" কৃষি অন্বেষণ"পর্ব-[১৫] বিষয়ঃ পরিবেশ রক্ষায় সবজি ক্ষেতে জৈবিকভাবে পোকা দমন ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন" কৃষি অন্বেষণ"পর্ব-[১৫] বিষয়ঃ পরিবেশ রক্ষায় সবজি ক্ষেতে জৈবিকভাবে পোকা দমন ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন

কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম

সবজি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য দৈনিক ২২০ গ্রাম (সূত্রঃ এফএও) সবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের জনগণ মাত্র ১২৫ গ্রাম সবজি খেয়ে থাকে। আবার যতটুকু সবজি খেয়ে থাকে, তা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কিনা, এ নিয়ে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন।
© বাংলাদেশে প্রচলিত-অপ্রচলিত প্রায় ৯০ ধরনের সবজি থাকলেও ৩০-৩৫ টি সবজিকে প্রধান হিসেবে ধরা হয়। দেশের শতকরা ৯.৩৮ ভাগ জমিতে সবজি আবাদ হয়। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩য় অবস্থানে রয়েছে। দিন দিন সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এইটা যেমন আশার দিক একদিকে, এই সবজি নিরাপদ ও বিষমুক্ত ভাবে উৎপাদিত করা এখন সময়ের দাবি।
© প্রচলিত সবজির মধ্যে বেগুন, শিম, টমেটো, পেঁপে, ফুলকপি, বাধাকপি, পটল, করলা, ঝিংগা, লাউ,কুমড়া জাতীয় সবজিই প্রধান। সবজির চারার কান্ড সাধারণত রসালো ও ফুল আকর্ষণীয় হওয়ায়, পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্যান্য ফসলের তুলনায় তুলনামূলক বেশি হয়। আর এই পোকামাকড় দমনে আমাদের কৃষকরা অনেকটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশক স্প্রে করে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
© অন্যদিকে পরিবশের জন্যও তা হুমকিস্বরূপ। মাত্রাতিরিক্ত অপরিমিত বালাইনশাক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, উপকারী অণুজীব ও পোকামাকড় মারা যাচ্ছে, পানি দূষিত হচ্ছে, পরিবেশের জীববৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে ৷ তাই, টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও নিরাপদ পুষ্টি সরবরাহের জন্য সবজি উতপাদনে পরিবেশ বান্ধব তথা আইপিএম পদ্ধিতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা নেওয়া প্রয়োজন।
® আজ আমরা পরিবেশ রক্ষায় সবজি ক্ষেতে জৈবিকভাবে পোকা দমন ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
পরিচ্ছন্ন চাষাবাদঃ
==============
প্রথমেই নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও পোকা দমনে প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ কৌশল অনুসরণ অর্থাৎ সবজির ক্ষেত পরিস্কার রাখা, মরা ডাল,পাতা সংগ্রহ করে নিরাপদ স্থানে গর্ত করে ধ্বংস করা বা পুড়িয়ে ফেলা, আগাছা পরিস্কার করা, জমিতে আলো বাতাস প্রবেশের জন্য অধিক ঘন করে চারা না লাগিয়ে সঠিক দূরত্বে চারা লাগানো, বিকল্প পোষক ( যেখানে পোকামাকড় লুকিয়ে আশ্রয় নেয়) ধ্বংস করা, একই জমিতে একই ফসল ২-৩ বছরের বেশি আবাদ না করে অন্য ফসল মাঝখানে ০১ বছরের জন্য অন্য গোত্রের ফসল লাগানো, একই জমিতে একই ধরনের যন্ত্র দিয়ে একই গভীরতায় বার বার চাষ না করে ভিন্ন ভিন্ন গভীরতায় প্রতিবার চাষ করে নিচের শক্ত লেয়ার ( Plough pan) ভেংগে দেওয়া, অধিক ঘন ডাল পালা ছেটে দেওয়া ইত্যাদি পদ্ধতি অনুসরণ করা।
মাটি শোধনঃ
=========
সবজি লাগানোর পূর্বে মাটি শোধন করে নেওয়া, এক্ষেত্রে শতক প্রতি ৩ কেজি চুন প্রয়োগ করা, ফসল সংগ্রহের পর শিকড়সহ গাছ তুলে ফেলা এবং আগুনে পুড়িয়ে মাটি শোধন করা (৩-৪ বছর পর পর ০১ বার)।
বীজ শোধনঃ
=========
বীজ শোধন নিম পাতার রস বা রসুন বাটার রস অথবা বাজারের প্রচলিত কার্বক্সিল ও থিরাম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন প্রোভাক্স ( প্রতি কেজি বীজে ২.০০-২.৫০ গ্রাম হারে) দিয়ে বীজ শোধন করে বপণ করা।
ভাল বীজ ব্যবহারঃ
=============
সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা।
বালাইসহনশীল জাত ব্যবহারঃ
====================
স্থানীয় কৃষি অফিসের সাথে যোগাযোগ করে বালাইসহনশীল জাতের তথ্য জেনে যে অনুযায়ী জাত ব্যবহার করা। যেমন বিটি বেগুন।
জৈব সার প্রয়োগঃ
============
মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করা, এক্ষেত্রে গাছ প্রতি ০১ কেজি কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পার্চিংঃ
=====
জমিতে পাখি বসানোর ব্যবস্থা করা।
প্লাবন সেচ প্রয়োগঃ
=============
মাটিতে বসবাসকারী পোকার পুত্তলী ধ্বংস করার জন্য মাঝে মাঝে প্লাবন সেচ দেওয়া৷
ফাঁদ ব্যবহারঃ
=========
জাব পোকাসহ ছোট ছোট পোকা দমনে বিঘা প্রতি ২৫-৩০ টি হলুদ আঠালো/সাদা আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা।
© সবজি ও ফলের মাছি পোকা দমনে চারা রোপণের ১০-১৫ দিনের মধ্যে ফসলভেদে বিঘা প্রতি ১০-১৫ সেক্স ফেরোমন ফাদ স্থাপন করা।
মালচিংঃ
======
মালচিং পদ্ধতির অনুসরণ করা, এক্ষেত্রে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্লাস্টিকের মালচিং ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপকারী পোকামাকড় অবমুক্তকরণঃ
==========================
বিভিন্ন উপকারী পোকা যেমন বোলতা জাতীয় ট্রাইকোগ্রামা, ব্রাকন, কোটেসিয়া, রেড লেস উইং, রেড বাগ, পেন্টাটোমিড বাগ, টেট্রাসটিকাস জমিতে ছেড়ে দিলে ক্ষতিকর পোকার ডিম, কীড়া পুত্তলী, মথ খেয়ে ফসলকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে বাজারে এসব উপকারী পোকা কিনতে পাওয়া যায়।
হাঁস ছেড়ে দেওয়াঃ
=============
পোকার লার্ভা (কীড়া) দমনে জমিতে বিশেষ করে বেগুনের জমিতে হাঁস ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
আইল ফসল চাষঃ
============
উপকারী পোকা মাকড়ের আবাসস্থল সৃষ্টির জন্য আইল ফসল হিসেবে শিম,বরবটি,করলা ইত্যাদি লাগানো।
ছাই ছিটানোঃ
=========
মাঝে মাঝে জমিতে পরিমিত পরিমাণে ছাই ছিটিয়ে পোকা দমন করা যায়।
জৈব বালাইনাশক ব্যবহারঃ
===================
জৈব বালাইনাশক যেমন নিম পাতার রস, নিম বীজের গুড়োর মিশ্রণ, রসুন ও পেয়াজ বাটার রস, নিশিন্দার রস ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রাকৃতিক উপায়ে পোকা দমন করা যায়। তাছাড়াও বর্তমানে বাজারে প্রায় ৩২ টি জৈব বালাইনাশক পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলো ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোকামাকড় দমন করা যায়। এসব জৈব বালাইনাশকের কোন সাইড ইফেক্ট নাই৷
বালাইনাশকের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারঃ
========================
পোকার আক্রমণ অর্থনৈতিক ক্ষতি সীমা অতিক্রম করলে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিন। তাদের পরামর্শ মোতাবেক সঠিক ওষুধ (বালাইনাশক), সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে স্প্রে করুন।
বালাইনাশকের অপেক্ষামান সময় মেনে চলাঃ
===============================
বালাইনাশক স্প্রে করার পর অপেক্ষা মান সময় অর্থাৎ কত দিন পর ফসল সংগ্রহ করবেন, সেই নির্দেশনা মেনে চলা। এতে করে মানব স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত থাকবে।
পরিস্কার করে বাজারজাতকরনঃ
======================
সবজি সংগ্রহের পর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে পানি ঝেড়ে নিয়ে বাজারজাত করা উচিত।
®® সর্বোপরি পোকা দমনে নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখা। প্রবাদ আছে, কৃষকের পায়ের ধুলাই উত্তম ওষুধ।

যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
পুঠিয়া, রাজশাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *