খাদ্য নিরাপত্তায় আত্মপোষণশীল কৃষিঃ একটি করোনাকালীন ভাবনাখাদ্য নিরাপত্তায় আত্মপোষণশীল কৃষিঃ একটি করোনাকালীন ভাবনা

কৃষিবিদ কামরুল ইসলামঃ
কোভিড-১৯ বা করোনা মহামারীর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। পৃথিবীর খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। কোনো কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ আজ লকডাউনের বেড়াজালে বন্দি। বিশ্বায়নের এই প্রভাব বাংলাদেশের কৃষিতে এসে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ( ১৯৯৮) এর মতে, “শুধু খাদ্য উৎপাদন কম হলেই দুর্ভিক্ষ হয় না- প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের পরও নীতিনির্ধারণে দুর্বলতা থাকলে, সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কম হলে এবং খাদ্য সরবরাহ বৈষম্য হলে; সেক্ষেত্রেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে ’’।
বাংলাদেশের প্রায় ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে যাদের অধিকাংশেরই উপার্জনের উৎস কৃষি। বাংলাদেশে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ ০.১২ একর। জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪.১০ শতাংশ। ফসল সেক্টরের একার অবদান ৭.৩৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনশক্তির ৪০ শতাংশ কৃষির সাথে জড়িত । বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের জন্য মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ জমি আবাদ করতে হয়। বাকি অংশ বনাঞ্চল, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্রসৈকত, নদী, খাল-বিল, শহরাঞ্চল, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত হয়- কিছু অংশ পতিত যার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এমনকি তাও বাড়তি জনসংখ্যার জন্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, শহরাঞ্চলের পরিধি বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দিন দিন কমছে। বিবিএসের তথ্য মতে, বাংলাদেশ বর্গাচাষি ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা যথাক্রমে ৬.৫ এবং ২.৩ মিলিয়ন। বাংলাদেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ১৫.২ মিলিয়ন। আমাদের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২১ মিলিয়ন একর। চাষযোগ্য জমি নেই এ রকম পরিবারের সংখ্যা আনুমানিক ১২ শতাংশ।
কৃষি উৎপাদন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরিভাবে যে মানবসম্পদ জড়িত, তাদের একটি বড় অংশ হলো প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্রচাষি। ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র পরিবারগুলো ফসল উৎপাদনের কর্মকাণ্ডের অন্যতম চালিকাশক্তি। এরা নিজেদের জমিতে চাষাবাদ করে, অন্য চাষিদের জমি বর্গা অথবা লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে এবং ফসলের মৌসুমে অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।
কৃষির সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের কৃষকের প্রাণ। কৃষির উন্নতি না হলে কৃষকের উন্নতি হবে না। কৃষির উন্নতি যদি বাধাগ্রস্ত হয় তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই কৃষির উন্নতি সাধিত হলে কৃষকের ও দুর্দশা লাঘব হবে। আর এই করোনাকালীন সংকটে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ‘‘আত্মপোষণশীল কৃষি’’ হতে পারে অন্যতম একটি মাধ্যম।
আত্মপোষণশীল কৃষি হচ্ছে সেই ধরনের কৃষি ব্যবস্থা, যেখানে একজন কৃষক নিজের এবং পরিবারের প্রয়োজনীয় ফসল ফলাবে, উদ্বৃত্ত অংশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে অন্যান্য দৈনন্দিন চাহিদা পূরন করবেন। এই ব্যবস্থায় দুটো বিষয় মাথায় নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে হয়। প্রথমত, তার পরিবারের জীবনধারনের জন্য কি ফসল প্রয়োজন তা বিবেচনায় নিতে হবে সর্বাগ্রে; দ্বিতীয়ত, কিছু উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রয় করতে হবে যা দিয়ে তার খাদ্য ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা যেন পূরণ হয়। বিখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী টনি ওয়েটার্স বলেছেন, “আত্মপোষণশীল কৃষক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যা তিনি খান, তা তিনি নিজে ফলান, যা তিনি নির্মাণ করেন তা নিজ ঘরে করেন এবং প্রাত্যহিক বাজার থেকে কেনা ব্যতিরেকে জীবনধারণ করেন । ’’
আত্মপোষণশীল কৃষি ব্যবস্থা আপদকালীন সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল, বাজারে মূল্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সীমিত সম্পদ ও স্বল্প আর্থিক সুবিধা সম্পন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলো অতি সহজেই এই ব্যবস্থাকে সামাজিক সহায়তার প্রোগ্রামে অন্তর্ভ্ক্তু করে সামজিক নিরাপত্তাসহ দেশীয় বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করতে পারে। নিম্ন আয়ের ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ৮০% এর উপরের জনগণ গ্রামে বাস করে তথাপিও ৯০% সেই গ্রাম্য জনগণের বাড়ির আশেপাশে কিছু না কিছু জায়গা আছে কিন্তু নাই শুধু পরিকল্পনা। আর আপদকালীন সম্ভাব্য খাদ্য সংকট থেকে “আত্মপোষণশীল কৃষি ব্যবস্থা” এর মত ধারণার সফল বাস্তবায়ন স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে একটি দেশকে এনে দিতে পারে সামজিক নিরাপত্তা সহ সুশৃংখল খাদ্যবিন্যাস।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আপদকালীন সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আত্মপোষণশীল কৃষি অনেক কার্য্করী ব্যবস্থা । এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশে আত্মপোষণশীল কৃষির সূত্রপাত হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এটা গ্রহন করে। যেমন মেক্সিকো ভূট্টা নির্ভ্র কেন্দ্রিক আত্মপোষণশীল কৃষি ব্যবস্থা চালু করে। দক্ষিণ-পূব্র্ এশিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনিতে আত্মপোষণশীল উদ্যান ফসল চাষ পদ্ধতি অত্যন্ত জনপ্রিয় । ১৯৫০ সালে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় আত্মপোষণশীল কৃষি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে, এ সময়ে সে সমস্ত নাগরিকগণ নিজের খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন শুরু করে, নিজের পোশাক নিজে বানানো শুরু করে এবং নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু বিক্রয় করাও শুরু করে। বিভিন্ন পেশার মানুষ বিশেষ করে ফিজিসিয়ানস, ভেটেরিনারিয়ানস, কামার, কুমারসহ পেশার নাগরিকরা মুদ্রার বদলে কৃষি পণ্যের মাধ্যমে বিনিময় প্রথা শুরু করেছিল। ১৯৯০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে মধ্য এবং পূব্র্ ইউরোপের দেশগুলোতে আত্মপোষণশীল কৃষি ব্যবস্থা র্কাযকর ভূমিকা পারন করে ।
মূল্যস্ফীতি নিয়নন্ত্রণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন,শহর ও গ্রামের খাদ্য ঝুঁকি কমাতে আত্মপোষণশীল কৃষি গুরুত্বপূণ্র্ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে করে টেকসই কৃষির বিকাশ ঘটে একদিকে, অন্যদিকে আস্তে আস্তে তা মানুষের মননে বাণিজ্যিক কৃষির প্রতি আগ্রহ সৃস্টি করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ কৃষি জরিপের তথ্যমতে, দেশে সাধারণ খানা আছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ। এর মধ্যে গ্রামে বসবাস করছে ২ কোটি ৯৬ লাখ। নিজস্ব কোনো জমি নেই এবং অন্যের জমি বর্গা নিয়ে থাকে এমন খানার সংখ্যা ১ কোটি ৮ লাখ। বাকি প্রায় দুই কোটি কৃষককে বসতবাড়িতে সবজি আবাদ করানো সম্ভব। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী তথা বাংলাদেশ খাদ্যাভাবের মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে, এমন সতর্কতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো জমি অনাবাদি না রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি কৃষিখাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্রদান করার ঘোষণা করেছেন। তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের জন্য চার শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে সবজি আবাদে উৎসাহিত করতে দেশের প্রতিটি বসতবাড়িকে সরকারিভাবে প্রণোদনার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এর আওতায় বসতবাড়িতে সবজি আবাদে প্রয়োজনীয় বীজ, সার ছাড়াও বেড়া তৈরিতে সহায়তা করা হবে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ৩২ টি করে পরিবারে কালিকাপুর মডেলে বসতবাড়িতে সবজি উৎপাদনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, যা আত্মপোষণশীল কৃষি বাস্তবায়নের প্রধান ধাপ। সবজি প্রনোদনার সাথে সাথে কিছু ফল গাছ লাগানো, রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো ও নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির ক্ষেত্রেও প্রনোদনা দেওযা যেতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি পুনর্বাসনে ১২০ কোটি টাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতিপূরণ ও সমবায়ভিত্তিক (সমলয়ে) চাষাবাদের জন্য ৫০ কোটি টাকা এবং ফসলে নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য প্রদর্শনী স্থাপন ও গ্রহণকরণ বাবদ ৭৫ কোটি টাকা ইতোমধ্যে বরাদ্দ প্রদান করেছে। অতিসম্প্রতি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও বীজ, সেচ ইত্যাদিসহ কৃষিখাতে সহায়তা বাবদ ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষক পর্যায়ে ডিএপি সারের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দেশের হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় কৃষকের জন্য ৭০শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ হারে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩শ ২২ কোটি ৮০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। দারিদ্র্য, ঘনবসতি, নগরজীবনের নানা অনিশ্চয়তা, জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সর্বোপরি করোনাকালীন এই সংকট মোকাবেলায়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আত্মপোষণশীল কৃষি হতে পারে সমৃদ্ধি সোপানের প্রধান নিয়ামক।
এ ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যে চেতনাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। বর্তমান সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সবোর্চ্চ গুরুত্ব প্রদান করে কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণকে সবোর্চ্চ বিবেচনায় নিয়ে নানমুখি প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮, এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি,৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্লান: ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেই কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপায়িত হবে।
লেখক,
কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম
৩৫ তম বিসিএস (কৃষি)
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার।
পৃঠিয়া, রাজশাহী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *