কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতে ভারতবর্ষে পানের সাথে খয়ের খাবার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, মোঘল শাহজাদী ও বেগমরা নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশ করতে পানের সাথে খয়ের মিশিয়ে খেতেন। মোঘলদের কাছ থেকে শিখে ভারতবর্ষের লখনৌভিদগণ বিখ্যাত “বেগম শাহী” পানের সাথে খয়ের ব্যবহার শুরু করেন।
© খয়ের শিল্পের জন্য বিখ্যাত রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা। এখানকার খয়ের সারাদেশে সুনাম অর্জন করলেও বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প বিলুপ্তির পথে। এক সময় এ পেশায় সাথে জড়িত ছিল প্রায় ২ লাখ মানুষ। এখন তা ২ হাজারের কোটায় নেমে এসেছে। উৎপাদনের জন্য অনুকূল আবহাওয়া থাকলেও পর্যাপ্ত কাঁচামাল, উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের খয়েরের নায্য দাম না পাওয়া, করোনাকালীন সময়ে বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া, সর্বোপরি প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প আজ বিপন্নের পথে।
তাই, আজকের এই পর্বটি খয়ের শিল্প নিয়ে সাজিয়েছি।
খয়ের কি?
=======
খয়ের (বৈজ্ঞানিক নামঃ Acacia catechu) একটি কণ্টকময় পর্ণমোচী উদ্ভিদ, যার উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়। ইংরেজি ভাষায় এই গাছ Catechu, Cachou বা Black Cutch নামেও পরিচিত।
© প্রচলিত অন্যান্য নাম খয়ের বাবুল এবং কস্ফাথ। মাঝারি আকারের পাতা ঝরা গাছ। সাধারণত ১৫ থেকে ১৮ মিটার উঁচু হতে পারে, শাখাবহুল ও কাঁটাযুক্ত। পাতা যৌগিক এবং পত্রখণ্ড ক্ষুদ্র। পত্রকোণে মঞ্জরি হয়। ফল সাদাটে, শিমের মতো চ্যাপ্টা। মার্চ মাসে ফুল হয়। কাঠ কাজে লাগে। এ গাছ থেকে খয়ের উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। বীজ থেকে চারা।
© খয়ের গাছ দেখতে অনেকটা বাবলা গাছের মত। এর ফুল আবছা হলুদ রঙের হয়। খয়েরের গাছ বাবলা গাছের মত হলেও পাতা আর ফুল কিন্তু ভিন্ন।
© এশিয়ার নানা দেশ, যেমন শ্রীলংকা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, ভারত এবং ভারত মহাসাগরের নানাদেশে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে এই গাছের ফলন হয়।
খয়ের এর ব্যবহারঃ
=============
১. প্রাচীন কাল থেকেই দাঁতের মাড়ির ক্ষয়, দাঁতের গোরা থেকে রক্ত পড়া, মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। হয়ত এই গুনের কারণে খয়েরকে পানের সাথে খাওয়ার নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছিল।
২. খয়ের আমাদের কাছে রঞ্জক হিসেবে পরিচিত হলেও এই অঞ্চলের ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবেও এর অনেক খ্যাতি। বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারি ১৯৯২ অনুসারে ২৫টি ঔষধে খয়ের ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায়।
৩. ভেষজ চিকিৎসায় খয়ের গুড়ো সিফিলিস, গনোরিয়া, অধিক রজঃস্রাব ও শ্বেতস্রাবের জন্য চিকিৎসার পথ্য হিসেবে দেওয়া হত। তাছাড়া খয়ের নারী যৌবনকে দীর্ঘস্থায়ী তথা সবল ও সুঠাম রাখে বলে ইউনানি চিকিৎসা বিজ্ঞানের বইতে উল্লেখ আছে।
৪. এক গ্রাম খয়ের চূর্ণ্ ব্যবহারে প্রাপ্তবয়স্কদের আমাশয় রোগের উপকার হয়ে থাকে।
৫. খয়ের দাতের গোড়া দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করতে সাহায্য করে থাকে।
৬. খয়ের জ্বরনাশক হিসেবে ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয়। জ্বরের ক্ষেত্রে এটি একটি মহাঔষধি এর কাজ করে থাকে।
৭. আলজিভ বৃদ্ধিজনিত কাশিতে এক টুকরো খয়ের মুখে রেখে চুষলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়।
৮. পুরোনো ক্ষত এবং সিফিলিসের প্রাথমিক ক্ষতে এর চূর্ণ্ ব্যবহারে উপকার হয়।
৯. পরিমাণ মত খয়ের ব্যবহারে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
১০. খয়ের গাছের সারকাঠ এবং সার কাঠের নির্যাসই মূলত বাণ্যিজ্যিকভাবে খয়ের বা কস্ফাথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১১. এই গাছের বীজ প্রোটিন সমৃদ্ধ। পানের সাথে খাওয়া হয়।
১২. এ গাছের ডাল অনেকসময় ছাগল বা গবাদি পশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয়।
১৩. গলার ঘা সারাতে বা ডায়োরিয়া রোগের ওষুধ হিসাবে এই গাছের কাঠের নিষ্কাষিত পদার্থ ব্যবহার হয়।
১৪. এই গাছের কাঠ জ্বালানি হিসাবে অথবা আসবাবপত্র নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হয়। এর কাঠের ঘনত্ব (wood density) প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ০.৮৮ গ্রাম।
১৫. লাক্ষা চাষের জন্যও খয়ের গাছ ব্যবহার করা যায়।
১৬. এই গাছের গুঁড়ির কেন্দ্রীয় অংশের কাঠ (heartwood) থেকে যে ট্যানিন নিষ্কাশন করা হয়, তার ব্যবহার হয় বস্ত্রাদির রং হিসাবে (dye), চামড়া পাকানোর কাজে (tanning), মাছ ধরার জালের সংরক্ষক (preservative) হিসাবে, ওষুধ তৈরির কাজে এবং খনিজ তেল ড্রিলিং-এর কাজে তেলের সান্দ্রতা (viscosity) সংরক্ষণে।
যেভাবে খয়ের প্রস্তুত করা হয়ঃ
=====================
খয়ের একটি রাসায়নিক পদার্থ।
খয়ের গাছ উপযুক্ত হলে সারিকাঠ সংগ্রহ করে ছোট ছোট বর্গাকারে খণ্ড করে ১২ ঘণ্টা ধরে হাড়িতে সিদ্ধ করে সেখান হইতে নির্যাস বা রস বের করে লোহা প্লেইন শীটের নির্মিত লম্বা কড়াইতে করে দীর্ঘক্ষণ জ্বাল দিতে হয়। ঠিক আখের গুড় বা খেজুরের গুড় যেভাবে তৈরী করা হয়। এর পর নিষ্কাশন করে ছাঁচে ঢেলে দেওয়া হয়।
© এতে বিভিন্ন আকারের খয়ের পাওয়া যায়। পান-এর অন্যতম প্রধান উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়। অন্য মশলা দেওয়ার আগে, পান পাতায় চুন বা খয়ের মাখানো হয়ে থাকে।
রাজশাহীতে খয়ের শিল্পের ইতিহাসঃ
=========================
১৯৫২ সালে মুন্সী নুরূল হক আর তাহের উদ্দিন প্রামাণিকের হাত ধরে চারঘাটে খয়েরের চাষ শুরু হয়। প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ এক সময় এই পেশার সাথে জড়িত ছিল। চারঘাটের বাবুপাড়া আর গোপালপুরে এক সময় প্রায় ২০০ পরিবার খয়ের শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা ১০-১২ তে নেমে এসেছে। একটা সময় ছিল যখন খয়েরের প্রায় ৯০ ভাগ আসত চারঘাট থেকে। প্রতি বুধবার চারঘাটে খয়েরের হাট বসে।
খয়ের গাছ কি বিপন্ন!!!
=================
খয়ের বাংলাদেশের সব স্থানে চাষ হয় না। খয়ের চাষের জন্য চারঘাটের মাটি বেশ উপযুক্ত। বন বিভাগের তথ্যমতে, নাটোরের লালপুর, বড়াইগ্রাম, রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা, নওগার ধামুইরহাট উপজেলায়, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় এখনো খয়ের গাছ রয়েছে। এছাড়াও ঢাকায় মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনেও খয়ের গাছ রয়েছে। তাই, বলা যায় গাছটি এখনও বিপন্ন নয়।
খয়ের শিল্প টিকিয়ে রাখতে করণীয়ঃ
==========================
১) খয়ের শিল্পকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা করা;
২)অনাবাদি পতিত জমি ও রাস্তার ধারের জমিতে খয়ের গাছ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া;
৩) খয়ের গাছের সাথে লাক্ষা চাষ, গাছ আলু চাষ করে অফলা গাছকে ফলদায়ক করা;
৪) খয়ের রপ্তানির জন্য সরকারী উদ্যোগ গ্রহণ করা;
৫) খয়ের শিল্পের ব্রান্ডিং করা।
বিপন্ন বা বিলুপ্তি নয়, একটি সুন্দর পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রাজশাহীর খয়ের শিল্পও খুলে দিতে পারে সম্ভবনার অপার দ্বার। তাই, আসুন দেশীয় শিল্পের বিকাশে সবাই এগিয়ে আসি।
® “কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। এখানকার যে কোন লিখার ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ সাদরে গ্রহনীয়৷
যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
বাঘা, রাজশাহী