” কৃষি অন্বেষণ”পর্ব-৩৯# বিষয়ঃ ব্জ্রপাতের কৃষি তাত্ত্বিক গুরুত্ব” কৃষি অন্বেষণ”পর্ব-৩৯# বিষয়ঃ ব্জ্রপাতের কৃষি তাত্ত্বিক গুরুত্ব

কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম

বজ্রপাত’ শব্দটি শুনলেই বর্তমানে গা শিউড়ে উঠে। আশংকাজনক হারে বেড়েছে বজ্রমৃত্যুর হার। কিন্তু কৃষির জন্য এই ব্জ্রপাত একটি অপরিহার্য বিষয়। বায়ুমন্ডল হচ্ছে নাইট্রোজেন নামক উপাদানের আঁধার। চারিদিকে এত নাইট্রোজেন কিন্তু গাছের জন্য তা অপ্রতুল!! তাই তো কৃষকরা নাইট্রোজনের অভাব পূরণে ইউরিয়া সার ব্যবহার করে।
© কিন্তু ব্জ্রপাত স্রস্টার দেওয়া এক নেয়ামত। সৃষ্টিকর্তা পরিবেশে এক সুন্দর ভারসাম্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কারণ ব্জ্রপাতের মাধ্যমে বায়ুস্থ নাইট্রোজেন মাটিস্থ হয়ে গাছের গ্রহণ উপযোগী হয়। এছাড়াও উদ্ভিদ তথা প্রাণীর অস্তিত্বরক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের পেছনে রয়েছে বজ্রপাতের বিরাট অবদান।
আসুন আজ বজ্রপাতের কৃষিতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে একটু জানার চেষ্টা করি…..
প্রথমে জান যাক ব্জ্রপাত কি এবং কেন ঘটে?
================================
পানি যখন বাষ্প হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন মেঘের নিচের দিকে ভারী অংশের সাথে জলীয়বাষ্পের সংঘর্ষ হওয়ায় অনেক জলকণার ইলেকট্রন ত্যাগ কৃত হয়ে ধনাত্মক চার্জ এ পরিণত হয় এবং অনেক জলকণা সে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক চার্জে পরিণত হয়।
© এ চার্জিত জলীয় বাষ্প মেঘে পরিণত হলে মেঘে বিপুল পরিমাণ স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হয় । এ সময় অপেক্ষাকৃত হালকা ধনাত্মক আধান মেঘের উপরে এবং অপেক্ষাকৃত ভারী ঋণাত্মক চার্জ নিচে অবস্থান করে । মেঘে এই ২ বিপরীত চার্জের পরিমাণ যথেষ্ট হলে ডিসচার্জ প্রক্রিয়া শুরু হয় । ডিসচার্জিং এর ফলে বাতাসের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক প্রবাহিত হয় । এ বৈদ্যুতিক স্পার্ক এর প্রবাহই বজ্রপাত ।
© কিন্তু সব বজ্র কিন্তু ভূপৃষ্ঠে পড়ে না । শুধু ক্লাউড টু গ্রাউন্ড ডিসচার্জিং (মেঘের পজেটিভ আধানের ও ভূমির মধ্যে) এর ফলে সৃষ্ট বজ্র-ই ভূপৃষ্ঠে পড়ে ।
ব্জ্রপাতের কৃষি তাত্ত্বিক গুরুত্ব ঃ
=======================
পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে বাতাসের অদৃশ্য আবরণ, যাকে বলা হয় বায়ুমন্ডল। ভূপৃষ্ট থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত বায়ুস্তরের নাম ট্রোপোস্ফিয়ার। এর ওপরে রয়েছে ওজোন গ্যাসে পরিপূর্ণ স্তর স্ট্রাটোস্ফিয়ার। ঝড়ঝঞ্জা-বৃষ্টি-তুষার-বজ্র এ সবের যা কিছু কারিগরি সবই কিন্তু ট্রোপোস্ফিয়ারেই সীমাবদ্ধ। বায়ুমন্ডলের এ স্তরে রয়েছে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস। এর মধ্যে আয়তন অনুপাতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ৭৭.১৬ শতাংশ, তারপর অক্সিজেন ২০.৬০ শতাংশ, জলীয় বাষ্প ১.৪০ শতাংশ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ০.০৪ শতাংশ, নিষ্ক্রিয় ও অন্যান্য গ্যাস ০.০৮ শতাংশ।
© বজ্রপাতের সময় নাইট্রোজেন অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে নাইট্রোজেনের অক্সাইড। এই অক্সাইড জলের সংস্পর্শে পরিণত হয় অতি লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডে।
© নাইট্রিক অ্যাসিড সহজেই মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। মাটির বিভিন্ন খনিজ পদার্থ সহজেই অ্যাসিডে দ্রবীভূত হয়ে যায়। অ্যাসিড ও ধাতব অক্সাইডের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় নাইট্রেট লবণ; যা উদ্ভিদের অন্যতম পুষ্টি পদার্থ। মজার ব্যাপার হল বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ৭৭.১৬ শতাংশ হলেও, লিথোস্ফিয়ার বা মাটিতে এর পরিমাণ মাত্র ০.১ শতাংশ। প্রোটিন বা অ্যামিনো অ্যাসিডের অপরিহার্য উপাদান নাইট্রোজেন।
© বায়ুমন্ডলে বিপুল পরিমাণ নাইট্রোজেন থাকলেও প্রাণী ও উদ্ভিদ তা গ্রহণে সম্পূর্ণঅক্ষম। অ্যাজোটোব্যাকটর নামের ব্যাকটেরিয়া মটর, ছোলা, প্রভৃতি লিগুমিনাস জাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ে থেকে বাতাসের নাইট্রোজেনকে যৌগে পরিণত করে। তবে তার পরিমাণ খুবই সামান্য। এর পাশপাশি আবার রয়েছে ডি-নাইট্রোফাইং ব্যাকটেরিয়া, যারা মাটির নাইট্রেট লবণ থেকে নাইট্রোজেন গ্যাসকে মুক্ত করে। অর্থাৎ মাটিতে নাইট্রোজেন বা পরোক্ষভাবে প্রোটিনের উৎস হল বজ্রপাত ও বৃষ্টির দ্বারা তৈরি নাইট্রিক অ্যাসিড।
ব্জ্রপাত যেভাবে পরিবেশ দূষণ কমায়ঃ
===========================
শিল্পাঞ্চলের বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড প্রভৃতি আরও বহুপ্রকার গ্যাস থাকে। এইসব গ্যাসের উপস্থিতি বায়ুদূষণ ঘটায়। বায়ুমন্ডলে বজ্রপাত বা বিদ্যুৎ ক্ষরণের ফলে গ্যাসগুলি অতিলঘু অ্যাসিডে পরিবর্তিত হয়ে মাটিতে নেমে আসে। তাই শুধু উদ্ভিদ ও প্রাণীর পুষ্টির জন্যই নয়, দূষণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরির পেছনেও বজ্রপাতের ভূমিকা অনেক বেশি।
© ‘সাইবেরিয়ান সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব জিওলজির’ সহ –অধিকর্তা ভি বেগাটভ (V. Bgatov) একটি সুন্দর কথা বলেছেন- “যদি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বজ্রপাতের ঘটনা না হত, তবে বিশ্বের সকল কারখানাকে নাইট্রোজেন সারকারখানায় পরিণত করতে হত “।
® সবচেয়ে বড় ব্যাপার ধরার বুকে থাকতো না কোন প্রাণস্পন্দন, কারণ প্রথম প্রোটোপ্লাজম সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে বজ্রপাতের অবদান।”
“বজ্রপাত” হচ্ছে তড়িত শক্তির আঁধার ঃ
============================
ভূমি থেকে ৩ মাইল দূরত্বের বজ্রপাত ১ বিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন করে। বৈদ্যুতিক শক্তি পরিমাপক একক “কিলোওয়াট / আওয়ার” । এ হিসেবে এ শক্তি ২৭,৮৪০ কিলোওয়াট / আওয়ার ।
© বাংলাদেশে একটি পরিবার গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ১০০- ১৫০ ইউনিট (কিলোওয়াট-আওয়ার) বিদ্যুৎ ব্যাবহার করে। তার মানে একটি বজ্রপাতের বিদ্যুৎ শক্তি জমা করতে পারলে একটি পরিবার ১৮৫ মাস বা, প্রায় ১৫ বছর বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যাবহার করতে পারবেন ।
© চাইলে আপনিও বজ্রপাতকে ট্র্যাপে ফেলে বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যাবহারের সুযোগ লুফে নিতে পারেন।
তবে সে ক্ষেত্রে বজ্রপাতকে আয়ত্তে নিতে আপনি সময় পাবেন এক সেকেন্ডেরও কম । কারণ , বজ্রপাতের পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে।
© তবে বিজ্ঞানীরা থেমে নেই । বজ্রপাত থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ তড়িৎ শক্তিকে ধারণ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এবং তা বাস্তবায়িত করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
® আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলে অবশ্যই আমাদেরকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। বজ্রপাত ঘটবে কিন্ত সেইটা যেন ক্ষতিকর না হয় সেই জন্য উঁচু গাছ যেমন তাল, খেজুর, নারিকেল ইত্যাদি গাছ রোপণ করি।
তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন দেশি, বেদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা থেকে সংগৃহ করে সসম্পাদিত করা।
© “কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। এখানকার যে কোন লিখার ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ সাদরে গ্রহনীয়৷

যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
বাঘা, রাজশাহী

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *