কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
বলা হয়ে থাকে, ক্রম বর্ধমান বিশ্বের জনসংখ্যার চাহিদা মিটাতে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ খাদ্য উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় ৭০% বাড়াতে হবে।
আর তা প্রচলিত কৃষি প্রযুক্তিতে সম্ভব না।
© একদিকে ক্রম বর্ধমান জনসংখ্যা (expotential growth) , অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রম হ্রাস ও রাসায়নিক ক্যামিক্যালের উপর নির্ভরশীলতা, সব মিলিয়ে এক অসম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে কৃষি সেক্টর। পরিবেশ দূষণ, ক্ষয়িষ্ণু জমি আর মানব স্বাস্থ্য, এ যেন ত্রিমাত্রিক কঠীন সমীকরণ!!
© আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য কৃষি বিজ্ঞানী, গবেষক, সম্প্রসারণবিদগণ নিরলস প্রচেষ্টায় উদ্ভাবন করে চলেছেন পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন আধুনিক কলাকৌশল ও নব প্রযুক্তি।
®® আজ এমনই এক প্রযুক্তির ধারণা নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছে “কৃষি অন্বেষণ” পরিবার, যার নাম “Bee Vectoring Technology ”
🐝 মৌমাছি মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি। যাকে আরবিতে বলা হয় ‘নাহল’। পবিত্র কোরআনে ‘নাহল’ নামে একটি সুরাই অবতীর্ণ হয়েছে।
🐝 আলবার্ট আইনস্টাইন বলছেন, “যদি পৃথিবী থেকে মৌমাছি হারিয়ে যায় তাহলে মানব সভ্যতা টিকবে মাত্র চার বছর”।
🐝 বিশ্বের ৯০ ভাগ মূল ফসলের পরাগায়ন হয় মৌমাছির মাধ্যমে। মৌমাছি যদি পরাগায়নে সহায়তা না করে তাহলে বাঁচবে না ফসল। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, মানুষের প্রতি তিন লোকমা খাবারের মধ্যে এক লোকমাই আসে মৌমাছির কারণে।
🐝 বিশ্বে ১০০ রকমের ফল আর ৯০ ভাগ খাদ্য শস্যেরই পরাগায়ন হয় মৌমাছির সাহায্যে। মৌমাছি না থাকলে কমে যাবে ফসল কিংবা ফলমূলের উৎপাদন। দেখা দেবে খাদ্য সংকট।
এক পাউন্ড মধু বানাতে ৫৫০ মৌমাছিকে প্রায় ২০ লাখ ফুলে ভ্রমণ করতে হয়! আবার এক পাউন্ড মধু সংগ্রহ করতে একটি কর্মী মৌমাছিকে প্রায় ১৪.৫ লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়।
🐝 আর এই মৌমাছিকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা রোগ ও বালাই ব্যবস্থাপনায় অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন এনেছেন যার নাম বি ভেক্টরিং “Bee Vectoring Technology ” বা সংক্ষেপে BVT.
🐝 কানাডার এক কোম্পানি সমন্বিত রোগ ও বালাই ব্যবস্থাপনায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ফলপ্রসু রেজাল্ট পেয়েছেন ।
Bee Vectoring Technology ( BVT) কি?🐝
==============================
এই প্রযুক্তিতে মৌ কলোনীতে প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভাবিত এক প্রকার উপকারী ছত্রাক ব্যবহার করা হয় যার নাম BVT-CR7, or Vectorite, যা মৌমাছির শরীরের সাথে বাহক হিসেবে বিভিন্ন ফসলের ফুলের রেণুতে গিয়ে পড়ে এবং উক্ত ফসলের ক্ষতিকর ছত্রাক ধ্বংস করে সেগুলোর প্রভাবজনিত রোগ ও বালাই নিয়ন্ত্রণ করে ফসলকে রক্ষা করে৷
BVT যেভাবে কাজ করেঃ
=================
কৃত্রিমভাবে মৌবাক্স এর কলোনীতে উপকারী ছত্রাক ” BVT-CR-7 এর পাউডার বা মিশ্রণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। মৌমাছি যখন কলোনীতে প্রবেশ করে তখন তার শরীরের উপাংগের সাথে পাউডার তথা ছত্রাকের কণা গুলো লেগে যায়। পরবর্তীতে মৌমাছি মধু সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় তখন সেই পাউডার এর কণাগুলো ফুলের রেণুতে লেগে যায়। আর তার পরপরই উপকারী ছত্রাক তার হোস্ট পেয়ে বংশবৃদ্ধি করে এবং আশপাশের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবাণুকে গ্রাস করে বা বৃদ্ধি পেতে বাধার সৃষ্টি করে।
🐝🌹০১ একরে ০১ টা মৌকলোনীই যথেষ্ট এবং প্রতি কলোনীতে মাত্র ২০ গ্রাম BVT-CR-7 পাউডার লাগে।
BVT ব্যবহারের সুবিধাঃ
================
১) উপকারী ছত্রাকের মাধ্যমে অপকারী ছত্রাককে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে করে একদিকে মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ন নিশ্চিত করা যাচ্ছে, অন্যদিকে রোগ ও বালাই নিয়ন্ত্রণ করে সম্ভব হচ্ছে।
২) ফসলকে ক্ষতিকর জীবাণুর বিরদ্ধে প্রতিরোধক্ষম (resistance) করে তোলায়
বালাইনাশকের ব্যবহার কমছে, আবার গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত ও ফসলের shelf life বৃদ্ধি করছে।
৩).এছাড়াও গাছের শিকড়ের আকার আকৃতি, ফুলের সংখ্যা ও আকার বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে BVT-CR-7।
৪) গাছের অন্যান্য পুষ্টি উপাদান গ্রহণেও সাহায্য করে।
৫) এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা এইটা যেইদিন প্রয়োগ করা হয়, সেইদিনই ফসল তোলা যায়, কারণ এর কোন residual প্রভাব নেই।
এককথাই পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বালাই নিয়ন্ত্রণের এক অভিনব প্রযুক্তি হচ্ছে, এই Bee Vetoring Technology ”
যেসব ছত্রাক দমনে BVT ব্যবহার করা হচ্ছেঃ
===============================
® Botrytis ও Sclerotium প্রজাতির ছত্রাক নিয়ন্ত্রণ এ BVT-CR-7 ব্যবহৃত হচ্ছে।🐝🐝
এছাড়াও vectorine এ আরো কিছু active ingredients যুক্ত করার পরিকল্পনা বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, যেমন
১) Beauveria bassiana a.i.:
=====================
এর মাধ্যমে উইপোকা, থ্রিপস,সাদা মাছি ও বিভিন্ন বিটল পোকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে ( termites, thrips, white flies, aphids and different beetles.)
২)Streptomycin a.i.:
================
যার মাধ্যমে বিভিন্ন ফল, সবজি ও ফলের ব্যক্টেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগ বিশেষ করে আপেল ও নাশপাতির ফায়ার ব্লাইট রোগ (fire blight on apple and pear trees) নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
3) Bacillus thuringiensis a.i.
======================
বিটির স্পোরও এই পদ্ধতিতে যুক্ত করার কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা।
টেকসই কৃষির উন্নয়নেও এই প্রযুক্তি ভূমিকা রাখবে কারণ বলে দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ BVT এর মাধ্যমে
১) খাদ্য অপচয় কমবেঃ
================
UNFAO এর মতে, পৃথিবীতে প্রতিবছর ১.৩ বিলিয়ন টন ফসল বালাইয়ে নষ্ট হয়, যা মোট উৎপাদনের ১/৩ অংশ। BVT প্রযুক্তিতেসুস্থ, সবল, সতেজ ও নীরোগ গাছ হওয়ায় এই অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
২) বালাইনাশক ও পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তিঃ
============================
প্রাকৃতিক ভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে, BVT রাসায়নিক বালাইনাশক ও ব্যবহার সাশ্রয়
৩) কার্বন নির্গমন হ্রাসঃ
================
রাসায়নিক বালাইনাশক, পানি কম ব্যবহারের কারণে ইনার্জি খরচ কম হচ্ছে, ফলে প্রতি বছর ৩.৩ বিলিয়ন টন কম কার্বন নিঃসরণ হবে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
৪) প্রাকৃতিক বন্ধু পোকা সংরক্ষণ ঃ
========================
এই পদ্ধতিতে রোগ বালাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে প্রাকৃতিক বন্ধু পোকা যেমন মৌমাছি, ড্রাগন ফ্লাই, ড্যামসেল ফ্লাই ইত্যাদি পোকার স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষিত হবে।
® ” কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। এখানকার যে কোন লিখার ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ সাদরে গ্রহনীয়৷
যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
বাঘা, রাজশাহী