কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
————————————————-
© ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচ বেগুন পরিবারের ফসল। বাংলাদেশে এর ব্যবহার কম হলেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজি। এর উৎপত্তি স্থল হলো দক্ষিণ আমেরিকার নিরক্ষীয় অঞ্চল। ধারণা করা হয়ে থাকে ব্রাজিল মিষ্টি মরিচের উৎপত্তিস্থান।
© মিষ্টি মরিচের ফলের আকার ও আকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, তবে সাধারণত ফল গোলাকার ও ত্বক পুরু হয়। মিষ্টি মরিচ আমাদের দেশীয় প্রচলিত সবজি না হলেও অতি সম্প্রতি এর চাষ এ দেশে প্রসারিত হচ্ছে বিশেষ করে বড় বড় শহরের আশপাশে সীমিত পরিসরে কৃষকরা এর চাষ করে থাকে, যা অভিজাত হোটেল ও বিভিন্ন সুপার মার্কেটে বিক্রি হয়ে থাকে।
© মিষ্টি মরিচের রপ্তানি সম্ভাবনাও প্রচুর। বিশ্বে অনেক দেশেই মিষ্টি মরিচ একটি জনপ্রিয় সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
© বিশ্বে টমেটোর পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সবজি হচ্ছে মিষ্টি মরিচ। এর বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে যেমন পাতা সালাদ অথবা স্যুপ তৈরিতে ব্যবহার হয়, কাঁচা ফল সালাত এবং রান্না করে সবজি হিসেবে অতি সুস্বাদু খাদ্য।
© পুষ্টিমানের দিক থেকে মিষ্টি মরিচ একটি অত্যন্ত মূল্যবান সবজি। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকার কারণে এবং টবে চাষের উপযোগী বলে দেশের জনসাধারণকে মিষ্টি মরিচ খাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
চাষাবাদ ও উৎপাদন কলাকৌশল
———————————————-
জলবায়ু ও মাটিঃ
———————–
© ক্যাপসিকাম উৎপাদনের জন্য ১৬-২৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা ও শুষ্ক পরিবেশ সবচেয়ে উপযোগী। রাতের তাপমাত্রা ১৬- ২১ ডিগ্রি সে. এর কম বা বেশি হলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফুল ঝরে পড়ে, ফলন ও মান কমে যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই ফলন হয় না।
© অক্টোবর মাসে বীজ বপন করে নভেম্বরে চারা রোপণ করলে দেখা যায় যে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এ জন্য গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পলিথিন ছাউনি, পলি হাউস, পলিভিনাইল হাউসে গাছ লাগালে রাতে ভিতরের তাপমাত্রা বাইরে অপেক্ষা বেশি থাকে।
© উন্নত বিশ্বে যেমন- জাপান, আমেরিকা, বৃটেন, নেদারল্যান্ড, তাইওয়ান প্রভৃতি দেশে গ্রিন হাউস গ্লাস হাউস, পলি হাউস ইত্যাদির মাধ্যমে তাপমাত্রা ও আলো নিয়ন্ত্রণ করে বছরব্যাপী লাভজনকভাবে ক্যাপসিকাম চাষ করছে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও একই পদ্ধতি গ্রহণ করে প্রচুর ক্যাপসিকামের চাষ হচ্ছে।
© ফুল এবং ফল ধারণ দিবস দৈর্ঘ্য দ্বারা প্রভাবিত হয় না। কিন্তু আলোক তীব্রতা এবং আর্দ্রতা ফল ধারণে প্রভাব ফেলে।
© সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি মিষ্টি মরিচ চাষের জন্য উত্তম। মিষ্টি মরিচ খরা এবং জলাবদ্ধতা কোনোটিই সহ্য করতে পারে না। মিষ্টি মরিচের জন্য মাটির অম্ল ক্ষারত্ব ৫.৫-৭.০ এর মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জাত ঃ
———–
আমাদের দেশে আবাদকৃত জাতগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে– বারি মিষ্টি মরিচ-১ (লাল রং), বারি মিষ্টি মরিচ-২ ( হলুদ রং), California Wonder, Tender Bell (F1) এবং Yolow Wonder ইত্যাদি ।
© এছাড়াও সবুজ, কমলা, নীলসহ বিভিন্ন কালারের ক্যাপসিকাম বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়।
প্রতি বছর এগুলোর বীজ আমদানি করতে হয়। তবে আমাদের দেশে California Wonder এর বীজ উৎপাদন করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
জীবন কাল :
—————–
জাত ও মৌসুমভেদে মিষ্টি মরিচের জীবনকাল ১৩০ থেকে ১৫০ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বীজ বপনের সময় : অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস।
—————————
বীজের মাত্রা :
——————-
প্রতি হেক্টরে ৩০ হাজার চারার জন্য প্রায় ২৩০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয় । ০১ গ্রাম প্যাকেটে সাধারণত প্রায় ১৪০ টি বীজ থাকে।
চারা উৎপাদনঃ
——————–
© প্রথমে বীজগুলো ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সুনিষ্কাশিত উঁচু বীজতলায় মাটি মিহি করে ১০x২ সে.মি. দূরে দূরে বীজ বপন করে হালকাভাবে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বীজতলায় প্রয়োজনানুসারে ঝাঝরি দিয়ে হালকাভাবে সেচ দিতে হবে।
© বীজ গজাতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। বীজ বপনের ৭-১০দিন পর চারা ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট হলে ৯-১২ সে.মি. আকারের পলি ব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। পটিং মিডিয়াতে ৩:১:১ অনুপাতে যথাক্রমে মাটি, কম্পোস্ট এবং বালি মিশাতে হবে। পরে পলিব্যাগ ছায়াযুক্ত স্থানে স্থানান্তর করতে হবে, যাতে প্রখর সূর্যালোকে এবং ঝড় বৃষ্টি আঘাত হানতে না পারে।
© উল্লেখ্য যে, অক্টোবর মাস হচ্ছে বীজ বপনের উত্তম সময়।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ ঃ
—————————————
© ভালো ভাবে চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে যাতে জমিতে বড় বড় ঢিলা এবং আগাছা না থাকে। মিষ্টি মরিচ চাষে প্রতি শতাংশে গোবর ৪০ কেজি, ইউরিয়া ১ কেজি, টিএসপি ১.৪ কেজি, এমপি ১ কেজি, জিপসাম ৪৫০ গ্রাম এবং জিংক অক্সাইড ২০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে।
© জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক গোবর, টিএসপি, জিংক অক্সাইড, জিপসাম, ১/৩ ভাগ এমপি এবং ১/৩ ভাগ ইউরিয়া চারা রোপণের গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ২/৩ ভাগ ইউরিয়া এবং এমপি পরবর্তীতে দুই ভাগ করে চারা লাগানোর যথাক্রমে ২৫ এবং ৫০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
চারা রোপণ পদ্ধতিঃ
—————————
© চারার রোপণ দূরত্ব জাতভেদে ভিন্নতর হয়। সাধারণত ৩০ দিন বয়সের চারা ৪৫x৪৫ সে. মি. দূরত্বে রোপণ করা হয়। মাঠে চারা লাগানোর জন্য বেড তৈরি করতে হবে। প্রতিটি বেড প্রস্থে ৭৫ সে. মি. হতে হবে এবং লম্বায় দুটি সারিতে ২০টি চারা সংকোলনের জন্য ৯ মিটার বেড হবে। দু’টি সারির মাঝখানে ৩০ সে. মি. ড্রেন করতে হবে।
© চারা পড়ন্ত বিকেলে রোপণ করা উত্তম । চারা রোপণের পর গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। প্রতিদিন মাঠ পরিদর্শন করতে হবে। যদি কোনো চারা মারা যায় তাহলে ওই জায়গায় পুনরায় চারা রোপণ করতে হবে।
© নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা অনেক কমে যায় এ সময় গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় । কাজেই গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পলিথিন ছাউনিতে গাছ লাগালে রাতে ভেতরের তাপমাত্রা বাইর অপেক্ষা বেশি থাকে এবং গাছের দৈহিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়। এছাড়াও মালচিং পেপার ব্যবহার করে রোপণ করা যেতে পারে।
সেচ প্রয়োগঃ
—————–
মিষ্টি মরিচ খরা ও জলাবদ্ধাতা কোনোটিই সহ্য করতে পারে না। জমিতে প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে। আবার অতিরিক্ত সেচ দিলে ঢলে পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সে জন্য সুষ্ঠু নিকাশ ব্যবস্থা করতে হবে।
খুঁটিঃ
——
কোনো কোনো জাতে ফল ধরা অবস্থায় খুঁটি দিতে হয় যাতে গাছ ফলের ভারে হেলে না পড়ে।
আগাছা দমনঃ
——————-
আগাছানাশক বা হাত দিয়ে অথবা নিড়ানি দিয়ে প্রয়োজনীয় আগাছা দমন করতে হবে।
ফসল তোলাঃ
——————
© মিষ্টি মরিচের সাধারণত পরিপক্ক সবুজ অবস্থায় লালচে হলদে হওয়ায় পূর্বেই মাঠ থেকে উঠানো হয়। সাধারণত সপ্তাহে একবার গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। ফল সংগ্রহের পর ঠান্ডা অথচ ছায়া যুক্ত স্থানে বাজার জাতকরণের পূর্ব পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে।
© ফসল সংগ্রহের সময় প্রতিটি ফলে সামান্য পরিমাণে বোঁটা রেখে দিতে হবে।
ফলনঃ
———
২৫-৩০ টন/হেক্টর। বর্তমান বাজারমূল্য ৪০০-৮০০ কেজি।
© ছাদবাগানে টবেও ক্যাপসিকাম লাগাতে পারেন।
® “কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। আপনার কোন জিজ্ঞাসা থাকলে কমেন্ট করুন।
যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
পুঠিয়া, রাজশাহী