কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
ফুল কে না ভালোবাসে!! ফুল প্রেমের প্রতীক, ভালোবাসার প্রতিক এমনকি বিরহেরও প্রতিক। ফুলে প্রকাশ পায় সাহস, সম্মান, সৌজন্যবোধ। ফুল মানে শুভ্রতা, ফুল মানে পবিত্রতা, ফুল মানে কোমলতা।
তাই তো পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এর ভাষায় ফুল বন্দনা—
“আমার এ কুল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাঁধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।”
© আজ আপনাদের সামনে শীতের রাণী মানে শীতপ্রধান দেশের ফুল ” টিউলিপ” চাষের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করবো।
© বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। খুব বেশি শীত এ দেশে পরে না। স্বল্পকালীন শীত বিরাজ করে এ অঞ্চলে। তাও যতটুকু শীত অনুভূত হয়, তা দেশের উত্তরাঞ্চলেই বেশি।
© টিউলিপ ফুল মূলত শীতপ্রধান দেশের ফুল, এর উৎপাদনের জন্য ৫-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। কিন্তু তাও এ দেশে টিউলিপ ফুল চাষের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে উদ্যোমী কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবেদিত প্রাণ সম্প্রসারণবিদগণ। ইতোমধ্যে গাজীপুরের শ্রীপুর, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গোদখালি, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দামকুড়ায় টিউলিপ চাষ আশা জাগিয়েছে ফুল চাষীদের মনে। বিশেষ করে রাজশাহীর পবা উপজেলায় আম বাগানের নিচে টিউলিপ চাষ বিশেষ নজর কেড়েছে ফুলচাষপ্রেমীদের মনে।
আসুন টিউলিপ ফুল নিয়ে অল্পবিস্তর জানার চেষ্টা করি।
© টিউলিপ বর্ষজীবি ও বসন্তকালীন ফুল হিসেবে পরিচিত। এটি মুকুল থেকে জন্মায়। বিভিন্ন প্রজাতিতে এর উচ্চতা ভিন্নরূপ হয়। সচরাচর ৪ ইঞ্চি (১০ সে.মি.) থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৮ ইঞ্চি (৭১ সে.মি.) পর্যন্ত উচ্চতাসম্পন্ন হয়। অধিকাংশ টিউলিপই ডাঁটা থেকে একটিমাত্র মুকুলের মাধ্যমে বিকশিত হয়। কিন্তু কিছু প্রজাতিতে (যেমন – টিউলিপ তুর্কেস্টানিকা) কয়েকটি ফুল হতে পারে।
টিউলিপ ফুলের ইতিহাস
=================
পামির মালভূমি এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালার এলাকা থেকে উদ্ভূত হয়ে কাজাখস্তানে স্থানান্তরিত হয় যা পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, ইউরোপের দক্ষিণাংশ, উত্তর আমেরিকা, এশিয়ার আনাতোলিয়া থেকে ইরানের পূর্বাংশ, চীনের উত্তর-পূর্বাংশ এবং জাপানে এ উদ্ভিদ পাওয়া যায়। টিউলিপের সাথে হল্যান্ডের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ষোড়শ শতাব্দী থেকে টিউলিপের চাষ হয়ে আসছে।
© টিউলিপকে ইরান ও তুরস্কে ফার্সি ভাষায় লালে নামে ডাকা হয়। ধারণা করা হয় যে, টিউলিপের অনেক প্রজাতির আদি আবাসস্থল হিসেবে এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকায় গড়ে উঠেছে।
© পারস্যে লাল টিউলিপকে ভালবাসার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। লাল টিউলিপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কালো অংশের মাধ্যমে প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় ভেঙ্গে খানখান ও কয়লার ন্যায় পুড়ে যাওয়া এবং হলুদ টিউলিপ বিনিময় করাকে আশাহীন ও সম্পূর্ণভাবে নিরাশাগ্রস্ত আকারে তুলে ধরা হতো।
© বাণিজ্যিকভিত্তিতে অটোম্যান সাম্রাজ্যে চাষাবাদ শুরু হলেও পরবর্তীকালে নেদারল্যান্ডে বাণিজ্যধর্মী আবাদ শুরু হয়। হল্যান্ড বিশ্বের প্রধান টিউলিপ উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে পরিচিত। বার্ষিক তিন বিলিয়নেরও অধিক টিউলিপ কন্দ উৎপাদন করে ও রপ্তানী আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসরূপে বিবেচিত।
© নেদারল্যান্ডের সাথে টিউলিপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। চাষাবাদ প্রণালীকে প্রায়শঃই ডাচ টিউলিপ নামে আখ্যায়িত করা হয়। টিউলিপকে ঘিরে শিল্প গড়ে উঠেছে এবং টিউলিপ উৎসব পালন করা হয়।
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে টিউলিপ ফুল সর্বোচ্চ চাষ করা হয়।
বাংলাদেশে টিউলিপ চাষঃ
==================
আমাদের দেশে বেগুনি, হলুদ, কমলা, সাদা ও লাল—এই পাঁচ ধরনের ফুল চাষ হচ্ছে।
ফুলগুলো একটি শেডের নিচে চাষ হচ্ছে। শেড একটি বিশেষ ধরনের পলিথিন দিয়ে ঢাকা। আর চারপাশ ঢাকা ছোট ছিদ্রযুক্ত নেট দিয়ে। পুরো শেডটিতে বিশেষ পদ্ধতিতে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করা হয় সূর্যের আলো।
© ২০১৯ সালে শ্রীপুরের কৃষক দেলোয়ার তার বাগানে
নেদারল্যান্ডস থেকে ১ হাজার ১০০টি টিউলিপ গাছের বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কাণ্ড) লাগিয়েছিলেন। এ বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ঝিকরগাছা উপজেলায় পরীক্ষামূলক ট্রায়াল প্লট বাস্তবায়িত হচ্ছে,পাশাপাশি রাজশাহীর পবার জেলার ‘ড্রিমার্স গার্ডেন’ এ আম বাগানে মাঝে পরীক্ষামূলক ট্রায়াল চলছে।
টিউলিপ ফুল চাষের চ্যালেঞ্জঃ
=====================
তবে এ দেশে ফুল ফুটলেও পরবর্তীকালে রোপণের জন্য টিউলিপগাছের বাল্ব সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাল্ব সংরক্ষণ করতে হয়। তাই এটা টিউলিপ চাষের বড় সীমাবদ্ধতা।
® সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এডাপটেশনের নতুন প্রযুক্তি বা অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন জাত নির্বাচন করতে পারলে ফুল শিল্পে তা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিবে।
® টিউলিপ চাষ এখনো পরীক্ষামূলক, তাই প্রথমেই কেউ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে না করাই শ্রেয়।
® “কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। এখানকার যে কোন লিখার ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ সাদরে গ্রহনীয়৷
যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
বাঘা, রাজশাহী