" কৃষি অন্বেষণ"পর্ব-১১#বিষয়ঃ বিনা চাষে রসুন আবাদ" কৃষি অন্বেষণ"পর্ব-১১#বিষয়ঃ বিনা চাষে রসুন আবাদ

কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম

রসুন (Allium sativum) Alliaceae পরিবারভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ কন্দ জাতীয় মসলা ফসল। বাংলাদেশে প্রতি বছর রসুনের চাহিদা ৩.৫ লক্ষ মেট্রিক টন কিন্তু উৎপাদন হয় মাত্র ৩.২৫ লক্ষ মেট্রিক টন। এ থেকে বোঝা যায়, চাহিদার তুলনায় রসুন উৎপাদন কম হয় ফলে প্রতি বছর বিদেশ থেকে রসুন আমদানি করতে হয়। তাই আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য উন্নত জাত ব্যবহার ও উন্নত কলাকৌশল প্রয়োগ করে রসুনের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আজ আমরা এমনই একটি কৌশল সম্পর্কে জানবো, যার নাম ” বিনা চাষে রসুন আবাদ”
★উৎপাদন পদ্ধতি★
—————————-
আমন ধান তোলার পর জমি ভিজা থাকা অবস্স্তায় মাঠ চাষ না করেই রসুনের কোয়া রোপন করা হয়। সাধারণত বিল অঞ্চলে বন্যার কারণে পলি জমে থাকা পলি মাটিতে বিনা চাষে রসুন উৎপাদন অত্যন্ত লাভজনক। নাটোরের চলন বিল এলাকায় এ পদ্ধতিতে বেশি রসুন চাষাবাদ হয়।
★জলবায়ু ও মাটি★
—————————-
রসুন চাষের জন্য শীতকালীন মৃদু জলবায়ু প্রয়োজন। শুষ্ক আবহাওয়া ও দিবস দৈর্ঘ্য বেশি হলে রসুনের কোয়ার উৎপাদন ভাল হয়। বেশি গরম ও প্রচন্ড শীত রসুন সহ্য করতে পারে না। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ও সহজেই গুড়া হয় এমন দোআশ মাটি রসুন চাষের উপযোগী। এটেল দোআশ মাটিতেও রসুন চাষ করা যায়। অম্ল মাটিতে রসুনের কোয়া ভাল হয় না। রসুন গাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য ঠান্ডা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া এবং বাল্ব পরিপক্ব হওয়ার জন্য বড় দিন ও শুষ্ক আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়।
★জাত★
————
বারি রসুন-১ (ভাইরাস প্রতিরোধী), বারি রসুন-২ (জীবনকাল কম), বারি রসুন-৩ (ফলন বেশি), বারি রসুন-৪ জাত আছে।
© তবে স্থানীয় জাত গুলোই কৃষক ভাইয়েরা বেশি চাষ করে থাকে। এর মধ্যে ইটালী, আমনী ও আউসী প্রধান ।
★রোপণ সময়★
———————–
মধ্য অক্টোবর থেকে শেষ অক্টোবরের মধ্যে রোপণ করা উত্তম। এর পর রোপণ করলে উৎপাদন কমে যাবে।
★বংশ বিস্তার★
———————
এদেশে রসুনের বীজ হয় না। শুল্ক কন্দের কোয়ার সাহায্যে বংশবিস্তার করা হয় এবং প্রতিটি শল্ক কন্দে ১০-১৫ টি কোয়া থাকে ও সবল রসুনের কোয়া রোপণ করা হয়।
★বীজ হার★
——————
বিনা চাষে হেক্টর প্রতি ৪০০-৫০০ কেজি কোয়া বা বীজ রসুনের প্রয়োজন হয়। প্রতি কেজি রসুন থেকে কম বেশি ১৬০০ টি কোয়া বা বীজ রসুন পাওয়া যায়।
★রোপন পদ্ধতি★
————————
কোন চাষের দরকার নেই। জমিতে পানি থাকবেনা, তবে ভিজা থাকবে। কোয়াগুলো হাতের দু’ আঙ্গুলে ধরে ১০ সে. মি. দুরত্বে সারি করে প্রতি সারিতে ১০ সে.মি. দুরে দুরে ৩-৪ সে.মি. মাটির গভীরে রোপন করতে হবে। মাঝারী থেকে বড় সাইজের কোয়া রোপনের জন্য ব্যবহার করতে হবে। রোপনের পর পর সমস্ত জমি খড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। প্রায় ৭ সে.মি. পুরু খড়ের ঢাকনা হতে হবে।
★সার প্রয়োগ ★
———————-
পলি মিশ্রিতে বিল এলাকায় বিনা চাষে রসুনের জমিতে হেক্টর প্রতি নিম্নরুপ সার প্রয়োগ করতে হবে।
© ইউরিয়া- ২১৭ কেজি ( তিন ভাগে ভাগ করে ০১ ভাগ বপণের সময়, ২য় ভাগ কোয়া রোপনের ৩০ দিন পর, ৩য় ভাগ কোয়া রোপনের ৬০ দিন পর)
© টিএসপি ২৭০ কেজি, এমপি ৩৩৫ কেজি, জিপসাম ১২৫ কেজি, জিংক সালফেট ২৫ কেজি,
বোরাক্স ১০ কেজি
® ইউরিয়ার ১ম কিস্তি ও বাকি সকল সার বীজ বপণের সময় প্রয়োগ করতে হয়।
★অন্তর্বতীকালীন পরিচর্যা ★
—————————————-
রোপনের এক মাস পরে খড়ের ঢাকনার ভিতর দিয়ে উঠা আগাছা গুলো সাবধানে তুলে ফেলতে হবে। উপরি সার প্রয়োগের পর পর হালকা সেচ দিতে হবে। এছাড়াও খড়ের ভিতর পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় মাটিতে রস অতিরিক্ত কমে গেছে তা হলে হালকা সেচ দিতে হবে। অতিরিক্ত পানি যাতে দাড়িয়ে থাকতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ও প্রয়োজনে জমির পানি বের করার জন্য নালা রাখতে হবে। ফসল সংগ্রহের এক মাস পূর্বে সেচ প্রদান সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হবে। ফসল উত্তোলনের ২০-২৫ দিন পূর্বে সেচ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
★ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ★
—————————————-
রসুন গাছের পাতা হলুদ থেকে বাদামী রং ধারণ করে ভেঙ্গে পড়লে উত্তোলন উপযোগী হয়। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে রসুন তোলা হয়। মাঠ থেকে তোলার পর ২-৩ দিন অল্প রোদে শুকিয়ে রসুন সংরক্ষণ করতে হয়। রসুন সংগ্রহের পর মরা পাতা ছেটে ভাল ভাবে ৪-৫ দিন শুকালে এর গলা সংকুচিত হয় এবং বহির্ভাগ শুকিয়ে পাতলা ও শক্ত আবরণে পরিণত হয়। এ পরিবর্তনকে কিউরিং বলা হয়। কিউরিং ভাল হলে রসুন দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। করাত গুড়ার ধোঁয়া লাগালে রসুন ৮-১০ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
★ফলন★
————-
হেক্টর প্রতি ৬.০-১৪.১২ টন পর্যন্ত হতে পারে।
★পোকামাকড় ও রোগবালাই★
——————————————-
রসুনে পোকা মাকড় ও রোগ বালাই এর আক্রমণ খুবই কম হয়।
© রসুনে মাঝে মধ্যে থ্রিপস পোকার আক্রমণ দেখা যায়।থ্রিপস পাতার রস চুষে খায় ফলে পাতায় প্রথমে সাদা লম্বাটে দাগ দেখা যায় এবং আগা থেকে বাদামী হয়এ শুকিয়ে যায় এবং পাতা মরে নলের মত আকার ধারণ করে। প্রতিকারের জন্য ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি অথবা ডাওমেক্রন অথবা মেটাসিসটক্স ২৫ ইসি গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ০২ মিলি হারে মিশিয়ে প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করতে পারেন।
© রোগের মধ্যে প্রধানত গোড়া পঁচা রোগ, পার্পেল ব্লচ ও স্মাট রোগ হয়। গাছের বয়স ৩০ দিন হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভরাল ও ২ গ্রাম রিডোমিল একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এর পর ১৫ দিন পর পর উক্ত ঔষধ পরবর্তী ২ মাস ধরে ব্যবহার করতে হবে।
© পটাশিয়ামের অভাব হলেও ডগা শুকিয়ে যেতে পারে, তাই বিঘা প্রতি ০৫ কেজি পটাস দেওয়া যেতে পারে। তবে বিনা চাষে রসুন আবাদ করলে খড় পচে প্রচুর পটাশ সার মাটিতে যোগ হওয়ায় রসুনের ডগা খুবই কম মরে, তাই আলাদাভাবে পটাশ সার দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।

যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
পুঠিয়া, রাজশাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *