" কৃষি অন্বেষণ"পর্ব-১৯#বিষয়ঃ সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারে মিমিক টিপস" কৃষি অন্বেষণ"পর্ব-১৯#বিষয়ঃ সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারে মিমিক টিপস

কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে সবজি ক্ষেতে ও ফল গাছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার এখন অত্যন্ত জনপ্রিয়। পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি হিসেবে দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফেরোমন ফাঁদ যেভাবে কাজ করে
========================
পুরুষ পোকাকে প্রজননকার্যে কাছে আকৃষ্ট করার জন্য স্ত্রী পোকা একধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, যা সেক্স ফেরোমেন নামে পরিচিত। ফাঁদে ব্যবহৃত টোপটিতে স্ত্রী পোকার নিসৃত সেক্স ফেরোমেন কৃত্রিমভাবে বেশ কয়েক গুন বৃদ্ধি করে দেয়া থাকে যাতে আকৃষ্ট হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষপোকা বক্সের ভিতরে প্রবেশ করে। এভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পোকা মারার মাধ্যমে কীড়া পোকার বংশ বৃদ্ধি বন্ধ করার মাধ্যমে পোকা দমন করা হয়।
🚩 তবে কেউ কেউ অভিযোগ করে বলে, ফেরোমন ফাঁদ কাজ করে না, পোকা মরে না। ফাঁদ দেবার পরও সবজির ডগায় বা ফলে পোকা দেখা যায়।
আসলে কি তাই!!! না আমাদের ব্যবহার পদ্ধতিতে কোন ত্রুটি আছে অথবা ফসলের যে সময়ে ফাঁদ স্থাপন করা উচিত, সে সময়ে না করে অন্য সময়ে করছি, অথবা যে দূরত্বে স্থাপন করা উচিত সেইটা অনুসরণ করছি কিনা, যে উচ্চতায় স্থাপন করার কথা সেইটা করছি কিনা অথবা যে ফসলের জন্য যে লিউর ব্যবহার করতে হয়, সেইটাই আমরা করছি কিনা ইত্যাদি আরো কিছু বিষয়ে আমরা সতর্ক থাকছি কিনা এ বিষয়ে আমরা সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করবো।
এইজন্য আজকের পর্বের নাম দিয়েছি “সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারে মিমিক টিপস” যা অনুকরণ করলে ফাঁদ ব্যবহারের কার্যকরীতা শতভাগ না হলেও ৯০% কার্যকরীতা বাড়বে বলে বিশ্বাস করি।
আসুন এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যাক———-
বাজারে প্রচলিত ফেরোমন ফাঁদঃ
======================
১) ব্যাকটো ডিঃ
==========
আম, পেয়ারা, কমলা, কুল ইত্যাদি ফলের মাছি পোকা দমনে ব্যবহার করা হয়।
© প্রতি ২.৫ শতকে ০১ টি ট্রাপ ব্যবহার করলেই হয়।
© ফল মার্বেল আকৃতি হবার সাথে সাথে ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। কারণ মাছি পোকা কচি ফলে ডিম পাড়ে। ফলের ত্বক শক্ত হয়ে যাবার পর ফাঁদ স্থাপন করলে কার্যকরীতা কমে যায়।
২) কিউ-ফেরোলিউরঃ
===============
কুমড়ো জাতীয় ফসল (লাউ, মিষ্টিকুমড়ো, চালকুমড়ো, শশা, ঝিঙ্গে, করলা, কাকরোল, তরমুজ, চিচিঙ্গা, পটল ইত্যাদি) এর মাছি পোকা দমনে ব্যবহার করা হয়।
© প্রতি ২.৫ শতকে ০১ টি ট্রাপ ব্যবহার করলেই হয়।
© চারা লাগানোর ০১ সপ্তাহের মধ্যে ট্রাপ স্থাপন করতে হবে অর্থাৎ ফুল ফোটার আগেই স্থাপন করতে হবে, কারণ মাছি পোকা পাপড়ির ভিতরের দিকে বৃন্তে ডিম পাড়ে।
৩) স্পোডোলিউর:
============
ফুলকপি, বাঁধাকপি, তরমুজ, কচুর লেদা পোকা ও টমেটোর ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনে ব্যবহার করা হয়।
© প্রতি ০৬ শতকে ০১ টি ট্রাপ ব্যবহার করতে হয়।
© চারা লাগানোর ০১ সপ্তাহের মধ্যে ট্রাপ স্থাপন করতে হবে।
© তবে কচুর ক্ষেত্রে লাগানোর ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে ফাদ বসাতে হবে।
৪) বিএসএফবি লিউরঃ
================
বেগুনের মাজরা পোকা (ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা) দমনে ব্যবহার করা হয়।
© প্রতি ২.৫ শতকে ০১ টি ট্রাপ ব্যবহার করলেই হয়। তবে বিঘাতে ১৩- ১৫ টি ব্যবহার করলে ভালো।
© চারা লাগানোর ০১ সপ্তাহের মধ্যে ট্রাপ স্থাপন করতে হবে।
৫) ওয়াইএসবি লিউরঃ
===============
ধানের হলুদ মাজরা দমনে ব্যবহার করা হয়। প্রতি ০৩ শতকে ০১ টি ট্রাপ ব্যবহার করতে হয়। চারা রোপণের ০২ সপ্তাহের মধ্যে ফাঁদ স্থাপন করতে হবে।
০৬) এসএনপিভি লিউরঃ
=================
ভূট্টার ফল আর্মিওয়ার্ম পোকা দমনে SNPV লিউর ব্যবহৃত হয়।
© প্রতি ০৩ শতকে ০১ টি ট্রাপ স্থাপন করতে হয়। চারা গজানোর ০১ সপ্তাহের মধ্যে অর্থাৎ ০৫ পাতা হলেই ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। গাছের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে ফাদ উপরে তুলতে হবে।
০৭) সিলভা লিউরঃ
শিম, টমেটো, মটরশুটি, ভূট্টা ইত্যাদি ফসলে এ-ই লিউর ব্যবহৃত হয়।
© প্রতি ২.৫ শতকে ০১ টি ট্রাপ ব্যবহার করলেই হয়।
© চারা লাগানোর ০১ সপ্তাহের মধ্যে ট্রাপ স্থাপন করতে হবে অর্থাৎ শিমে ফুল ফোটার আগেই স্থাপন করতে হবে, কারণ ফল ছিদ্রকারীর মথ পাপড়ির ভিতরের দিকে বৃন্তে ডিম পাড়ে।
কতটুকু উচ্চতায় ফাঁদ স্থাপন করতে হয়
===========================
কুমড়া জাতীয় গাছে মাচা বরাবর ঝুলিয়ে, বেগুন ও কপি জাতীয় গাছের ঠিক উপরে, ছোট ফল গাছ হলে মাটি থেকে হাত উচিয়ে যতটুকু উঠানো যায়, শিম গাছে মাচার উপরে, ভূট্টার গাছের ১ বিঘত উপরে ফাদ স্থাপন করা উচিত।
যে দূরত্বে ফাঁদ স্থাপন করতে হয়
=====================
ফাঁদগুলি বেগুনের ক্ষেতে ১০-১৫ মিটার, কুমড়ো জাতীয় ফসলে এবং ফলবাগানে ১২ মিটার এবং কপি জাতীয় সবজি ক্ষেতে ২৫ মিটার দূরত্বে স্থাপন করতে হবে।
বিঘা প্রতি ফাঁদের সংখ্যাঃ
=================
বেগুন ক্ষেতে বিঘা প্রতি ১৩ থেকে ১৪টি ফাঁদ, কুমড়ো জাতীয় সবজি ও ফল গাছের মাছিপোকা নিয়ন্ত্রণে বিঘা প্রতি ১১টি এবং কপি ক্ষেতে বিঘা প্রতি ৬ টি ফাঁদ বসাতে হবে।
অন্যান্য সতর্কতাঃ
============
১. প্লাষ্টিক বৈয়ামের ত্রিকোনাকার ভাবে কাটা অংশের মাঝ বরাবর তার দিয়ে ফেরোমন লিউর / টোপটি ঝুলিয়ে দিতে হবে।
২. গাছের সম উচ্চতায় ফেরোমন ফাঁদটি দুটি খুটির সাহায্যে শক্তভাবে বেধেঁ দিতে হবে। তবে যেহেতু ক্ষতিকর পোকা ফল অথবা ডগা ছিদ্র করে সে জন্য ফুল ও ডগার কাছাকাছি বক্সটিকে রাখতে হবে।
৩. বক্সটির/বৈয়ামের ভিতরে কর্তিত অংশ( ২-৩সে.মি.) পর্যন্ত গুড়ো সাবান/ নীম পাতার নির্জাস মিশ্রিত পানি দিতে হবে।
৪. কর্তিত অংশ উত্তর – দক্ষিন মুখ করে ঝুলাতে হবে।
৫. ফেরোমন লিউর / টোপটি যাতে সাবান পানিতে না ভিজে যায় সে জন্য পানির কিছুটা উপরে রাখতে হবে।
৬.বৃষ্টির পানিতে যাতে ফেরোমন লিউর / টোপটি না ভিজে যায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে
৭. ফেরোমন টোপগুলো সিল করা প্যাকেটের মধ্যে রক্ষিত থাকে এবং এ অবস্থায় ১-২ বছর সংরক্ষণ করা যায়।
৮. বেগুন ও কপিতে ব্যবহারের জন্য লিউরগুলো অবশ্যই ডিপ ফ্রিজে রাখতে হয়, তা না হলে লিউরগুলোর কার্যক্ষমতা দিনে দিনে কমে যায়।
৯. অন্যদিকে কুমড়া জাতীয় এবং ফলগাছের মাছির লিউরগুলো স্বাভাবিক রেফ্রিজারেটর বা নরমাল ফ্রিজে রাখা যায়।
১০. প্যাকেট থেকে খোলা হয়ে গেলে সেই লিউরকে সঙ্গে সঙ্গে মাঠে ব্যবহারের জন্য ফাঁদের মধ্যে লাগিয়ে দেয়া উচিত।
১১. প্রতিদিন ফাঁদ পর্যবেক্ষণ করতে হবে;
প্রতিদিন ফাঁদের জল পরীক্ষা করে মরে থাকা পোকা ফাঁদের জল থেকে আঙুল/কাঠি দিয়ে সরিয়ে ফেলতে হবে;
১২. ২-৩ দিন পর পর সাবানের জল পাল্টে দিতে হবে। সাবান জলের স্তর সব সময় ৩-৪ সেন্টিমিটার যাতে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে;
১৩৷ লিউর স্থাপনের সময় লিউরটির মুখ কোনো ভাবেই খোলা রাখা যাবে না।
® কৃষি বিষয়ক তথ্যের জন্য “কৃষি অন্বেষণ” পেজে লাইক, কমেন্ট করুন। “কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটি উন্মুক্ত প্লাটফর্ম।

যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
পুঠিয়া, রাজশাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *