কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
হঠাৎ নারিকেল বা সুপারি বা পেয়ারা বা অন্য কোন ফসলের পাতা সাদা হয়ে যাচ্ছে, রাতে আলোয় সাদা জ্বলজ্বল করছে। অনেকে আতংকিত হয়ে যাচ্ছেন, কেউ মনে করছেন করোনা অতিমারির মত এইটা খোদার অভিশাপ ( ভারতের তামিলনাড়ুতে এই মিথ বিস্তার লাভ করে)। কেউ প্রার্থনা করছেন, কেউ উপাসনা করছেন কেউবা অর্ঘ দিচ্ছেন। আবার কেউবা প্রেতান্মার আঁচড় বলে গাছের গোড়ায় দুধ কিংবা পানি ঢালছেন। নানারকম মিথ কিংবা আতংক বাসা বাঁধছে অস্থির মানবমনে।
© আতংকিত হবার কিছু নয়, আসলে এইটা ৮-১০ টা পোকার মতই একটি পোকার আক্রমণ। আগে ব্যাপকভাবে দেখা যায়নি, এখন দেখা যাচ্ছে। এইটুকুই।
আতংকিত হবার কিছু নাই, দরকার জনসচেতনতা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, পরিদর্শন এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা। আসুন আজ এই ব্যাপারে অল্পবিস্তর জানার চেষ্টা করি।
রুগোজ স্পাইরালিং হোয়াইট ফ্লাই (সাদা মাছি)ঃ
==================================
রুগোজ স্পাইরালিং হোয়াইট ফ্লাই এক ধরনের সাদা মাছি, যার বৈজ্ঞানিক নাম অলিওরোডিকাস রুগিওপারকুলেটাস। প্রকৃত নাম গাম্বো লিম্বো স্পাইরালিং হোয়াইট ফ্লাই।
বিবর্তনিক ইতিহাসঃ
=============
মূলত এই পোকার আক্রমণে নারকেল গাছের পাতায় সাদা দাগ পড়ে। নারকেল ছাড়াও সুপারি,আম, পেয়ারা, ভূট্টা, জামরুল, সফেদা, কাঁঠাল-সহ প্রায় ১১৮ প্রজাতির গাছে এই কীট বাসা বাঁধে ( ফ্রান্সিস, ২০১৬)।
© এটা হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে, এমনটা অবশ্য নয়।
বিজ্ঞানী মার্টিন ২০০৪ সালে মধ্য আমেরিকার বেলিজে
নারিকেল গাছের পাতায় এই মাছি প্রথম সনাক্ত করেন।
২০০৯ সালে ইউএস এর ফ্লোরিডা অংগরাজ্যে দেখা যায়।
২০১৬ সালে ভারতের তামিলনাড়ুতে দেখা যায় ।
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে যশোরের আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মত বাংলাদেশে এই পোকার আক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
এই সময়ে মাগুরা, পাবনা, পঞ্চগড়, গাজীপুরসহ কয়েকটি জেলার নারিকেল পাতায় এর অস্তিত্ব দেখতে পান।
জীবনচক্রঃ
========
ডিম-নিম্ফ(বাচ্চা)-পূর্ণাংগ তাদের জীবন চক্র।
২৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সাধারণত ৩০ দিনের মধ্যে এরা জীবনচক্র সম্পূর্ণ করে (ম্যানিয়ন, ২০০৪)।
ডিমঃ গাছের পাতার নিচের দিকে স্ত্রী মাছিগুলি চক্রাকারে প্রায় ২০০টি ডিম পাড়ে। তুলোর মতো আঠালো আস্তরণ দিয়ে ডিমগুলিকে ঢেকে দেয়। ডিম ক্রিমি হোয়াইট থেকে গাড় হলুদ রং এর ডিম। পাতা ছাড়াও দেয়াল, জানালা এমনকি গাড়ির আস্তরণের উপরও এরা ডিম পাড়ে। ডিম ০.৩ মিমি হয়।
নিম্ফঃ ৫ টি ধাপে নিম্ফ পর্যায় সম্পন্ন হয়।
১ম পর্যায়কে বলে ক্রলার স্টেজ, ডিম থেকে বাচ্চা ফুটার পর এই স্টেজ শুরু হয়। একমাত্র এই স্টেজই চলনশীল এবং নিডল আকৃতির মুখোপাংগ দিয়ে গাছের পাতার রস শোষণ করতে থাকে।
নিম্ফ ১.১-১.৫ মিলি লম্বা হয়। হালকা থেকে সোনালি হলুদ রং এর ঘন তুলো সদৃশ মোমের আবরণের ন্যায় ফিলামেন্ট উৎপন্ন করে, যা আস্তে আস্তে ঘন হয়৷ অনেকটা পিউপারিয়ামের (পুত্তলীর) মত দেখায় (স্টোকস ও হোডজ,২০১২)।
পূর্ণাংগঃ মাছির মতো দেখতে সাদা রংয়ের পূর্ণাঙ্গ মাছির ডানায় এক জোড়া হালকা বাদামি বিন্দু থাকে।
সাদা আকৃতির এই পোকা অন্যান্য সাদা মাছির চেয়ে আকারে প্রায় তিনগুণ বড় (প্রায় ২.৫ মিমি) এবং পাখায় হালকা বাদামী বা ধূসর বর্ণের দাগ থাকে। পুরুষ পোকার এবডুমেনের শেষে লম্বা সুচালো অংশ থাকে (pincher like structure)। ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মাছিতে পরিণত হতে প্রায় ১ মাস সময় লাগে।
ক্ষতির লক্ষণঃ
==========
এরা মূলত পাতার রস শুষে খায়। গাছের পাতার নীচে সাদা মোমের আস্তরণ পরে। পরে সেখানে ডিম পাড়ে ও সেখান থেকে বাচ্চা (নিম্ফ) বের হয়। এর পর তারা রস শুষে খায় এবং মধু সদৃশ হানি ডিউ নিঃসরণ করে। ফলে সুটি মোল্ড রোগের বিস্তারের কারণে পাতা কালো হয়ে যায়। পাতার সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হওয়ার কারণে পাতা ঝরে পরে এবং পাতা ও গাছটি ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যেতে পারে।
সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনাঃ
==================
পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে একাধিক বালাই ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ে এই পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ক- আন্তঃপরিচর্যাঃ
=============
নিয়মিত মনিটরিং এর মাধ্যমে বালাই সনাক্তকরণ প্রথম ধাপ।
লক্ষণ দেখা মাত্র ছোট গাছ হলে হাত দিয়ে ডিম, বাচ্চা মেরে ফেলা।
হাই স্পিডে পানি স্প্রে করা নতুবা সাবান মিশ্রিত পানি পর্যায়ক্রমিকভাবে নিয়মিত স্প্রে করা।
খ. জৈবিক দমনঃ
============
১) পরজীবীতার মাধ্যমে দমন করা যায়। Encarsia guadeluopae Viggani and Encarsia noyesii Hayat (Hymenoptera: Aphelinidae), এবং the beetle predator, Nephaspis oculatus (Blatchley) এর মাধ্যমে রুগোজ স্পাইরালিং হোয়াইট ফ্লাই নিয়ন্ত্রণ করা যায় (Osborne 2012).
২) খাদক হিসেবে লেডি বার্ড বিটল (Nephaspis oculata) এবং লেস উইং ব্যবহার করা যেতে পারে।
২)জৈব বালাইনাশক সবচেয়ে ভালো কাজ করে। নিম নিঃসৃত বালাইনাশক যেমন ফাইটোম্যাক্স, বায়োনিম প্লাস ইত্যাদি ১মিলি./লিটার স্প্রে করতে হবে। নিকোটিন নিঃসৃত বালাইনাশক ও ভাল কাজ করে।
গ. রাসায়নিক দমনঃ
==============
একেবারে শেষ ব্যবস্থা হিসেবে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনায় যাওয়া যেতে পারে। সিস্টেমিক এবং স্পর্শক জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণত ব্যাপক বিস্তার রোধে ইমিটাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করা হয়।
(এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অভিজ্ঞ কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিতে হবে)।
কারণ কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পোকার পুনঃচক্রায়ন বৃদ্ধি করতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ
Evans GA. 2008. The whiteflies (Hemiptera: Aleyrodidae) of the world and their host plants and natural enemies. USDA-APHIS. (16 April 2020)
ছবিঃ নেট ও ০১ টি @কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, গুরুদাসপুরের টাইমলাইল থেকে নেওয়া।
®”কৃষি অন্বেষণ” কৃষি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। এখানকার যে কোন লিখার ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ সাদরে গ্রহনীয়৷
যোগাযোগ————-
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
বাঘা, রাজশাহী