শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ বিষয়ে সানেমের ওয়েবিনারশ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ বিষয়ে সানেমের ওয়েবিনার

নিউজ ডেস্কঃ
দেশে মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রধান বাধা হলো দেশীয় অর্থায়নের অভাব, বৈশ্বিক মন্দা, রফতানি চাহিদা ও বাণিজ্য আত্মবিশ্বাসে ধস। অন্যদিকে আত্মকর্মসংস্থান তৈরিতে প্রধান বাধা দেশীয় চাহিদার শ্লথগতি, পুঁজি সংকট, অর্থায়ন পাওয়া ও অনানুষ্ঠানিকতা। আর এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণের শর্ত শিথিল করা ও সুদের হার কমানো, প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ না করে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিতরণ, দেশ-ফেরত প্রবাসী, নারী উদ্যোক্তা ও তরুণদের জন্য আলাদা ঋণের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত ‘কভিড-১৯ ও বাংলাদেশের শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা থেকে এমন প্রস্তাব দিয়েছেন বক্তারা।

গতকাল বেলা ১১টায় ওয়েব কনফারেন্স অ্যাপ জুমের মাধ্যমে আয়োজিত সানেম সংযোগের ষষ্ঠ পর্বের ওয়েবিনারটি পরিচালনা করেন সানেমের রিসার্চ ইকোনমিস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মাহতাব উদ্দিন। সানেমের গবেষণা পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

ওয়েবিনারটিতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) অধ্যাপক শামসুল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুয়োমো পুটিয়ানেন। সানেমের এবারের সংযোগে আলোচক ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন। ওয়েবিনারটিতে গবেষক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, উন্নয়নকর্মী, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরাসহ প্রায় ৬০ জন অংশ নেন।

ওয়েবিনারে স্বাগত বক্তব্যে মাহতাব উদ্দীন সংযোগের এ পর্বের প্রেক্ষাপটের ওপর আলোকপাত করেন এবং বাংলাদেশের শ্রমবাজারের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় তিনি প্রবাসী শ্রমবাজার, উৎপাদন খাত ও শহুরে অনানুষ্ঠানিক খাতের অবস্থা সম্পর্কে তার সার্বিক মূল্যায়ন তুলে ধরেন।

সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক শামসুল আলম শ্রম ও কর্মসংস্থান সম্পর্কিত বাংলাদেশ সরকার গৃহীত নীতিগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী যে পরিমাণে কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সেই পরিমাণে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি।

মূল প্রবন্ধে ড. সায়মা হক বিদিশা বর্তমান অবস্থার একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি দেশীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে চাহিদা সংকট এবং ফলশ্রুতিতে আয় ও কর্মসংস্থান হ্রাস নিয়ে আলোচনা করেন। কভিড-১৯ মহামারীর আগে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে শ্রম দক্ষতা ও শ্রম চাহিদার অসামঞ্জস্যতা, শিক্ষার মান, শ্রমবাজারে নারীদের কম অংশগ্রহণ, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের বিস্তার, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, চাকরি হ্রাস, ভালো চাকরি, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অনানুষ্ঠানিকতা নিয়েও আলোচনা করেন তিনি।

ড. বিদিশার প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনায় সানেমের চেয়ারম্যান ড. বজলুল হক খন্দকার বলেন, মহামারীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক নীতি অন্য দেশের তুলনায় শক্তিশালী নয়।

বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে গবেষণায় তথ্যের সংকট একটি বিরাট সমস্যা উল্লেখ করে ড. আহসান এইচ মনসুর তার আলোচনায় বলেন, দেশের সামনে এখন তিনটি চ্যালেঞ্জ: কভিড-১৯ রোগের বিস্তার ঠেকানো, কর্মসংস্থান ও জীবিকা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার। অর্থনীতি সচল করার পর থেকে এটির গতি ধীরে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। তবে এতে হয়তো পুরোপুরি অনুকূল অবস্থানে পৌঁছানো যাবে না।

ড. মনসুর আরো বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি হবে না, যদি মহামারী পরিস্থিতির উন্নতি না হয়। অন্যদিকে সরকারি খাতে বিনিয়োগ হলেও সম্পদ ও সামর্থ্য নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যায়।

তিনি আরো বলেন, চীন থেকে সরে আসা বিনিয়োগগুলোকে আকৃষ্ট করা বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কৌশলের অংশ হওয়া উচিত। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বিতরণের জন্য তাগাদা দেন তিনি।

দেশে প্রবৃদ্ধি হলেও সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না উল্লেখ করে ড. রায়হান বলেন, শ্রমবাজারের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী না। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি শ্রম ও কর্মসংস্থান কমিশন গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন ড. রায়হান। এছাড়া শ্রমবাজারের জন্য বিশেষায়িত নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণের জন্যও প্রস্তাব করেন তিনি। তার মতে, চলমান স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার আবশ্যক।

সরকারি কর্মসংস্থান কর্মসূচির ওপর জোর দিয়ে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে টুয়োমো পুটিয়ানেন বলেন, প্রণোদনা শুধু বড় ব্যবসা বা তারল্যের জন্যই না। এর মাধ্যমে চাকরি ও কর্মসংস্থানের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। এ সময় তিনি বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরবরাহ শক্তিশালী করে তোলার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক শামসুল আলম ওয়েবিনারে উপস্থাপিত গবেষণা প্রবন্ধের ওপর বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, অনেক কিছুই নির্ভর করছে আগামী দিনে মহামারী সংক্রমণের পরিস্থিতি কেমন হয় তার ওপর।

মহামারীতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের বিষয়ে অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের যে সুদের হার তাদের বহন করতে হবে, তার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বহন করবে সরকার। আর ৪ দশমিক ৫ শতাংশ তারা নিজেরা বহন করবে। ফলে সুদের হার আরো কমানোর যৌক্তিকতা আছে কিনা, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
সুত্রঃ বনিক বার্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *