” কৃষি অন্বেষণ”পর্ব-৪০# বিষয়ঃ সাইট্রাস গ্রিনিং, সাইলিড বাগ ও লাস (Las) ব্যাকটেরিয়ার ত্রিভুজ প্রেম ” কৃষি অন্বেষণ”পর্ব-৪০# বিষয়ঃ সাইট্রাস গ্রিনিং, সাইলিড বাগ ও লাস (Las) ব্যাকটেরিয়ার ত্রিভুজ প্রেম

কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম

সাইট্রাস গ্রিনিং লেবু জাতীয় গাছের খুবই সাধারণ একটি রোগ, আর এই রোগের বাহক সাইলিড বাগ নামক একটি পতঙ্গ, যা আবার লাস (Las) নামক ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে গ্রিনিং রোগ সৃষ্টি করে। সাইট্রাস গ্রিনিং, সাইলিড বাগ ও লাস (Las) ব্যাকটেরিয়ার ত্রিভুজ প্রেমের রসায়ন এই রোগকে দিয়েছে অন্যন্য এক মাত্রা। আসুন আজ সেই ত্রিভুজ প্রেম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
সাইট্রাস গ্রিনিংঃ
===========
লেবু জাতীয় ফল গাছ যেমন লেবু, মাল্টা, কমলা ইত্যাদি গাছে লেবুর পাতা হলুদ হয়ে যাওয়াকে সাইট্রাস গ্রিনিং বলা হয়ে থাকে।
হলুদ কিন্ত গ্রিনিং কেন নাম?!!!”
======================
আসলে ফল বা পাতা বা কোন অংগ হলুদ হলেও অল্প কিছু হলেও কিছু অংশ সবুজ কিন্তু গাড় সবুজ থাকে, তাই গ্রিনিং নামকরণ করা হয়।
এক অংগে বহু রূপ!!
===============
সাইট্রাস গ্রিনিং এর অপর নাম ইয়েলো শুট কারণ এই রোগে গাছের ডগা হলুদ হয়ে যায়। তবে বেশি পরিচিত Huanglongbing (HLB) রোগ নামে।
© সাইট্রাস গ্রিনিং চায়নাতে প্রথম ১৯১৯ সালে দেখা যায়।
© ১৯১৯ সালে চীন থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায়, ১৯২৮ সালে আফ্রিকা, ২০০৪ সালে আমেরিকা মহাদেশে এইটি ইয়েলো শুট (Yellow Shoot) নামে পরিচিত ছিল।
© HLB দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে প্রথম
গ্রিনিং নামকরণ পায়, পর্যায়ক্রমে ফিলিপাইনে মটল লিফ (mottle leaf), ইন্ডিয়ায় ডাই ব্যাক, ইন্দোনেশিয়ায় ভেইন ফ্লোয়েম রিজেনারেশন নামে এই রোগ পরিচিত পায় (Bové, 2006; da Graça, 1991)।
© HLB রোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে রোগ এবং বাহক (vector) দুটোই একই সময়ে অবস্থান করে ( Bove, 2006).
ব্যাকটেরিয়া (Las, Laf, Lam) এর গ্রিনিং প্রেমঃ
================================
© সাইট্রাস গ্রিনিং বা HLB এর তিনটি রূপ আছে।
১) এশিয়াটিক রূপ, যা Candidatus Liberibacter asiaticus (Las) নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়;
২) আফ্রিকা রূপ, যা Candidatus L. africanus (Laf) নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়;
৩) আমেরিকান রূপ যা Candidatus L. americanus (Lam) নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়।
সূত্রঃ (Jagoueix, Bové, & Garnier, 1994; Teixeira et al., 2005)
© এশিয়া অঞ্চলে Las ব্যাকটেরিয়ায় মূলত সাইট্রাস গ্রিনিং রোগ ছড়ায়,এই যা মূলত একটি গ্রাম নেগেটিভ আলফা প্রোটিওব্যাকটেরিয়া (Jagoueix et al., 1994). তাপ সহিষ্ণু এই ব্যাকটেরিয়া ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া vs সাইলিড বাগ, এ যেন দুই দেহ এক প্রাণ”!
==================================
লেবু জাতীয় ফসলে উপরিল্লিখিত ব্যাকটেরিয়া ট্রান্সমিট করে সাইলিড বাগ নামক হেমিপটেরা বর্গের একটি পোকা।
© দুই প্রজাতির সাইলিড বাগ এই ব্যাকটেরিয়া ট্রান্সমিট করে ১) ট্রায়োজা ইরাইট্রিয়া ২) ডায়াফ্রোরিনা সাইট্রি।
© তবে এশিয়া অঞ্চলে ডায়াফ্রোরিনা সাইট্রিই বেশি দেখা যায়।
© এছাড়াও গ্রাফটিং এবং যন্ত্রপাতির মাধ্যমেও এ রোগ বিস্তার লাভ করে থাকে।
সাইলিড বাগ যেভাবে গ্রিনিং রোগ ছড়ায়ঃ
=============================
সাইলিড বাগ তার মুখাপাংগ দিয়ে পাতা ছিদ্র করে রস চুষে খায়, আর ঠিক সে সময় তার শরীরে অবস্থানএত ব্যাকটেরিয়া গাছের ফ্লোয়েম টিস্যুতে ট্রান্সমিট হয়। আর তারপর ব্যাকটেরিয়া সেখান থেকে
ভাস্কুলার বান্ডলে আক্রমণ করে এবং শিরাতে ব্লক সৃষ্টি করে পানি ও পুষ্টি উপাদান চলাচলে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে গাছ তখন গ্রিনিং রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে।
সাইট্রাস গ্রিনিং চেনার সহজ উপায়ঃ
=========================
সাইট্রাস গ্রিনিং চেনার সহজ উপায় হলো পাতার মধ্য শিরার উভয় পাশে অসমতাকার গ্রিনিং দেখা যাবে। যেখানে পুষ্টি উপাদানের অভাবে মমধ্যশিরার উভয় পাশে সমতাকার লক্ষণ প্রকাশ পায়।
গ্রিনিং রোগের অন্যান্য লক্ষণঃ
====================
●ডগার পাতা প্রথমে আক্রান্ত হয়।
●শিরা ও উপশিরাগুলো ক্রমশঃ গাঢ় সবুজ হতে থাকে, যার জন্য রোগের নাম সাইট্রাস গ্রিনিং হয়েছে।
●পাতাগুলো হলুদ হয়ে যায়।
●শিরা দূর্বল ও পাতা কুঁকড়িয়ে ডাই-ব্যাক-এর সৃষ্টি করে।
●পাতা ও গাছ খর্বাকৃতির হয়।
●ফলেও হলুদ রং-এর দাগ দেখা যায়।
●আক্রান্ত গাছের ফল ছোট হয়।
●ফলে রসের পরিমান কমে যায়।
●ফল স্বাদে তিতাযুক্ত হয়।
●২-৩ বছরের মধ্যে গাছ মারা যেতে পারে।
রোগের প্রতিকারঃ
============
●নীরোগ বীজতলার চারা ব্যবহার করতে হবে।
●বাগান পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
●আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
● ফেব্রুয়ারী মাসে সাইলিড বাগ বেশি বংশবৃদ্ধি করে, তাই এই সময় পোকা নিয়ন্ত্রণের আনার উপযুক্ত সময়।
●জৈবিক ভাবে এফাইটিস আফ্রিকানাস এবং কক্সিনেলিড বিটল দিয়ে সাইলিড বাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। [ Aphytis africanus (Hymenoptera: Aphelinidae) and coccinellid beetle]
●Psyliid bug দমনের জন্য বালাইনাশক স্পিনোসাড ০১ সপ্তাহ পর পর অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে৷
●Psyliid bug দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক (যেমন-অ্যাডমায়ার বা ইমিটাফ) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
● কীটনাশক যেমন গ্ল্যামোর, কনফিডর, সপসিন, মিপসিন, প্লেনাম ইত্যাদি অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
●ট্রাই ব্যাসিক কপার সালফেট গ্রুপের ঔষধ (যেমন-কিউপ্রোক্স্যাট ৩৪৫ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।
●স্ট্রেপ্টোমাইসিন সালফেট + টেট্রাসাইক্লিন হাইড্রোক্লোরাইড গ্রুপের ব্যাকটেরিয়ানাশক (যেমন-ক্রোসিন-এজি ১০ এসপি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৮ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার জমিতে গাছে স্প্রে করতে হবে।
বি:দ্র: ক্রোসিন-এজি ১০ এসপি ও কিউপ্রোক্স্যাট ৩৪৫ এসসি ঔষধ দুইটি পর্যায়ক্রমে একটা ব্যবহার করার পর আরেকটি ব্যবহার করতে হবে।
সাইট্রাস গ্রিনিং সনাক্ত নিয়ে কতিপয় কনফিউশনঃ
==================================
১) যদি পাতার মধ্যশিরার উভয় পাশে সমানভাবে হ্লুদ লক্ষণ প্রকাশ পায়, তাহলে তা সাইট্রাস গ্রিনিং নয়, ধরে নিতে হবে সেইটা গাছের পুষ্টিজনিত অভাবের লক্ষণ।
২) সমস্ত ফল হলুদ, ছোট, ঝড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোন অংশে বিন্দুমাত্র গাড় সবুজ লক্ষণ নাই, তাহলে বুঝতে হবে তা সাইট্রাস গ্রিনিং নয়।
৩) আগা থেকে ডগা হলুদ হয়ে আসছে কিন্তু ডগার শীর্ষে সবুজ খাড়া পাতা আছে, তাহলে সেইটাও সাইট্রাস গ্রিনিং নয়।
সাইট্রাস গাছের জন্য দুইটি টিপসঃ
========================
১) লেবু জাতীয় গাছে সবসময় সার দিতে হবে N:P:K = 12:6:5 অনুপাতে।
২) ডিপটিউবয়েল বা ভূ-নিম্নস্থ পানি দিয়ে সেচ না দিয়ে সবসময় নদী বা বিলের পানি দিয়ে সেচ দিবেন। সবচেয়ে ভালো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রেখে সেচ দেওয়া।
® “কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। এখানকার যে কোন লিখার ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ সাদরে গ্রহনীয়৷

যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
বাঘা, রাজশাহী

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *