ওয়াসিফ রহমান এবং খোরসেদ আলম
ইংরেজিতে সুন্দর একটা প্রবাদ আছে Agriculture is the root of all culture অর্থাৎ কৃষিই সকল কৃষ্টির মূল। আদিমতম পেশা কৃষি একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়তে কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিদদের দিয়েছিলেন ক্লাস ওয়ান মর্যাদা। কৃষিবিদরা সেই মান বজায় রাখতে মরিয়া ছিলেন। সাত কোটি বাঙালিকে খাওয়ানোর চ্যালেন্জ নিয়ে তারা বাংলাদেশকে বিশ কোটি মানুষকে খাওয়াতে সক্ষম বানিয়েছিলেন। কিন্তু এই পথ কন্টাকাকীর্ণ ছিলো। প্রতি বিঘায় এক মন ধান হতে চল্লিশ মন ধান পর্যন্ত উৎপাদন করতে গিয়ে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
প্রথমত উৎপাদন বাড়াতে হতো। কৃষিবিদরা উঠে পড়ে লাগলেন উচ্চ ফলনশীল জাতের আবিষ্কারে। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি নিয়োজিত হলো মানসম্মত বীজ উৎপাদনে। মানসম্মত বীজ লাইন লোগো করে লাগালেও উৎপাদন বাড়ে। মাঠে বাস্তবায়ন করা হলো লাইন লোগো পদ্ধতির ব্যবহার। চারার বয়স ও স্বাস্থ্যের উপর উৎপাদন অনেকটা নির্ভরশীল। মাঠে বাস্তবায়ন করা হলো আদর্শ বীজতলা সেই সাথে কড়া মনিটরিং। যেই কথা তেমনি কাজ। পার্চিং করলে যেমন পরিবেশ বান্ধব বালাই দমন ব্যবস্থা করা যায় তেমনি বাড়ে উৎপাদন। সমগ্র বাংলাদেশ হয়ে হয়ে বিশাল পার্চিংক্ষেত্র। এভাবেই উৎপাদন বাড়াতে তথাা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুষম সারের ব্যবহার এবং সারকে সুলভ মুল্যে কৃষকের নিকট সহজলভ্য করা, প্রদর্শনী বাস্তবায়ন, কৃষককে প্রণোদনা প্রদান, বন্যার সময় কমিউনিটি বীজতলা ও ভাসমান বীজতলা বাস্তবায়ন, সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা, সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহ, বসত বাড়ির জমির ব্যবহার, কৃষি অফিসে থেকে সার্বক্ষনিক তথ্য এবং সহযোগিতা, শাকসবজির ক্ষেত্রে কালিকাপুর মডেলসহ বিভিন্ন মডেলের ব্যবহার, এরকম অসংখ্য কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করলো খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এক্ষেত্রে যোগ্য অভিভাবকের মতো সেই খামারবাড়ি, ঢাকা থেকে কৃষি অফিসের কন্ট্রোল রুম পর্যন্ত নেতৃত্ব দিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। একদিকে পলিসি মেকিং অন্যদিকে মাঠে তার সফল বাস্তবায়ন।
২০২০ সাল যেন বিষফোড়া হয়েই হাজির হলো । কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশও কোভিড-১৯ আক্রমণে বিপর্যস্ত। সমগ্র পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ আজ লকডাউনের বেড়াজালে বন্দি। এই অবস্থায় পৃথিবীর খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও করোনা পরবর্তী প্রভাব মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে হলে সর্বাগ্রে চাই খাদ্য নিরাপত্তা ।
কিন্তু আশা ও স্বস্তির বিষয় বিভিন্ন প্রতিকূলতা থাকা স্বত্বেও বাংলাদেশ আজ খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি কৃষকের মাঠে সফলভাবে বাস্তবায়নের ফলে দানা খাদ্য শস্যসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দু:খের বিষয় এই যে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে অদ্যাবধি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রায় ৬০ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সম্মানিত মহাপরিচালকসহ ক্যাডার কর্মকর্তাই ২৬ জন।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২০২০ এর ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামগুলোতে ১৭ লাখ মে. টনের বেশি খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। চলতি মৌসুমে আলু, পেয়াজ, মরিচ ও গমের বাম্পার ফলন হয়েছে।
এছাড়া মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, কৃষি মন্ত্রণালয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিয়েছেন।
যোগ্য অভিভাবকের মতো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। করোনা পরিস্থিতিতেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর সার্বক্ষনিক বিচরণ ছিল মাঠে, কৃষকের পাশে। বোরো ধান কাটার সময় যেন শ্রমিক সংকট না হয় সেজন্য মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশের পর হাওর এলাকায় কম্বাইন হারভেস্টার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক পাঠিয়ে দ্রুত ধান কাটা নিশ্চিত করা হয়েছে। বোরোর নিবিড় পরিচর্যা ও মনিটরিং ও সঠিক সময়ে ধান কাটার ব্যবস্থার করায় বাংলাদেশ আজ এই মহামারীর মধ্যেও চাল উৎপাদনে বিশ্বে ৩য় স্থান অধিকার করেছে।
চলমান খরিপ ১ মৌসুমে আউশ আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো যেন এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না থাকে সেই লক্ষ্যে প্রতিটি বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সবজি ও সম্ভাব্য স্থানে দুই সারি আদা হলুদ এবং ফল চাষ সর্বোপরি পুকুড়পাড় ও রাস্তার পাশে সবজি চাষ করার জন্য কৃষককে উদ্ধুদ্ধ করা সহ যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সকল কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
নোবেল পুরস্কারজয়ী লর্ড জন বায়ড বলেছেন ক্ষুধার্ত পেটে তুমি কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। সংকটাপন্ন এই করোনা পরিস্থিতিতে ১৭ কোটি মানু্ষের ক্ষুধার অন্ন যোগানোর পাশাপাশি কৃষিই যেন অর্থনীতির হাল ধরার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
করোনা পরবর্তী কাল,
কৃষিই ধরবে একমাত্র হাল….
লেখক: ওয়াসিফ রহমান এবং খোরসেদ আলম,
৩৭ তম বিসিএস (কৃষি)
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার