কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
ধান বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। সাম্প্রতিক সময়ে ধানের আশানুরূপ দাম পাওয়ায় ধানের প্রতি কৃষক ভাইদের মনে আশার স্বপ্ন প্রদীপ দেদীপ্যমান হতে শুরু করেছে।
🌾ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর ধরে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এতদিন ধরে চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়া। তবে এবার ইন্দোনেশিয়াকে টপকে সেই অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাস বলছে, চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
🌾চলতি বোরো মৌসুমে সাড়ে চার লাখ টন বাড়তে পারে ধানের উৎপাদন। তার আগে চলতি অর্থবছরে আমন মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। আবার আউশ মৌসুমেও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তিন মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্মিলিত ফলাফলই শীর্ষ তিনে চলে আসার মূল কারণ বলে জানা গেছে।
🌾ইউএসডিএর প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারা বিশ্বে ৫০ কোটি ২০ লাখ টন ছাড়াতে পারে ধানের উৎপাদন, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে চীন সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করবে। দেশটি চলতি অর্থবছরে ১৪ কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপাদনের মাধ্যমে শীর্ষস্থানে থাকবে। চীনের পরই পাশের দেশ ভারতের অবস্থান। ভারত চাল উৎপাদন করবে ১১ কোটি ৮০ লাখ টন।
🌾এরপরই ৩ কোটি ৬০ লাখ টন উৎপাদন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসবে বাংলাদেশ।
অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরেই তিন নম্বর স্থানটি দখলে রাখা ইন্দোনেশিয়া এবার চতুর্থ অবস্থানে নেমে আসবে। দেশটিতে চালের উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৪৯ লাখ টন।
🌾🌾তাই ক্রমবর্ধমান ধানের আবাদ বৃদ্ধির গতি অব্যাহত রাখতে ধানের জমিতে সঠিক আন্তঃপরিচর্যা ও সার প্রয়োগ চালু রাখতে হবে।
তাই আজকের “কৃষি অন্বেষণ” এর পর্ব সাজানো হয়েছে ” রোপণ পরবর্তী বোরো ধানের আন্তঃপরিচর্যা ও সার প্রয়োগ ”
রোপণ কালীন সময় থেকে পর্যায়ক্রমিক পরিচর্যাঃ
==================================
১) লাইন করে চারা রোপণ করতে হবে।
২) ঘন করে না লাগিয়ে ৮ ইঞ্চি x ৬ ইঞ্চি দূরত্বে চারা রোপণ করা। ৮-১০ লাইন পরপর ০১ লাইন করে ফাকা রেখে চারা রোপণ করা,যাকে “লগ” পদ্ধতি বলে। এতে করে জমিতে আলো,বাতাস প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
৩) জমির আগাছা ঘাস মারার জন্য আগাছানাশক যেমন কমিট/সুপারহিট/ক্লিয়ার/ বিফিট-৫০০ ইসি ইত্যাদির যে কোন একটি চারা রোপণের ০৬ দিনের মধ্যে বিঘা প্রতি ১৩৪ মি.লি. হারে ব্যবহার করা ৷ কারণ কাংখিত ফলন পেতে মোট জীবনকালের প্রথম ১/৩ অংশ( প্রথম ৪০-৫০ দিন) আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন।
৪) চারা রোপণের ০১ সপ্তাহের মধ্যে বিঘা প্রতি ৪-৫ টি কঞ্চি/ডাল পুতে পার্চিং করে দিতে হবে৷
৫) মাজরা পোকা দমনে চারা রোপণের ২ সপ্তাহের মধ্যে ওয়াইএসবি সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
৬) থোড় আসার সময় আলোক ফাঁদের মাধ্যমে কারেন্ট পোকার( বিপিএইচ) উপস্থিতি যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৭) পোকামাকড় প্রতিরোধের জন্য চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন বয়সে একবার এবং ধান ফোটার পরপরই দ্বিতীয়বার সিস্টমিক জাতীয় কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
বোরো ধানের জমিতে সার প্রয়োগঃ
========================
সাধারণভাবে ১৫০ দিনের নিচে স্বল্প মেয়াদি জাত যেমন- ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান ৮৪, ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮ ব্রি হাইব্রিড ধান৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৫ বা বিনা ধান-১০ এবং বিনা ধান-১৮ এর ক্ষেত্রে——
🌾🌾 বিঘাপ্রতি অর্থাৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৩৫ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২০ কেজি, জিপসাম বা গন্ধক ১৫ কেজি, দস্তা (মনোহাইড্রেট) ১.৫ কেজি।🌾🌾
🌾 ১৫০ দিনের বেশি দীর্ঘমেয়াদি জাত যেমন- ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮ বা ব্রি ধান৬৯, ব্রি ধান৮৯ এর ক্ষেত্রে———
🌾🌾 বিঘাপ্রতি অর্থাৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১৩ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ১৫ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি। হাওর অঞ্চলের জাতের ক্ষেত্রে প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ২৭ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি।🌾🌾
🌾 তবে টিএসপির বদলে ডিএপি সার ব্যবহার করলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হবে।
🌾 টিএসপি বা ডিএপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সারের পুরোটাই শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে দস্তা ও টিএসপি একসাথে না মিশিয়ে পৃথকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
🌾 ইউরিয়া সারকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে।
🌾 স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে।
🌾 দীর্ঘমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর অর্থাৎ গোছায় কুশি দেখা দিলে এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে।
🌾 জমিতে পর্যাপ্ত জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। জৈব সারের সাথে রাসায়নিক সার সমন্বয় করে ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় ও ভালো ফলন হয়।
🌾 জমিতে বছরে একবার হলেও বিঘাপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
🌾 আমন মৌসুমে যে জমিতে জৈব সার ব্যবহার করা হবে সে জমিতে বোরো মৌসুমে ইউরিয়া সার নির্ধারিত মাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ কম ব্যবহার করতে হবে।
🌾 টিএসটি ও এমওপি সার অর্ধেক মাত্রায় ব্যবহার করলেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে। এছাড়া ধান কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ১০-১২ ইঞ্চি ওপরে কেটে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে দিলে পটাশ সারের পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগ কম লাগে।
🌾 দস্তা বা জিঙ্ক সালফেট সার ফসলচক্রের কোন একটিতে ব্যবহার করলে তা পরবর্তী দুই ফসলের জন্য ব্যবহার না করলেও চলবে।
🌾 বেলে মাটিতে চার কিস্তিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করাই ভালো। জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া সার সমভাবে ছিটানোর পর হাতড়িয়ে বা নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারলে ভালো ফলন আশা করা যায়।
🌾 তীব্র শীতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা যাবে না। ইউরিয়া সারের অপচয়রোধে এবং ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য এক মৌসুমে প্রতি চারটি গোছার জন্য ২.৭ গ্রাম ওজনের একটি মেগাগুটি প্রয়োগ করলেই যথেষ্ঠ।
🌾 যদি কোনো কারণে গন্ধক বা দস্তা ব্যবহার করা না হয় তাহলে গাছের গন্ধক বা দস্তার অভাবজনিত লক্ষণ বুঝে সার দিতে হবে।
🌧️বোরো ধানের জমিতে সেচ প্রয়োগঃ🌧️
=============================
ধানের জমিতে পানি বেশি হলে বিভিন্ন ছত্রাকজনিত রোগ, রোগের জীবাণু ছড়ায়, গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফুল/ফল ঝড়ে পড়ে ও দানা পুষ্ট হয় না। পরিশেষে ফলন কম হয়।
🌧️ আবার অন্যদিকে পানি কম
হলে খাদ্য গ্রহণ বা পরিবহনে ব্যাহত হয়, খাদ্য তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়, গাছ মরে যেতে পারে, ফুল-ফল দেরিতে আসে, আগাছা বেশি হয় এবং দানা পুষ্ট হয় না। ফলশ্রুতিতে ফলন কম হয়। তাই, ধানে বৃদ্ধির কোন পর্যায়ে কী পরিমাণ পানি লাগে তা জানা প্রয়োজন।
১) চারা লাগানো সময় ছিপছিপে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পানি লাগে। এর কম বা বেশি হলে রোপণে অসুবিধা হয়।
২) চারা লাগানোর থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত দেড় থেকে দুই ইঞ্চি। পানি কম হলে রোপণ ঝুঁকি সামলে উঠতে বেশি সময় লাগে আর বেশি হলে চারা হেলে পড়ে।
৩) চারা লাগানোর ১১ দিন পর থেকে থোড় আসা পর্যন্ত এক থেকে দেড় ইঞ্চি। এর কম বা বেশি হলে কুশি কম হয়।
৪) কাইচ থোড় হওয়ার সময় থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত দুই থেকে চার ইঞ্চি। এ সময় রসের ঘাটতি হলে দানা গঠন পুষ্ট হবে না, দানার সংখ্যা কম হবে। আর পানি বেশি হলে গাছ দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
৫) ধানে দানা শক্ত ক্ষীর হলে অর্থাৎ ধান কাটার ১০-১২ দিন আগ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পানি বের করে দিতে হবে।
সেচের মাধ্যমে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ঃ
==========================
🦗ধানের জমিতে সেচের মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে লেদা পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, থ্রিপস, ছাতরা পোকা, কাটুই পোকা, উড়চুঙ্গা আর রোগের মধ্যে ব্লাস্ট, বাদামি দাগ এবং অধিকাংশ আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
🦗অন্যদিকে নিষ্কাশন বা পানি সরিয়ে দেয়া মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে পাতা মাছি, চুংগি পোকা, বাদামি গাছফড়িং, সাদাপিঠ গাছফড়িং, রোগের মধ্যে বিভিন্ন ছত্রাক রোগ, পাতা পোড়া রোগ এবং আগাছার মধ্যে শেওলা, পানিকচু, কচুুরিপানা বা চেচড়া জাতীয় আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক ও মাসিক কৃষিকথা।
যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
বাঘা, রাজশাহী