল লাঙল কাঁধে কৃষাণের ছবি। এই পত্রিকার ২য় সংখ্যায় ‘কৃষাণের গাণ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়।
নজরুল কৃষককুলের প্রতি একটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে শুধু বক্তৃতা নয়, কবিতা নয়, লাঙল পত্রিকা নয়-তিনি কৃষক প্রজা পার্টির জন্য গানও লিখে দিয়েছেলেন আর সে গান শিল্পী আব্বাস উদ্দিন শেরেবাংলার জনসভাতে গেয়ে বেড়াতেন। আর শেরেবাংলার স্লোগান ছিল ‘লাঙল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার’। এ ছাড়াও তিনি নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে লাঙল মার্কা ব্যবহার করেছিলেন। এভাবেই রাজনীতি এবং সাহিত্যে তখনকার বাংলায় এক কৃষিবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে লাঙলের কথা গরুর কথা ও গরিব কৃষকের কথাও এসেছে। ইংরেজ দেখলেই নজরুল তার ফোরাস গানের লাইন ‘দে গরুর গা ধু-ইয়ে’ বলে উঠতেন। গরু হাল টানে নীরবে কষ্ট বুঝে না, ঠিক সেভাবেই কৃষকও কষ্ট করে, তাদেরও প্রতিবাদের ভাষা নেই। এ অবস্থা থেকে মুক্তির সংগ্রামী দাবির পক্ষেই নজরুলের সব লেখার শক্তি। ‘ধর্মঘট’ প্রবন্ধটি নজরুল এ কারণেই চাষিদের উদ্দেশে রচনা করেন। গ্রাম্য প্রবাদ নিয়ে রচনাটি শুরু হয় ‘যে এলো চষে সে রইল বসে, নাড়া-কাটাকে ভাত দাও এক থালা কষে’।
কৃষক শ্রমিকের প্রতি সম্ভাষণ জানিয়ে নজরুল লিখেন,
“আমার এই কৃষাণ ভাইদের ডাকে বর্ষায় আকাশ ভরিয়া বাদল নামে, তাদের বুকের স্নেহধারার মতই মাঠ-ঘাট পানিতে বন্যায় সয়লাব হইয়া যায়; আমার এই কৃষাণ ভাইদের আদর সোহাগে মাঠ-ঘাট, ফুলে-ফলে-ফসলে শ্যাম সবুজ হইয়া ওঠে- এই মাঠকে জিজ্ঞাসা কর, মাঠে ইহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাইবে, এ মাঠ চাষার এ মাটি চাষার, এর ফুল-ফল কৃষক-বধূর।” (কৃষক শ্রমিকের প্রতি সম্ভাষণ; নজরুল)।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার, উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি শিশু-পাঁজরের হাড়?’ কবি নজরুল ঈদের চাঁদকে দেখেছেন কৃষকের মৃত শিশুর পাঁজরের হাড়ের মতো। পাঁজরের হাড় যেমনি বাঁকা, রমজানের শেষে যে ঈদের চাঁদ ওঠে, সেটিও পাঁজরের হাড়ের মতোই বাঁকা। কৃষকের এই সন্তান অকালমৃত্যুর কাছে হার মেনেছে। জীবদ্দশায় তার বাবা-মা তাকে এক বিন্দু দুধ দিতে পারেনি। অপুষ্টিতে অনাহারে শিশুটির মৃত্যু ঘটেছে। কবি আরও লিখেছেন,
‘আসমান-জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশু অধর পুটে। কৃষকের ঈদ! ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার, যত তকবির শোনে বুকে তার ততো উঠে হাহাকার! মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু-বন্যা আসে।
এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা-মসজিদে আশপাশে।’
একদিকে ঈদের চাঁদ যেন মৃত খোকার পাঁজরের হাড়ের মতো, অন্যদিকে মৃত শিশুটির ঠোঁট দুটি যেন এক ফালি চাঁদের মতোই ফুটে আছে। প্রকৃতির বিরল সুন্দর ছবিগুলো কীভাবে অভাব-অনটন-দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে উঠতে পারে সেই দৃশ্য তুলে ধরার ক্ষমতা সুকান্ত বা নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। কারণ তাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় ছিল অভাব-অনটনের কশাঘাত আর ক্ষুধার কষ্ট। এমন ভাবনা অন্য কোনো কবির পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়। সারা জীবনে শুধু অবিমিশ্র সুখ ও আনন্দের অনুভূতিতে কাল কাটিয়েছে, নজরুলের ভাবনা বড়ই মর্মস্পর্শী। একই কবিতায় তিনি আরও লিখেছেন,
‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে, লুকাইয়া আছো লজ্জায় কোন মরুর গরস্তানে। হের ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত কংকাল, কসাইখানায় যাইতে দেখেছো শীর্ণ গরুর পাল? রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু সলিলে হয়, বেলাল! তোমার কণ্ঠে বুঝির আজান থামিয়া যায়! থালা, ঘটি, বাটি বাধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে, তীর-খাওয়া বুক, ঋণে বাধা শির লুটাতে খোদার রাহে
করোনাকালীন সময়ে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে তাই প্রয়োজন…………
1) কৃষকের সব ধরনের উন্নত বীজ ও অর্থায়নের সহায়তা
2) খাদ্য ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থা ঠিক রাখা,
3) উৎপাদন ধরে রাখার জন্য উপকরণের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা
4) ভোক্তা কৃষক পর্যায়ে পণ্যের দামের ভারসাম্য আনয়ন
5) কৃষকের আর্থিক সংগতি ধরে রাখতে বড় ধরনের ঋণ ও প্রণোদনা কার্যক্রম শুরু করা
6) আগাম বন্যা বা ফ্লাস ফ্লাড যাতে আমন বীজতলার ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য বিকল্প প্রস্তুতি রাখা
7) ধান ও গমের বাইরে অন্যান্য শস্য বিশেষ করে ভুট্টা, তেল ও ডাল জাতীয় শস্যের উৎপাদন পরিস্থিতি
করোনাকালীন সময়ে কৃষির সমৃদ্ধ আনয়নে তাই কৃষক ভাইদের নজরুলের গানে ডাক দিয়ে যাই………..
মোরা বিহান-বেলা উঠে রে ভাই চাষ করি এই মাটি।
যে মাটির বুকে আছে পাকা ধানের সোনার কাঠি॥
ফসল বুনে রোদের তাতে উঠি যখন ঘেমে
সদয় হয়ে আকাশ বেয়ে বৃষ্টি আসে নেমে
(ওরে) মুচকি হেসে বৌ এনে দেয় পান্তা ভাতের বাটি॥
আশ মেটে না চারা ধানের পানে চেয়ে চেয়ে
মরাই ভ’রে থাকবে ওরাই আমার ছেলে মেয়ে।
(আমি) চাই না স্বর্গ, পাই যদি এই পাকা ধানের আটি (রে ভাই)॥
জল নিতে যায় আড়চোখে চায় বৌ-ঝি নদীর কূলে
খুশিতে বুক ভ’রে ওঠে, খাটুনি যাই ভুলে।
এ মাঠ নয় ভাই বৌ পেতেছে ঠান্ডা শীতল পাটি॥
লেখক,
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
পুঠিয়া, রাজশাহী