কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
সম্প্রতি বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, ফেইসবুক, গণমাধ্যমে দেশে কফি চাষ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই জানতে চাচ্ছেন, কফি চাষ কিভাবে করা হয়? এর জন্য কেমন আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়? বাংলাদেশের কোথায় কফি চাষ করা হয় ইত্যাদি নানারকম প্রশ্ন।
© তাই, একজন সম্প্রসারণবিদ হিসেবে বিভিন্ন পেপার, আর্টিকেল ঘেঁটে কফি চাষ নিয়ে একটা লিখা দাড় করানোর চেষ্টা **।
© মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘কফি, কাজুবাদামসহ অপ্রচলিত ফসলের চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাতে কৃষক ও উদ্যোক্তাসহ যারা এগিয়ে আসবেন তাদেরকে উন্নত জাতের চারা সরবরাহ, উৎপাদনে পরামর্শ, কারিগরি ও প্রযুক্তিসহ সবক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া হবে।’ আসুন আজকে কফি চাষ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি………….
কফিঃ
——–
কফি (ইংরেজি: Coffee) বিশ্বব্যাপী খুবই জনপ্রিয় পানীয়। কফি গাছ ঝোপের মত হয়। Rubiaceae পরিবারভুক্ত কফি মাঝারি উচ্চতার চিরসবুজ প্রকৃতির গাছ। প্রায় ৭০টি দেশে এই ফলের গাছ জন্মে। সবুজ কফি বিশ্বের সব থেকে বেশি বিক্রীত কৃষিপণ্যের মধ্যে একটি।
কফির গুণাগুণঃ
————————-
কফিতে ক্যাফেইন নামক এক প্রকার উত্তেজক পদার্থ রয়েছে। ৮ আউন্স কফিতে প্রায় ১৩৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। কফির উপাদান ক্যাফেইনের জন্যে কফি মানুষের উপর উত্তেজক প্রভাব ফেলে ও উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এখন, চায়ের পর কফি বিশ্বের অত্যধিক জনপ্রিয় পানীয়।
বিশ্বে কফির অবস্থানঃ
——————————–
বিশ্বের মোট কফি উৎপাদনের ৪০ শতাংশ আসে ব্রাজিল থেকে। যার রফতানি মূল্য প্রায় ৮০ কোটি ডলার। ২০০০ সালের দিকে বিশ্বে ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন কফি উৎপন্ন হলেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন টনের ওপরে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর কফি দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে এ ফলের গাছ জন্মে। সবুজ কফি বিশ্বের সব থেকে বেশি বিক্রীত কৃষি পণ্যের মধ্যে একটি। বৃহত্তম কফি উৎপাদনকারী দেশগুলি হলেন: ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারত।
বাংলাদেশে কফি চাষের ইতিহাসঃ
————————————————
বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমংগলে স্টারলিং কোম্পানি জেমস ফিনলে সর্বপ্রথম ৫৬০ একর জায়গায় কফি বাগান গড়ে তোলেন। এরপর ১৯৯৯ সালে পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড কফি বাগান করার উদ্যোগ হাতে নেয়।
© বর্তমানে বাংলাদেশের বান্দরবন, কক্সবাজার, টাংগাইল, এমনকি নীলফামারীতেও কফি চাষ হচ্ছে যার মান অত্যন্ত ভালো। এছাড়াও বগুড়া,রংপুরে পরীক্ষকামূলকভাবে কফি গাছ লাগিয়ে পজিশনে রেজাল্ট পাওয়া গেছে। তাই, দেশের উত্তরাঞ্চলেও কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়া ও জলবায়ুঃ
================
ভূমির প্রকৃতিঃ
——————–
কফি চাষের জন্য পর্বতের ঢালু জমি আদর্শ। জলনিকাশী ব্যাবস্থা যুক্ত ৫০০ – ১৫০০ মিটার উচ্চতায় কফি গাছ ভালো জন্মায় অর্থাৎ পর্বতের উচ্চভূমি কফি চাষের উপযুক্ত ক্ষেত্র।
জলবায়ুঃ
————–
কফি চাষের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু উপযুক্ত।
উষ্ণতাঃ
————
মৃদু উষ্ণ আবহাওয়ায় বিশেষ করে ২০℃ – ৩০℃ উষ্ণতায় কফি চাষ ভালো হয়। তবে উচ্চভূমিতে ১৫℃ – ২৫℃ উষ্ণতাতে কফি চাষ ভালো হয়।
বৃষ্টিপাতঃ
————–
কফি চাষের জন্য বার্ষিক ১৫০-২০০ সেমি বৃষ্টিপাত দরকার তবে ফল পাকার সময় শুস্ক আবহাওয়া প্রয়োজন।
সামুদ্রিক বায়ু ও কুয়াশাঃ
———————————-
সামুদ্রিক আর্দ্রতা ও কুয়াশা কফি গাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তবে তুষারপাত ও জল কফি চাষের পক্ষে ক্ষতিকর।
ছায়া প্রদানকারী গাছঃ
——————————-
তীব্র সূর্যালোক, প্রবল বাতাস, তুহিন প্রভৃতির হাত থেকে কফি গাছকে বাঁচানোর জন্য কফি-বাগিচার মধ্যে সিলভার, ওক ইত্যাদি ছায়া প্রদানকারী গাছ লাগানো দরকার।
উৎপাদন কলাকৌশলঃ
================
রোপণ সময়ঃ
——————
অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় হলো কফির মওসুম। এই সময় কফির উপযোগী স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও পরিমিত উষ্ণতা বজায় থাকে। এতে গাছ অল্প সময়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়, প্রচুর ফল ধরে ও ফলগুলো যথেষ্ট পুষ্ট হয়।
রোপণ দূরত্বঃ
——————
বাণিজ্যিক চাষের জন্য প্রতি হেক্টরে ৩০০০-৫০০০ কফি গাছ রোপন করা হয়। সারি থেকে সারির দুরত্ব ৫-৭ ফুট ও গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৫-৭ ফুট রাখতে হবে।
রোপণ কৌশলঃ
———————
কফির চারা রোপনের জন্য ১.৫ X১.৫ X১.৫ ঘন ফুট গর্ত করতে হবে। পর্যাপ্ত কম্পোস্ট সার দিতে হবে। মাটির পিএইচ ৬.১-৬.২ বজায় রাখতে হবে। বৃদ্ধি পর্যায়ে প্রতি হেক্টরে ৫০ কেজি নাইট্রোজেন,৫০ ফসফরাস এবং ৫০ পটাশ প্রয়োজন।
প্রুনিংঃ
——–
কফি গাছ ৪০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বেড়ে উঠতে পারে, তবে ফসল তোলা সহজ করার জন্য চাষ করা গাছগুলি ৬-৯ ফুট পর্যন্ত রেখে ছাঁটাই করা হয়, যাতে গাছের ফল হাতের নাগালে থাকে।
ফল সংগ্রহঃ
——————-
প্রথম বছরে, গাছের কোনও ফলন দেওয়া উচিত নয়। দ্বিতীয় বছরে, কম ফলন অনুমোদিত, গাছ প্রতি ১.৫ কেজি বেশি ফল রাখা ঠিক নয়। তৃতীয় বছর থেকে উৎপাদন শুরু হয়। লালচে কমলা রং ধারণ করলে কফি ফল হাত দিয়ে তুলতে হয়।
বাংলাদেশের পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বছরে দুইবার গাছ থেকে গোটা সংগ্রহ করা সম্ভব। এক মৌসুমে একটি গাছ থেকে ০৩ কেজির মত কফির বীজ পাওয়া যায়। একটি কফি গাছ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে ফল পাওয়া যায়।
কফি বীজ প্রসেসিংঃ
——————————
বাণিজ্যিক ভাবে বাংলাদেশে শুধুমাত্র নীলফামারি জেলাতে একটা কফি প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি সদ্য চালু করা হয়েছে। তবে ঘরেই কফির বিনগুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয় কফি। ০৩ কেজি বীজ গুড়া করে ০১ কেজির মত গুড়ো পাওয়া যায়।
প্রতি কেজি কফির গুড়ো প্রায় দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়।
অন্যান্য বাই-প্রোডাক্টঃ
——————————
কফি গাছ থেকে শুধুমাত্র পানীয়ই নয়। কফি গাছের অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে মধু ও শ্যাম্পু তৈরি করা যাবে। একটি কফি গাছের ফুল থেকে প্রতিবারে একশ’ গ্রাম মধু সংগ্রহ করা সম্ভব। পাশাপাশি ওই গাছের উপকরণকে প্রক্রিয়া করে উন্নতমানের ‘শ্যাম্পু’ তৈরি করা যাবে।
আর্থিক হিসাবঃ
——————–
০১ বিঘায় ৩০০-৪০০ টি গাছ লাগানো যায়, আর যদি প্রতি গাছ থেকে ০৩ কেজি করে ফল সংগ্রহ করা যায়। সে হিসেবে ৩০০ x ০৩ কেজি = ৯০০ কেজি ফল পাওয়া যাবে। প্রতি কেজি ফলের দাম সর্বনিম্ন দাম ৩০০/- কেজি ধরলেও ৯০০ x ৩০০/- = ২৭,০০০/- টাকা পাওয়া যায়।
আবার, প্রতি ০৩ কেজি বীজে ০১ কেজি গুড়া হয়, সে হিসেবে ৯০০ কেজি থেকে ৩০০ কেজি গুড়া পাওয়া যাবে। সর্বনিম্ন দাম প্রতি কেজি গুড়া ১০০০/- কেজি ধরলে ৩০০ x ১০০০/- = ৩,০০,০০০/- টাকা পাওয়া যাবে।
অথচ খরচ অতি সামান্য হয় কফি চাষে।
© এখন বাংলাদেশে কফি একটি সম্ভাবনাময় ফসল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই কফি চাষ সসম্প্রসারণের উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। আশা করা যায়, কার্যকর উদ্যোগ নিলে ধান, পাট ও অন্যান্য ফসল চাষের পাশাপাশি কফি চাষ করে তা রফতানি করা সম্ভব বলে মনে করেন চাষিরা ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা। এতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব।
** ( তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা, ব্লগ ও ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লিখা ও রিপোর্ট)
® লিখার ব্যাপারে যে কোন সংশোধনী সাদরে গ্রহণযোগ্য।
যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
পুঠিয়া, রাজশাহী