“কৃষি অন্বেষণ” পর্ব-৪৯ বিষয়ঃ মাইক্রোগ্রিনঃ আগামীর কৃষি“কৃষি অন্বেষণ” পর্ব-৪৯ বিষয়ঃ মাইক্রোগ্রিনঃ আগামীর কৃষি

কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম

বিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের রুচি, খাদ্যাভাস। খরপোষের কৃষি রূপ নিচ্ছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। নিরাপদ পুষ্টিকর ফসল উৎপাদনে ছাদ কৃষি, নগর কৃষি ,হাইড্রোপনিক্স, এরোপোনিক্স ইত্যাদি পদ্ধতি আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হচ্ছে। ঠিক এরকমই এক পদ্ধতি সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এসেছে, যার নাম মাইক্রোগ্রিন। আসুন, এ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
মাইক্রোগ্রিন কি?
===========
মাইক্রো মানে ছোট আর গ্রিন বলতে সবুজ উদ্ভিদকে বুঝায়। তাই, মাইক্রোগ্রিন হলো বীজ থেকে সদ্য জন্মানো ছোট ছোট উদ্ভিদ।
© সাধারণত বীজ থেকে কটিলিডন (বীজপত্র) বা কটিলিডনসহ প্রথম পাতা বের হওয়া পর্যায়ের ১-৩ ইঞ্চি বা ২.৫-৭.৫ সে.মি. চারাটিকে মাইক্রোগ্রিন বলা হয়ে থাকে।
মাইক্রোগ্রিন ধারণার বিকাশঃ
=====================
আশির দশকের দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার রেস্তোরার শেফরা (বাবুর্চি) এর প্রচলন শুরু করেন। তখন তারা দশ থেকে চৌদ্দ দিন বয়সী গাছগুলোকে যেগুলোর মধ্যে সদ্য ২-৩টি পাতা সবে গজিয়েছে মাত্র, সেগুলো মাটি থেকে তুলে শিকড় বাদ দিয়ে খাবারে পরিবেশন করত। তখন শুধুমাত্র খাবার সাজানোর কাজে ব্যবহার করা হলেও পরে এর গুণাগুন নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণায় এর পুষ্টিগুন নিয়ে নানা তথ্য উঠে আসে এবং অনেকে একে মাতৃদুগ্ধ এর সাথেও তুলনা করে থাকেন। সদ্য অঙ্কুরিত এসব গাছের মধ্য লুকিয়ে থাকে অসংখ্য পুষ্টিগুণ।
সুতরাং বলা যায়, সদ্য জন্ম নেয়া দু- তিন ইঞ্চি লম্বা এসব ক্ষুদ্র উদ্ভিদই হল মাইক্রোগ্রিন।
মাইক্রোগ্রিন হওয়ার শর্তঃ
=================
তিনট মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকলেই শুধুমাত্র তাকে মাইক্রোগ্রিন বলা যাবে; ১) কেন্দ্রিয় কান্ড (central stem) ২) বীজপত্র (cotyledon Leave/leaves) ৩) সদ্যজাত ১ম জোড়া প্রকৃত পাতা (true leaves)।
মাইক্রোগ্রিনের পুষ্টিগুণঃ
=================
১) মাইক্রোগ্রিন পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি খাবার। এতে রয়েছে পটাশিয়াম, কপার, জিংক, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদি।
২) মাইক্রোগ্রিনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট।
৩) এছাড়াও পরিণত উদ্ভিদের চেয়ে অধিক পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ লবণ, মিনারেল, বিভিন্ন ধরনের পলিফেনল রয়েছে এতে।
৪) মাইক্রোগ্রিন উৎপাদনে সাধারণত রাসায়নিক সার বা কোনো প্রকার বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় না। তাই এটি মানবদেহের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ।
৫) মাইক্রোগ্রিনে পুষ্টি উপাদানগুলো ঘণীভূত অবস্থায় থাকে। ফলে একই পরিমাণে পরিণত সবজি থেকে ভিটামিন, পলিফেনল ও এন্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ মাইক্রোগ্রিনে তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।
মাইক্রোগ্রিনের স্বাস্থ্যগত উপকারিতাঃ
==========================
১) হৃদপিন্ডের অসুখঃ
===============
মাইক্রোগ্রিনে আছে পলিফেনল নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট, যেটি হৃদপিন্ডের অসুখের ঝুকি কমায়। এছাড়াও মাইক্রোগ্রিন ট্রাইগ্লিসারাইড ও খারাপ LDL(Low Density Lypoprotein) কমাতে সাহায্য করে।
২) আলঝেইমারঃ
============
এছাড়াও পলিফেনল নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট আলঝেইমার প্রতিরোধে সাহায্য করে যা প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোগ্রিনেই বিদ্যমান।
৩) বহুমুত্র বা ডায়েবেটিসঃ
===================
এন্টিঅক্সিডেন্ট স্ট্রেস কমিয়ে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত যে, মাইক্রোগ্রিন আমাদের দেহের কোষকে ২৫-৪৪% বেশি শর্করা গ্রহণ করতে উদ্দীপ্ত করে।
৪) ক্যান্সারঃ
========
এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও সবজি বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার হতে আমাদের রক্ষা করে। পলিফেনল সমৃদ্ধ কাবারগুলো এক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী।
মাইক্রোগ্রিন চাষ পদ্ধতিঃ
=================
মাইক্রোগ্রিন হিসেবে অনেক জাতের শস্য আবাদ করা যায়। তবে উৎপাদনের সময় উক্ত জাতটি মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত এবং নিরাপদ কি না সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বে প্রায় ১০০ প্রজাতির গাছ মাইক্রোগ্রিন হিসেবে উৎপাদন ও বিক্রয় করা হচ্ছে।
© মাইক্রোগ্রিন একটি স্বল্প জীবনকাল বিশিষ্ট ফসল। তবে বিভিন্ন জাত ও প্রজাতিভেদে বৃদ্ধির হারে পার্থক্য রয়েছে। সবজি জাতীয় মাইক্রোগ্রিনগুলো ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে কাটার উপযুক্ত হয় কিন্তু হার্বস জাতীয় উদ্ভিদগুলোর ১৬ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
© উৎপাদন সময়ের ওপর ভিত্তি করে মাইক্রোগ্রিনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১) দ্রুত বর্ধনশীল সবজি (৭-১৪ দিন) : বাঁধাকপি, ভুট্টা, শালগম, সরিষা, মুলা প্রভৃতি।
২) ধীর বর্ধনশীল সবজি (১৫-২৫ দিন) : ডাটা, বিট, গাজর প্রভৃতি।
৩) ধীর বর্ধনশীল হার্ব বা গুল্ম (১৫-৩০ দিন) : তুলসী, মৌরি, ধনিয়া, পার্সলে প্রভৃতি।
প্রয়োজনীয় উপকরণঃ
===============
১) চাষ করার জন্য ট্রে(যেকোনো আকারের),
২) মাটি,
৩) বীজ ও
৪) পানি দেয়ার জন্য হস্তচালিত স্প্রেয়ার।
মাইক্রোগ্রিন রোপন পদ্ধতিঃ
====================
ক) প্রথমে মাটি দিয়ে ট্রে ভর্তি করে নিন।
খ) গাছের বীজগুলো একটু সাজিয়ে বিছিয়ে দিন।
গ) এরপর স্প্রেয়ার দিয়ে আস্তে পানি ছিটিয়ে দিন।
ঘ) ট্রে রোদে রাখার প্রয়োজন নেই,ঘরের ভেতরেই রাখুন।
ঙ) যখন চারা গাছ জন্মাবে তখন ই কেবল রোদে ট্রে রাখবেন।
মাইক্রোগ্রিন রোপণ পদ্ধতিঃ
====================
ক) ভিজিয়ে রাখা দরকারঃ জোয়ান, আলফাআলফা, বিট, ব্রকোলি, বাঁধাকপি, চানা ডাল, মেথি, মৌরি, রোজ়েলা, কচু, কড়াইশুঁটি, মূলো, পালং, সূর্যমুখী, শালগম, অমরান্থ ইত্যাদি।
খ) সরাসরি বুনলে চলেঃ আরুগুলা, বেসিল, ধনে, তিসি, বেশির ভাগ সরষে, ওয়াটারক্রেস ইত্যাদ
মাইক্রোগ্রিন নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয়ঃ
==========================
সব সবজির মাইক্রোগ্রিন হয় না। মূলত যেসব সবজি বা শাক একদম চারা অবস্থায় কাঁচা খাওয়া যায় সেসবের বীজই এ কাজে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে চাষীদের পছন্দের তালিকায় আছে সরিষা, মুলা, লেটুস, বাঁধাকপি, লাল শাক, গাজর, সূর্যমুখী, মেথি, বিটরুট, ব্রকোলি, মটরশুঁটি, শালগমসহ বিভিন্ন ফসল। এগুলোর বীজ নিয়ে একটি ট্রেতে বীজতলার মতো করে একগাদা খুদে চারা তৈরি করাই হলো কাজ। এর জন্য জানতে হবে কোন বীজ কতদিনে এবং কোন প্রক্রিয়ায় অঙ্কুরিত হয়। যেমন সূর্যমুখী বা মুলার বীজকে এক রাত ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরিত হয় দ্রুত। ছোট বীজগুলোকে সাবধানে ভেজানো মাটিতে ছিটিয়ে দিতে হয়।
© সাধারণত বীজ থেকে কটিলিডন (বীজপত্র) বা কটিলিডনসহ প্রথম পাতা বের হওয়া পর্যায়ের চারাটিকে মাইক্রোগ্রিন বলা হয়ে থাকে। স্প্রাউটের সঙ্গে মাইক্রোগিনের পার্থক্য হলো স্প্রাউটে মূলসহ পুরো অংশ ব্যবহার করা হয়। আর মাইক্রোগ্রিনে মূল বাদে এর উপরের অংশটুকু ব্যবহার করা হয়।
© সাধারণত অঙ্কুরিত হওয়ার এক সপ্তাহ বা থেকে বিশ দিনের মধ্যেই খাওয়ার উপযোগী হয় মাইক্রোগ্রিন। মূলত চারায় যখন দুটি করে পাতা গজায় তখনই ওটা মাইক্রোগ্রিন। কিছু সবজি আছে এর চেয়ে বড় হলে আর কাঁচা খাওয়া যায় না।
মাইক্রোগ্রিনের বাণিজ্যিক দিকঃ
======================
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের বিদ্যাধরন ছোট্ট একটি ঘরে মাইক্রোগ্রিন চাষ করে মাসিক এক লাখ রুপি আয় করেন। তার বড় ক্রেতা হলো বড় বড় রেস্তরাঁ। বড় হোটেলগুলোর শেফরাও তার কাছ থেকে নিয়মিত নিয়ে যাচ্ছে মাইক্রোগ্রিন। মাইক্রোগ্রিন জগতে বিদ্যাধরণ তাই একটি জনপ্রিয় নাম।
© মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাজারে ৩-৪ হাজার টাকা কেজি দরে মাইক্রোগ্রিন বিক্রি হয়। এছাড়াও ইউরোপের বাজারেও এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।
® আমাদের দেশে এর বাজার অতটা না থাকলেও কিছু বড় বড় হোটেলে এর চাহিদা আছে। তবে বাণিজ্যিক আকারে বড় পরিসরে এর চাষ করতে দরকার হবে আধুনিক প্যাকেজিং ব্যবস্থার।
® “কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। এখানকার যে কোন লিখার ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ সাদরে গ্রহনীয়৷

যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
বাঘা, রাজশাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *