কৃষি পেশা; করোনাকালে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালেই ঘুরে দাঁড়াবে দেশকৃষি পেশা; করোনাকালে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালেই ঘুরে দাঁড়াবে দেশ

কৃষিবিদ জুয়েল রানা

বিশ্বায়নের যুগে সবকিছু খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল। আজ যা নতুন কালই তা পরিবর্তিত হয়ে আরো নতুন সংস্করণ নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির অবশ্যম্ভাবী প্রভাব আর কোভিড-১৯ নামক ভয়াবহ সংক্রামক এক ভাইরাস বর্তমান প্রেক্ষাপটকে যত কঠিনই করে তুলুক না কেন, এই পরিবর্তিত বাস্তবতার নিরিখে দেশের মানুষ ও অর্থনীতিকে খাপ খাইয়েই টিকে থাকতে হবে।

ছোট-মাঝারি শহুরে পেশা হারিয়ে হাজারো মানুষ ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। এদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ এবং যুবক। আগে থেকেই কর্মসংস্থানহীনতা আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের চরম বাস্তবতা, তার সাথে নতুন করে যোগ হচ্ছে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ। গার্মেন্টস খাতে ইতোমধ্যে শ্রমিক ছাটাইয়ের ঘোষণায় দেশজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলমান রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে আসন্ন চাপ যেন অনিবার্য। এই প্রেক্ষাপটে কিভাবে ঘুড়ে দাঁড়াবে মানুষ? উৎপাদনের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করলে কৃষি খাত যতটা সফল লাভজনক কর্মসংস্থানের জায়গা হিসাবে এই খাত কি ততটা আকর্ষণীয়? দেশের এক তৃতীয়াংশ যুবশক্তির কাছে পেশা হিসাবে কৃষি কতটুকু আবেদন তৈরি করতে পারবে- এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এসেছে।

বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস উৎপাদনেও যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে কৃষিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং সামাজিকভাবে মর্যাদাকর পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে মানুষের জীবনমানের উন্নতি সাধন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি সমাজের শিক্ষিত,অর্ধ-শিক্ষিত তরুণ,যুবশক্তিকে কৃষির দিকে আকৃষ্ট করতে পারলে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে যা করোনায় আঘাতপ্রাপ্ত অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে।

একজন কৃষক কৃষিকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিবেচনা করে। কৃষির উন্নয়নে জড়িত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকেও এই বাস্তবতা অনুধাবন করেই পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা সমীচীন। সময় এসেছে লাভজনক কৃষির জন্য কৃষি উদ্যোক্তা বিনির্মানের বিষয়টিকে আরো গুরুত্ব দিয়ে ভাবার। শুধু টেকসই কৃষি উন্নয়ন নয় বরং জাতীয় অর্থনীতির কৌশলগত উন্নয়নে কৃষিতে উদ্যোক্তা সৃষ্টির বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকই প্রান্তিক। পুঁজির অভাব,প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির অপ্রতুলতা, তথ্যের ঘাটতি, বাজার চাহিদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা, বাজার ব্যবস্থার সাথে যোগাযোগের অভাব, উদ্যোক্তা হিসেবে করণীয় সম্পর্কে কার্যকরী প্রশিক্ষণ না থাকা ইত্যাদি কারণে কৃষকের পক্ষে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা কঠিন। উদ্যোক্তা হিসাবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দূর্বলতা এবং উদ্যোক্তা-বান্ধব পরিবেশ না থাকাও অন্যতম কারণ।

দুগ্ধশিল্পে ব্যাপকহারে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটাতে পারলে গুড়া দুধ আমদানীতে যে মুদ্রা ব্যয় হয় তা উল্লেখযোগ্য হারে কমানো যেত। কিন্তু, বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারিনি এবং দুগ্ধশিল্পে স্বনির্ভর হবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমদানিতে যেতে হচ্ছে। এমন অনেক কৃষিপণ্যের বেলায় তা সত্য।

আমাদের দেশে ছোট-মাঝারি ব্যবসা উদ্যোগ দৃশ্যমান রয়েছে যার অধিকাংশই মৎস্য শিল্প ও ডেয়রী-পোলট্রি খাতেই বেশি দেখা যায়। তাছাড়া ভার্মিকম্পোষ্ট, মাশরুম উতপাদন, ফল ও শাকসবজি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, কৃষি উপকরণ ব্যবসায় মাঝারি উদ্যোক্তা, স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন ইত্যাদি। বাংলাদেশের কৃষিতে উদ্যোক্তা সৃষ্টির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশে প্রায় ২ কোটি কৃষি পরিবার রয়েছে। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ সাপেক্ষে প্রতিটি কৃষি পরিবারকে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব। বিশেষ করে গ্রামীণ মহিলাদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির সুযোগ রয়েছে। খামার পর্যায়ে পণ্য উৎপাদন ও সার্ভিস প্রদান ভিত্তিক উদ্যোক্তা সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষি উপকরণ খাত ও খামারজাত উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বাজারজাতকরণ পদ্ধতির সাথে যুক্ত করে বাণিজ্যিক কৃষি প্রবর্তনের সাথে কৃষি উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে আমূল পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব। এতে করে কর্মসংস্থান যেমন তৈরি হবে তেমনি আয়ের বহুমুখীকরণ করা সম্ভবপর হবে। খাদ্যের মূল্য হ্রাস করে গ্রামীন ও শহুরে দরিদ্রদের খাবারমানের উন্নতি হবে। বাড়বে উৎপাদিত পণ্যের গুনগত মান যা রপ্তানী শিল্পের বিকাশে অবদান রাখতে পারবে।

আমাদের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুবক। বিভিন্ন কারণে যুবসমাজের ৩০ ভাগের বেশি অংশ দেশের অর্থনীতিতে কোন অবদান রাখতে পারছে না। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ যুবক শ্রমবাজারে আসছে যার মধ্যে ১২ থেকে ১৩ লাখ যুবক কাজের সুযোগ পায়। প্রায় ৭ লাখের বেশি যুবশক্তি প্রতি বছর বেকার থেকে যায়। করোনার প্রভাবে এই পরিসংখ্যান ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে এটি সহজেই অনুমেয়।

ক্রমবর্ধমানহারে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত তরুণ, যুবাদের কর্মসংস্থানের অভাব শুধু অর্থনীতির জন্য সমস্যা নয় বরং এর সামাজিক কু-প্রভাব বিদ্যমান। বিভিন্ন ধরণের অপরাধ, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি ও সামাজিকভাবে অগ্রহনযোগ্য কাজে যুবশক্তি জড়িয়ে যেতে পারে। এই যুবারা যদি কৃষি উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে করোনাকালীন কর্মসংস্থান সংকট কাটিয়ে কৃষিতে হাই-টেক প্রযুক্তির ছোঁয়া আনা অসম্ভব কিছু নয়। বাণিজিক কৃষির দুয়ার উন্মোচনে করতে হলে তরুণ,যুবাদের কৃষিতে টানতে হবে। কিন্তু যতদিন কৃষিখাত যুবাদের কাছে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং সামাজিকভাবে মর্যাদাকর অনুভূত নাহবে ততদিন এই খাতে তাদের শ্রম-শক্তি-মেধার বিনিয়োগ কম হবে।

একটি বিষয় আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে, এই ডিজিটাল যুগে যুবারা নিজের ও পরিবারের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড জীবনমান প্রত্যাশা করে। কৃষি সেক্টর তাদের সেই প্রত্যশা পূরণে সমর্থ, এই বিষয়টি তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। দেশে এমন অনেক সফলতার গল্প আছে যা ব্যাপক প্রচার করে এটি নিশ্চিত করা যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এই কাজটিকে আরো বেগবান করতে পারে।

উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ স্কীম চালুকরণ এবং একটি পরিকল্পিত মডেল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামে উদ্যোক্তা বিষয়ক আধুনিক ধ্যান-ধারণা ও কেস স্টাডি অন্তর্ভূক্তকরণ জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশীয় বাস্তবতার নিরীখে কারিকুলাম ডেভেলপ করার মানসিকতায় ঘাটতি রয়েছে। কৃষি ব্যবসা ও বাণিজ্যিক কৃষির স্টার্ট-আপ বিষয়ে যুবা-তরুণদের উৎসাহিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে।

ইতোমধ্যে আমরা ব্যক্তি উদ্যোগে চলমান “কৃষি বায়োস্কোপ” কর্মসুচীর মাধ্যমে দেখেছি আইসিটি ব্যবহার করে খুব অল্প সময়ে লাভজনক কৃষি প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি কৃষিতে তরুণ-যুবাদের আগ্রহ সৃষ্টি করা সম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তরুণ, যুবাদের কৃষিতে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে থাইল্যান্ডের “ ইয়াং স্মার্ট ফারমার”, ভারতের দ্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচার এর “ এট্রাকটিং অ্যান্ড রিটেইনিং ইয়ুথ ইন এগ্রিকালচার” কর্মসূচির কথা উল্লেখ করা যায়। দেশের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এই জন্য নতুন করে ভাবতে পারে।

প্রয়োজনীয় সাপোর্ট নিশ্চিত করা গেলে তারুণ্যের শক্তি প্রান্তিক কৃষি ব্যবস্থার ভগ্ন ও তুলনামূলক কম আকর্ষনীয় ইমেজকে সতেজ করে নতুন ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে পারে। জাতীয় নীতি নির্ধারণী পর্যায়েও তরুণ-যুবাদের আরো কীভাবে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করা যায় সেই প্রচেষ্টার প্রতিফলন প্রয়োজন।

করোনায় সৃষ্ট সংকটে নতুন গ্রামীণ বাস্তবতায় কৃষিতে আধুনিক ধ্যান ধারণার সর্বোচ্চ বিকাশে প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে কাজ করার সময় এখন। কৃষক এখন আর শুধু ফসল উৎপাদনকারী নয়, সে এখন কৃষি উদ্যোক্তা বটে- এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের কৃষিতে রেনেসাঁ আনতে পারে।

বর্তমান কৃষিমন্ত্রী একজন প্রথিতযশা কৃষি বিজ্ঞানী, অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পরই অত্যন্ত সফলতার সাথে সংকটের এই সময়েও কৃষি উৎপাদন শুধু অব্যাহতই রাখেননি বরং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে কৃষিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। বাণিজ্যিক কৃষির প্রবর্তনে নিচ্ছেন নতুন নতুন কর্মসুচী। এই জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ ও নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কর্তৃক ঘোষিত বাজেটে কৃষি খাতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগাধিকার খাত হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে।

“ আজকের গ্রামের তরুণ-যুবা হোক আগামীকালের কৃষি উদ্যোক্তা” করোনার আঘাত থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেশের কৃষি এই নতুন মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত হোক- এটাই সকলের প্রত্যাশা।

লেখক: আইপিএম স্পেশালিষ্ট, পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঢাকা। ইমেইলঃ jewellbau@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *