ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম

বাংলাদেশে জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪.২৩%। অন্যদিকে কলকারখানাগুলো অবদান রাখছে ৩৩.৬৬% এবং বাকি ৫২.১১% অন্যান্য সেক্টর হতে জিডিপিতে যোগ হচ্ছে। ‘দ্য গ্লোবাল ইকোনমি’-এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৬১টি দেশের মধ্যে জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান রাখা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৩তম। প্রথম অবস্থানে সিয়েরালিয়ন এবং ১৬১তম-এ রয়েছে সিঙ্গাপুর। জিডিপিতে কৃষির অবদানের মধ্যে শস্য, লাইভস্টক, মৎস্য ও বনায়ন হতে যোগ হচ্ছে ৫৫%, ১৪%, ২২% এবং ৯% যথাক্রমে। কৃষি ও কৃষকবান্ধব সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরলস প্রচেষ্টায় কৃষির অবদান জিডিপিতে গত ১০ বছরে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। জিডিপিতে কৃষিখাতের এই বাড়তি টিকিটটি কীভাবে চলমান রাখা যায় স্বাধীন বাংলাদেশে সেই দিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, এই প্রাণঘাতী করোনার মহামারির সময়।
প্রাণঘাতী করোনার সময় মাঠ থেকে ফসল সংগ্রহ একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কৃষি মন্ত্রণালয় দ্রুতগতিতে কম্বাইন্ড হারভেস্টর সরবরাহের মাধ্যমে হাওর অঞ্চলসহ অন্যান্য এলাকার ধান শতভাগ কাটতে কৃষককে সহায়তা করেন। বর্তমানে করোনা নামক দুর্যোগটি চলমান বিধায় এই মহামারির কারণে কৃষির ওপর ব্যাপক কোনও প্রভাব ফেলতে না পারে তার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা করা উচিত। পরিকল্পনাটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে করোনার মতো আরও মহামারি এলেও কৃষির ওপর কোনও ধরনের প্রভাব না পড়ে।

বাংলাদেশে মোট ফসলি জায়গা ১,৫০,৩৪০৭১ হেক্টর। অন্যদিকে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, পোকামাকড়, রোগ জীবাণু ও মাটি দূষণসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। তারপরও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০১৮ সালে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন টন ধান উৎপন্ন হয়, যেখানে মোট জনসংখ্যার জন্য চাহিদা ছিল ২৯ মিলিয়ন টন। ওই হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৭ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত ধান উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ধান বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হওয়ায় নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ করোনার মহামারির সময়ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ। নিঃসন্দেহে এটি একটি সৌভাগ্যের ব্যাপার বিশ্বের মানচিত্রে।

অন্যদিকে ইনল্যান্ড, অ্যাকুয়াকালচার ও মেরিন মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের মানচিত্রে ৩য়, ৫ম ও ১১তম যথাক্রমে। বাংলাদেশে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি এবং হাঁস রয়েছে যথাক্রমে ২৫.৭, ০.৪৩, ১৪.৮, ১.৯, ১১৮.৭ এবং ৩৪.১ মিলিয়ন। দানা জাতীয় ফসল, সবজি, মৎস্য ও লাইভস্টকে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ প্রোটিন রয়েছে। পাশাপাশি ভিটামিন, মিনারেলস, শর্করাসহ অনেক ধরনের অ্যান্টি অক্সিডেন্টও রয়েছে। ওই উপাদানগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় বিধায় মানবদেহের জন্য সাধারণত সবসময় প্রয়োজন।

বর্তমান বিশ্বে প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের কারণে কৃষি ফসল উৎপাদনসহ সরবরাহ বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাহত হওয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশেও এর প্রভাব ভবিষ্যতে পড়তে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বাঘ নামক প্রাণীটি প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এভাবে যদি মানুষ হতে ভাইরাসটি প্রাণীতে ছড়ায় তাহলে বিষয়টি খুবই ভয়ংকর। সমুদ্র হতে মৎস্য আহরণসহ গবাদি পশু পালন ও ফসল উৎপাদন সর্বক্ষেত্রেই মানুষের সংস্পর্শ রয়েছে। কোভিড-১৯ রোগ স্থানান্তরের বিষয়টি অদৃশ্য ও অপ্রকাশিত হওয়ায় সর্বক্ষেত্রেই মানুষকে সচেতনতার সঙ্গে কৃষিকাজ করতে হবে। এমতাবস্থায় অনেকেই কৃষিকাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে, খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টির গুরুত্ব কম বিবেচনায় নিয়ে নিজের জীবনের কথা ভেবে।

পূর্বের ইতিহাস অনুযায়ী কোভিড-১৯ এর মতো আরও বহু রকমের মহামারির সম্মুখীন হয়েছিল গোটা বিশ্ব। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপে টিউবারকিউলোসিস (টিবি) এর প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছিল ১৬০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দের সময়। ওই রোগে ইংল্যান্ডে প্রতি চারজনে একজন ও ফ্রান্সে প্রতি ছয়জনে একজন মানুষ মারা গিয়েছিল। অন্যদিকে ১৮ শতকের দিকে গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবে প্রতিবছরে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্বে। ব্যাকটেরিয়া বাহিত রোগ প্লেগের প্রাদুর্ভাবে হয়েছিল চৌদ্দ শতকের মধ্যবর্তী সময়। ওই রোগে পাঁচ বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। আঠার শতকের দিকে কলেরা ও ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাবে গোটা পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছিল। উনিশ শতকের দিকে পোলিও মহামারি দেখা দিয়েছিল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৮-১৯১৯) স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি দ্বারা গোটা বিশ্বে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। অন্যান্য মহামারির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এইডস, মার্স, সার্স ও সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো প্রাণঘাতী জীবাণু দ্বারা গোটা পৃথিবীর মানুষ শাসিত হয়েছে।

প্রতিটি মহামারির সময় নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের বিষয়টি ছিল ফ্রন্টলাইনে। বর্তমানে কোভিড-১৯ রোগের মহামারির বিষয়টিও অন্যান্য মহামারির প্রাদুর্ভাবের তুলনায় অনেকটাই ব্যতিক্রম ও মারাত্মক। ফলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনসহ সরবরাহের জন্য কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষকরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে যদিও দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে, তারপরও ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ এর মতো প্রাণঘাতী মহামারি মোকাবিলা করার শক্তি ও সাহস সঞ্চয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন।

যাই হোক, কৃষিক্ষেত্রে ও করোনার আতংক বিরাজমান সারাবিশ্বে। বিশেষজ্ঞদের মতে মহামারি যদি দীর্ঘদিন চলমান থাকে, তাহলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। ফলে পৃথিবীতে ৩ কোটিরও বেশি মানুষ খাদ্য সংকটে না খেয়ে মারা যেতে পারে। এমতাবস্থায় কৃষিকে ও ফ্রন্টলাইনের সারিতে বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগের মহামারিসহ অন্যান্য দুর্যোগের সময় দেশকে খাদ্যসংকট হতে বাঁচাতে হবে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে করোনা দুর্যোগের এই শিক্ষা ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের দুর্ভোগ মোকাবিলা করার সহায়ক হবে। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভবিষ্যতে কৃষির ওপর চলমান করোনার প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। এই পরিকল্পনায় কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে—

করোনাসহ অন্যান্য দুর্যোগের কারণে কী পরিমাণ ফসল, সবজি, মাছ ও মাংস উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান কৃষি সম্প্রসারণ, মৎস্য ও পশু সম্পদ অধিদফতরের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করা উচিত। যেহেতু দুর্যোগের সময় দৈনিক শ্রমিক পাওয়া অনেকটা কষ্টকর, সেহেতু পূর্বে থেকেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহায়তায় কৃষিকে ডিজিটালাইজড-এর জন্য কম্বাইন্ড হারভেস্টর, রিপার, ট্রাক্টর, ট্রান্সপ্লান্টর, উইডারসহ অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি প্রতিটি উপজেলায় কৃষি কর্মকর্তার অধীনে পর্যাপ্ত মজুত রাখা উচিত। সার, বীজ ও কীটনাশক কৃষিকদের মধ্যে বিনামূল্যে অথবা সুলভ মূল্যে অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের বিনাসুদে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান যা পরবর্তীতে ফসল বিক্রি করে এই ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। অন্যদিকে মৎস্য ও পশুসম্পদ অধিদফতরের সহায়তায় খামারিদের মধ্যে পর্যাপ্ত টেকনিক্যাল সহায়তা অব্যাহত রেখে তাদের মধ্যে ২% সুদে ঋণ প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। ফলে মানুষের মধ্যে প্রাণিজ আমিষের সরবরাহের ঘাটতি থাকবে না।

সার্টিফাইড খাদ্য উৎপাদন ও ফার্মার্স মার্কেটের বিষয়টি ও নজরে আনতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহরে সরকারিভাবে ফার্মার্স মার্কেট খোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এই মার্কেটে  কৃষক হতে উৎপাদিত পণ্য নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে। প্রতিটি কৃষি পণ্য স্থানীয় বাজারে কত টাকা বিক্রি হয়ে শহরের ফার্মার্স মার্কেটে যাচ্ছে তার প্রতিটি স্থানের মূল্য লেখা থাকবে। ফলে শহরের একজন ক্রেতা কত বেশি দামে ক্রয় করলো তা সহজেই বুঝাতে পারবে। আর একটি বিষয়ে খুবই জোর দেওয়া উতি, সেটি হলো প্রতিটি কৃষি পণ্যের গায়ে লেখা থাকবে ‘সার্টিফাইড ফুড’। যদি কেমিক্যাল ব্যবহার ছাড়া কোনও সবজি/মাছ/পশু উৎপাদিত হয়, তাহলে লেখা থাকবে ‘অরগানিক ফুড’। অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘ইন-অরগানিক ফুড’ লেখা থাকবে। বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ফুড সার্টিফিকেশনের বিষয়টিও নৈতিকতার বিষয়।

পরিশেষে বলা যায়, ‘নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন’ যদি খাদ্য উৎপাদনের সহিত যুক্ত হয়, তাহলে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর মতো মহামারি মোকাবিলা করা সহজ হবে। ফলে হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার ও নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর চাপ কমে যাবে। একটি দেশের চিকিৎসা খরচসহ জাতীয় খরচও কমে যাবে। ফলে দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও বেড়ে যাবে। সঠিকভাবে যদি বিষয়টি উপস্থাপন করা যায়, তাহলে বলতে হয়, ডাক্তার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো আমাদের দেশের কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীরাও ফ্রন্টলাইন থেকে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রেখে মানবদেহে হার্ড ইমিউনিটি উন্নয়নে এই প্রাণঘাতী জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তা করে যাচ্ছে অবিরাম গতিতে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এনভাইরনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *