নিউজ ডেস্কঃ
করোনা বিশ্বমহামারীর কারণে ধস নেমেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। শক্তিশালী পশ্চিমা অর্থনীতির অবস্থাও নাজুক। দেশে সেই চাকা সচল রাখতে হলে বাঁচিয়ে রাখতে হবে কৃষি ও কৃষককে। তবে সেটাও যে সহজ নয়, প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতা সামাল দিতে গিয়েই নাজেহাল। তার ওপর আবার করোনার আঘাত। সব মিলিয়ে অনেকটা দিশেহারা কৃষক। তার পরও বিশ্ব এ মহামারীতে শুধু ভাতের সংস্থানই নয় সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস, ফল কোনো কিছুরই অভাব বোধ করতে দেয়নি তারা। বারবারের মতো এবারও হাল ধরেছে দেশের অর্থনীতির।
এরই মধ্যে জাতীয় সংসদে উত্থাপন হয় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট, যেখানে কৃষি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে এ দুর্যোগে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার কথা বলা হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন নেই। সরকার কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বললেও প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ সেভাবে বাড়েনি। বিবেচনায় নেওয়া হয়নি প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থ।
সরকার অবশ্য বলছে, কৃষি খাতে ভর্তুকি বহাল রাখার পাশাপাশি এ খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রেখে নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কৃষি বাজেট নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘কোভিড-১৯ কে সামনে রেখেই এবারের বাজেট দেওয়া হয়েছে, যে সময় পুরো মানবজাতিই সংকটের মধ্যে। তেমনি বিপর্যস্ত অর্থনীতিও। তার পরও আমাদের উন্নয়নের যে ধারা, এটাকে অব্যাহত রেখেই আমরা বাজেট দিয়েছি।
আশা করছি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আস্তে আস্তে কমে আসবে এবং আমরা আমাদের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করব। গত মার্চ থেকে করোনায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটাকে তো আমরা মেনেই নিয়েছি। ভাইরাসটির এ তা-ব যদি না থাকত, তা হলে বাংলাদেশে আর্থসামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোর যে উন্নয়ন হয়েছে তাতে অর্থনীতির সুপ্রবৃদ্ধি এবং সুবৃদ্ধির পথে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই করোনার আঘাতটা এলো। তবে আমি মনে করি এটা কেটে যাবে। উন্নয়নের যে ধারা ছিল, বাংলাদেশ আবার নতুন করে সে পথে এগোবে এবং তা অব্যাহত থাকবে। যদি করোনার এ আঘাত দীর্ঘায়িত হয় তবে আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে। বাজেটও পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তার পরও আমরা সামনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। আমাদের ২০২০ থেকে ২০৪১ ভিশন ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সামনে নিয়েই বাজেট হয়েছে।’
বাজেট নিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের এ দুর্যোগের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধতার মধ্যে কৃষি খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরও প্রতিশ্রুতিও আছে। আমরা যদি প্রয়োজনে কোনো প্রকল্প নিয়ে যাই, তা দেওয়া হবে।’
বহু বছর ধরেই কৃষি নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক সাইখ সিরাজ নতুন বাজেট নিয়ে বললেন, ‘কৃষি নিয়ে সরকারের চিন্তার প্রতিফলন প্রস্তাবিত বাজেটে সেভাবে নেই। কৃষি নিয়ে বাজেটের ওই ফোকাসটাও সেভাবে নেই। শুধু বলে ক্ষান্ত হলেই চলবে না যে আমার কোনো জমি খালি রাখা যাবে না; এর জন্য একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। আসলে ফেজ বাই ফেজ পরিকল্পনা বাজেটে নেই। প্রান্তিক চাষিদের ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।’ তিনি মনে করেন, ‘কৃষিতে তরুণদের আকৃষ্ট করতে আইওটিভিত্তিক কোনো পরিকল্পনার কথাও বলা হয়নি নতুন বাজেটে।’
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘এবার ধান রোপণ, ধানাকাটা এবং মাড়াইয়ের জন্য যন্ত্র কিনতে ঋণ সহায়তার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ পদক্ষেপকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। কিন্তু কৃষকের জন্য এখন বড় সমস্যা হচ্ছে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা। এ সরবরাহ চেইন বা ব্যবস্থাপনা উন্নত করার ব্যাপারে প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো প্রণোদনা বা বক্তব্য নেই।’ তিনি বলেন, ‘কৃষি খাতে যা দরকার, তার একটা প্রচেষ্টা এ বাজেটে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এ খাতের যন্ত্রপাতি আমদানির শুল্ক কমানো হয়েছে। এটা ভালো দিক। তবে কৃষিপণ্য সরবরাহ চেইনের সঙ্গে জড়িতদের জন্য প্রণোদনা থাকলে ভালো হতো।’
কৃষি বাজেট নিয়ে কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা বলেন, ‘করোনাকালে সরকারকে বাজেট দেওয়াটাই বেশ কঠিন ছিল। সে হিসেবে কৃষি খাতে যে গুরুত্ব দিয়েছে, তাতে আমি একজন কৃষিবিদ হিসেবে অসন্তুষ্ট না। বাজেটে কৃষি যন্ত্রপাতির ট্যাক্স কমানো হয়েছে, এটি একটি ভালো বিষয়। এ ছাড়াও কৃষিতে ভর্তুকি রয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। তাই আমার মতে কৃষি খাতের বাজেটের অনেক বিষয় বা খাত রয়েছে, যা দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান। আর অদৃশ্যমান বিষয় এগুলোও বাজেটের সঙ্গে যুক্ত হবে। এসবের যোগফলও কিন্তু অনেক। আর এগুলো ধারাবাহিকভাবে চলবে। করোনার এ পরিস্থিতিতে কৃষিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করাটাও একটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে একটি হলো কৃষি সম্প্রসারণ অন্যটি কৃষি গবেষণা। এর পাশাপাশি রয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ। এগুলোও কিন্তু আমাদের কৃষির সহযোগী প্রতিষ্ঠান। আমরা বলি-শস্য, মৎস্য ও পশুপালন। সব মিলিয়ে কৃষি খাতের বাজেট কৃষিবান্ধব বলেই আমি মনে করি।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. ছাইফুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্যও এ চ্যালেঞ্জ সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করার লক্ষ্য নিয়ে বাজেটে এবার কৃষি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির প্রতি দেওয়া হয়েছে অগ্রাধিকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবারের বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়কে ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ২ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা বেশি। সেই দিক থেকে কৃষি খাতের বরাদ্দ ১৫ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা, যা সন্তোষজনক। অন্যদিকে কৃষকদের জন্য সার, ডিজেল ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ প্রদানের জন্য ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৫০০ কোটি টাকা বেশি। ফলশ্রুতিতে কৃষি উৎপাদনের জন্য উপকরণ ব্যয় হ্র্রাস পাবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, কৃষিতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়।’
সুত্রঃ আমাদের সময়