" কৃষি অন্বেষণ"পর্ব-১২#বিষয়ঃ ধানে ব্যাকটেরিয়া জনিত নতুন রোগ এর প্রাদুর্ভাবের আশংকা" কৃষি অন্বেষণ"পর্ব-১২#বিষয়ঃ ধানে ব্যাকটেরিয়া জনিত নতুন রোগ এর প্রাদুর্ভাবের আশংকা

কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবঃ ধানে ব্যাকটেরিয়া জনিত নতুন রোগ [ Bacterial Panicle Blight (BPB) ] এর প্রাদুর্ভাবের আশংকা
=================================
জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিটি সকাল, প্রতিটি নতুন আশংকা! ভোরের শুভ্র সকাল এক অজানা শংকায় নিমিষেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। মানবজীবনে যেমন আসছে নোবেল করোনা ভাইরাসের মত জমদূত, তেমনি জীবন ধারনের প্রধান উৎস খাদ্যশস্য এর উপর পড়তেছে জলবায়ু পরিবর্তনের নেকড়ে থাবা। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিশ্ব যখন SDG এর আলোকে দ্বিগুণ খাদ্য উৎপাদনের পরিকল্পনার ছক এঁকে নিত্য নতুন পসরা সাজিয়ে চলেছে, ঠিক তখনই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল গ্রাস নিত্য নতুন বালাই এর উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। আর খড় পড়া গরু, সিঁদুর দেখলে ভয় পাবার মত ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে কৃষি সংশ্লিষ্ট গবেষক,সম্প্রসারণবিদ সর্বোপরি জাতির অন্নের যোগানদাতা কৃষক সমাজকে।
© আজকের এ পর্ব ঠিক এমনই এক নতুন রোগ নিয়ে আলোচনা করছি। আর সেই রোগের নাম হচ্ছে ব্যাকটেরিয়াল প্যানিক্যাল ব্লাইট [ Bacterial Panicle Blight (BPB) ]
দায়ী ব্যাকটেরিয়া(Causal Organism)
===========================
Burkholderia glumae and B. gladioli
——————- ———— — ———–
এই দুইটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই BPB রোগ ছড়ায়।
© ১৯৫৫ সালে জাপানে প্রথম BPB রোগ দেখা যায়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন ও উত্তর আমেরিকার প্রায় ১৮ টির বেশি দেশে এ-ই রোগের আক্রমণ দেখা গেছে। ভারতে ২০১৫ ও চায়নাতে ২০১৮ সালে BPB দেখা যায়।
© এই রোগের আক্রমণে ধানের প্রায় ৭০% নষ্ট হয়ে যেতে পারে। BPB এর কারণে জাপানে ২০১৩ সালে ৬৯,০০০ হেক্টর ও ২০১৫ সালে ৩০,০০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে আমেরিকার টেক্সাস অংগরাজ্যে BPB এর কারণে ব্যাপক ফসলহানি হয়।
রোগটি দেখতে কেমন বা লক্ষণ কেমন?
============================
চিটা হয়ে শিষ বের হওয়া (unfilled and aborted grain), অসম্পূর্ণ পরাগায়ন, বন্ধ্যাত্ব পুষ্পায়ন (floret sterility) , খোল পঁচা ( Sheath rot), চারা ঝলসানো ( seedling blight) লক্ষণগুলো দেখা যায়। তবে, অসম্পূর্ণ দানা বা চিটা হয়ে শিষ বের হওয়াই প্রধান লক্ষণ।
© মাঠে বিক্ষিপ্তভাবে গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির ভাবে একটি বা একাধিক গাছে একসাথে দেখা যেতে পারে
কখন হয় বা অনুকুল পরিবেশঃ
=====================
সাধারণত উচ্চতাপমাত্রায় (৩৫ -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও উচ্চ আপেক্ষিক আদ্রতায় ( ৯০%) (high temperature and high relative humidity) এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় (Nandakumar et. al)।
© ফুল ফোটার সময় সকাল ১০-১২ টার মধ্যে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করলেও এ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। তবে তাপমাত্রাজনিত কারণে চিটা হবার লক্ষণের সাথে এ রোগের সামান্য পার্থক্য আছে।
© বীজ বাহিত বা রোগাক্রান্ত বীজ, মাটি, সেচের পানি প্রাইমারী বাহক।
© এছাড়া হঠাৎ বৃষ্টিপাত (rain splash) এবং রোগাক্রান্ত শিষের সংস্পর্শ (panicle contact) সেকেন্ডারি বাহক হিসেবে কাজ করে।
© অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করার ফলে এ রোগ হয়। Arkansas এর এক গবেষণায় দেখা গেছে স্বাভাবিক ডোজ (১৬৮ কেজি/হে.) এর তুলনায় হেক্টর প্রতি ২৪৭ কেজি নাইট্রোজেন ব্যবহার করায় প্রায় ১.৬ গুণ এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে।
কোন উপাদান এই রোগ ছড়ায়?
======================
BPB এর জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলো হলুদ পিগমেন্টেড বিষাক্ত টক্সোফ্লাভিন উপাদান নিঃসৃত করে ফলে এই রোগ ছড়ায়।
অন্যান্য Abiotic factor এবং BPB এর লক্ষণের মধ্যে পার্থক্য করার উপায়ঃ
==================================
উচ্চ তাপমাত্রাসহ বিভিন্ন কারণে অসম্পূর্ণ পরাগায়নসহ ধানে চিটা হতে পারে। BPB তেও একই লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারা BPB কে পৃথক করা যায়….
১) সম্পূর্ণ ধান চিটা হয়ে বের হবে, একটিও পুষ্ট দানা থাকবে না। অন্যদিকে অন্যান্য abiotic factors এর কারণে কিছু কিছু দানা পুষ্ট থাকে।
২) প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত শিষের নিচের দিক থেকে হালকা সবুজ থেকে হালকা বাদামি রং এবং লালচে বাদামি কিনারা (reddish brown margin) দাগ থাকে, যা পরবর্তীতে খড়ের রং (straw colored) হয়ে যায়। তবে ব্যাপক স্পোর থাকলে শিষের spikelet কালো হয়ে যায়।
৩) শিষের শাখা বা মূল কান্ড ( branches or rachis) নিচের দিকে সবুজ থাকে, এমনকি শিষ শুকিয়ে গেলেও এইটা সবুজ, বড়জোড় হালকা বিবর্ণ হয় ( tan)।
৪) যদি খোলে হয়, রৈখিক দাগ ( linear lession) দেখা যায়। দাগের লালচে-বাদামি কিনারা সহ খয়েরি শুকনো কেন্দ্র দেখা যায় ( reddish brown border and a gray and narcotic center).
৫) পাতায় BPB দেখা দিলে, দাগগুলো গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির হবে, চারিদিকে লালচে বাদামী সীমানা ও খয়েরি কেন্দ্র থাকবে ( lessions are circular to oval with a smooth reddish-brown border and a gray or straw colored center).
৬) যদি চারা অবস্থায় হয়, তাহলে চারা ঝলসানো লক্ষণ দেখা দিবে (seedling blight).
BPB দমনে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাঃ
===============================
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যেই BPB প্রতিরোধে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ( IPM) পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সেগুলো হলো—–
১) বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি ( Exclusion) ঃ
—————————————————————
যেহেতু BPB বীজ বাহিত (seed borne) রোগ, তাই কোনভাবেই বীজ পরীক্ষা ছাড়া বাহির থেকে কোন বীজ দেশের ভিতর আসতে না পারে, এই জন্য plant quarantine নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা।
২) জেনেটিক রেজিস্ট্যান্স (Genetic resistance)ঃ
————————————————————-
BPB প্রতিরোধী বা সহনশীল জাতের ব্যবহার।
জাপান ইতোমধ্যেই ০৯ টি BPB genetic resistance ইনব্রিড জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
© আমেরিকায় কিছু হাইব্রিড cultivars XL723, XL753, XL760, CLXL729, CLXL 730, and CLXL745 উদ্ভাবন করেছে যা ইনব্রিড জাতের তুলনায় বেশি BPB resistance.
৩) আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণঃ
—————————————————–
বীজ শোধন করেও BPB নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
© ৬৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ০৬ দিন শুষ্ক তাপে (dry heat) বীজ শোধন করলে BPB নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
© অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকেটিরিসাইড অক্সোলিনিক এসিড যেমন স্টার্নার দিয়েও বীজ শোধন করলে BPB হয় না। (antibiotic bactericide oxolinic acid (Starner®)
©অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার না করা।
৪) জৈবিক নিয়ন্ত্রণঃ
————————–
antagonistic Pseudomonas sp. strain ব্যবহার করে BPB নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৫) রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃ
——————————-
© প্রতি মৌসূমে অক্সোলিনিক এসিড (Oxolinic acid) যেমন স্টার্নার ( Starner) কমপক্ষে ০৩ বার স্প্রে করা ৷
© কপার এবং কপারযুক্ত ব্যাকটেরিয়াসাইড ব্যবহার করা
যেমন Kocide ® 2000 (53.8% copper hydroxide), Kocide® 3000 (46.1% copper hydroxide), Previsto® (5% copper hydroxide), Badge® SC (15.4% copper hydroxide plus 16.8% copper oxychloride), Badge® X2 (21.5% copper hydroxide plus 23.8% copper oxychloride), and Top Cop® (8.4% tric basic copper sulfate).
© এছাড়াও কপারযুক্ত অন্যান্য bacteriacide যেমন, কাসুগামাইসিন(kasugamycin), প্রোবেনাজল (probenazole), এবং পাইরোকুইলোন ( pyroquilone) গ্রুপের বালাইনাশক ব্যবহার করেও BPB নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
BPB ও বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটঃ
=====================
বাংলাদেশে BPB দেখা গেছে কিনা, এ ব্যাপারে এখনই সুস্পষ্ট মতামত প্রদান করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ দেশের বিভিন্ন জায়গার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করবেন বলে জানা গেছে।
® তবে, এরকম লক্ষণ দেখা দিলে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে কৃষি সম্প্রসারণবিদগণ—–
★ আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলুন (কম পরিমাণে হয়)।
★ ব্যাকটেরিসাইড- (ব্যাকটোবান, ব্যাকট্রল, টিমসেন ইত্যাদি) স্প্রে করুন।
★ সুষম সার ব্যবহার করুন।
★ 60g MoP + 2.5 g chilleted Zn + 60 g theovit ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে spray করুন।
তথ্যসূত্রঃ
======
Sustainable Strategies for Managing Bacterial Panicle Blight in Rice
By Xin-Gen Zho
Published: February 26th 2019
DOI: 10.5772/intechopen.84882
****বি.দ্র.ঃ লিখাটি সম্পূর্ণ একাডেমিক উদ্দেশ্যে। তথ্য ও ছবি আন্তর্জাতিক জার্নাল এর রেফারেন্স থেকে নেওয়া। কোন সংশোধনী সাদরে গ্রহণযোগ্য।

যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
পুঠিয়া, রাজশাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *