নিউজ ডেস্কঃ
বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯ দেশে ধান ও চালের মজুদ পরিস্থিতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। চলতি বছরের জুনে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কৃষকের ধানের মজুদ প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে ধানের মজুদ প্রায় ১৪ শতাংশ এবং চালের মজুদ প্রায় ৩ শতাংশ কমেছে মিলারদের। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
করোনাকালীন খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি, ধানের উৎপাদন এবং বাজারজাতে গৃহীত পদক্ষেপের পর্যালোচনা এবং মজুদ পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে ‘ফুড সিকিউরিটি ইন দ্য কভিড-১৯ এরা: ইজ বাংলাদেশ রিয়েলি গোয়িং টু ফেস অ্যানি রাইস শর্টেজ ইন দ্য লং রান’ শীর্ষক এ গবেষণা পরিচালনা করেছে ব্রি। গতকাল একটি জাতীয় সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
ব্রির গবেষণায় দেখা যায়, গত বছরের জুনে মোট ধানের মজুদে মিলারদের অংশ ছিল ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ। আর কৃষকের ছিল মাত্র ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ট্রেডারদের অংশ ছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি বছরে জুনে এসে এ চিত্রে বড় পরিবর্তন চোখে পড়েছে। ওই মাসে মিলারদের মজুদ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। আর কৃষকের মজুদ বেড়ে হয়েছে ২৯ দশমিক ১ শতাংশে। তবে চলতি বছরে ধানের মজুদকরণে নতুনভাবে কৃষক ও ট্রেডার্স শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। এই গ্রুপের হাতে ধানের মজুদ চলে গেছে প্রায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আর প্রথাগত ট্রেডার্স ও ফড়িয়াদের হাতে মজুদ কিছুটা বেড়ে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
চালের মজুদের ক্ষেত্রেও মিলারদের অংশ কমে গেছে। এখানে ভোক্তাদের বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। গত বছরের জুনে মোট চাল মজুদের ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল মিলারদের। এছাড়া চাল মজুদের সরকারের ৫ দশমিক ৪, ভোক্তাদের ১৫ দশমিক ১, খুচরা ব্যবসায়ীদের ১৫ এবং চালের আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অংশ ছিল ২২ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের জুনে এ চিত্রে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ভোক্তারা চালের মজুদ বাড়িয়েছেন প্রায় দ্বিগুণ। চলতি বছরের জুনে ভোক্তা পর্যায়ে চালের মজুদ প্রায় ২৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে মজুদ কমেছে মিলার, সরকার, খুচরা ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের। এ সময় খুচরা ব্যবসায়ীদের ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ১৮ দশমিক ৪, মিলারদের কাছে ৩৯ দশমিক ৭ ও সরকারের কাছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ চাল মজুদ ছিল।
চাল ও ধানের মজুদ পরিস্থিতির পরিবর্তনের বিষয়ে ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, কৃষক পর্যায়ে ধান মজুদ বৃদ্ধির বেশকিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। তারা ভালো দাম পেয়েছেন। অন্যদিকে করোনাকালে অধিক লাভের আশায় ধান মজুদে এক ধরনের নতুন মার্কেট প্লেয়ার যুক্ত হয়েছেন। মূলত এই শ্রেণী ধান বা চাল কেনাকে বিনিয়োগ মনে করছেন। এরা মূলত বিভিন্ন শহর থেকে চাকরি কিংবা ব্যবসা হারিয়ে বা নিরাপদে থাকার আশায় গ্রামে ফিরে গেছেন। তাদের হাতে স্বল্প কিছু টাকা থাকায় ধান-চালের ব্যবসা বা মজুদকে নিরাপদ মনে করছেন। এসব কারণে এ বছর মিলারদের ধান মজুদের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম ছিল।
চালের ক্ষেত্রে ভোক্তা শ্রেণীর মধ্যে মজুদ প্রবণতা অতিমাত্রায় দেখা যাচ্ছে এবার। ভবিষ্যৎ খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা থেকে আতঙ্কিত হয়ে বেশি পরিমাণ চাল মজুদ করেছেন ভোক্তারা। অন্যান্য চাল ব্যবসায়ী গত বছরের তুলনায় কম পরিমাণে চাল মজুদ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, তাদের মুনাফা কিছুটা কমে গেছে।
মজুদে লাভবান হচ্ছেন কৃষক: ধান কাটা মৌসুমে কাঁচা ধানের দাম গত বছরের তুলনায় বেশি থাকায় কৃষকের আয় ১৬ দশমিক ৭ ভাগ বেড়েছে। এ বছর তারা গড়ে বিঘাপ্রতি ১ হাজার ৬০৪ টাকা লাভ করেছেন। যদিও গত বছর তাদের লোকসান গুনতে হয়েছিল। চলতি বছর ধান কর্তন সময়ে এবং তার এক-দুই মাসের মধ্যে কৃষকরা গত বছরের তুলনায় কম পরিমাণ ধান বিক্রি করেছেন। একদিকে ভবিষ্যৎ খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা, অন্যদিকে ধানের দাম বেশি থাকায় অল্প ধান বেচেই উৎপাদন ও পরিবারের খরচ বহন করতে পেরেছেন তারা। অধিকন্তু বেশি দামের আশায় ধান মজুদ করার প্রবণতা বাড়তে দেখা গিয়েছে। এ বছর বোরো ধানের দাম বেশি থাকায় কৃষক আউশ চাষে ঝুঁকেছেন। ফলে গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৮ ভাগ বেশি জমিতে আউশ ধান আবাদ হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের প্রায় ৩১টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। তাই বন্যার ফলে আউশের প্রত্যাশিত উৎপাদন কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
করোনাকালে মিলারদের মজুদ কিছুটা কমলেও ধান-চালের ব্যবসায় এখনো লাভে আছেন তারা। তবে গত বছরের তুলনায় তাদের মুনাফা কিছুটা কমতি দেখা গেছে। চাল উৎপাদন খরচের ক্ষেত্রে মৌসুমে বিদ্যমান সর্বনিম্ন দামে মিলাররা যে ধান ক্রয় করেন সেটি থেকে কেজিপ্রতি চাল উৎপাদনে ২৭ টাকা ৮৬ পয়সা খরচ হয়। ফলে ৮ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছেন তারা। অন্যদিকে সর্বোচ্চ দাম বিবেচনায় দেখা যায় কেজিপ্রতি চাল উৎপাদনে ৩৫ টাকা ৮০ পয়সা খরচ হয়। গড় বিবেচনায় এক কেজি চাল উৎপাদনে ৩২ টাকা ৩৪ পয়সা ব্যয় হয়। বিদ্যুৎ বিল, যানবাহন ও শ্রমিক খরচ বাড়ার কারণে এ বছর মিলিং খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। খরচ বৃদ্ধির ফলে মুনাফা কিছুটা কমছে। তবে সরকার ঘোষিত দামে চাল বিক্রি করে মিলাররা লাভবান হচ্ছেন।
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, কভিড-১৯ সময়েও মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার মন-মানসিকতা সবার নেই। একটা গ্রুপ রয়েছে যারা সুযোগ পেলেই চালের দাম বাড়িয়ে দেয়। কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করে। আমাদের কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থকেই গুরুত্ব দিতে হবে। এই দুয়ের মাঝে সমন্বয় করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে সরকারি মজুদ সঠিক পরিমাণ রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের মধ্য জুলাই পর্যন্ত পাঁচটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে ব্রি। এগুলোর মধ্যে হাওড়ের ধান কর্তনে শ্রমিক ও যান্ত্রিকীকরণের ভূমিকা, সুপার-সাইক্লোন আম্পানের প্রভাব নিরূপণ, ধান-চালের মজুদ পরিস্থিতি এবং বাজারমূল্যে এর প্রভাব, ৬৪ জেলায় কৃষকের মাঠের ফসল কর্তন এবং আউশ আবাদ পরিস্থিতি নিয়ে র্যাপিড সার্ভের মাধ্যমে করোনাকালে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এসব গবেষণার ফল বিশ্লেষণে ৬৪টি জেলায় ব্রি কর্তৃক ১ হাজার ৮টি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৬৯টি ফসল কর্তনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই সার্ভে কার্যক্রমে দেশের ৩৮টি জেলার ৫৭টি উপজেলা এবং ফলন কর্তনে ৬৪টি জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সুত্রঃবনিক বার্তা