নিউজ ডেস্কঃ
পাট উৎপাদনে বর্তমানে বাংলাদেশ ২য় এবং রপ্তানিতে ১ম। দেশে দিন দিন পাটের আবাদ বাড়ছে সাথে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও। সেজন্য গুনগত মানের পাট বীজের বিকল্প নেই।ভালো বীজের ভালো ফলন কথাটা কৃষক ভাইরা ভালো করেই জানেন।কারণ তারা প্রায় সময়ই বাজার থেকে গুনগত মান সম্পন্ন বীজ না পেয়ে প্রতারিত হন। সেজন্য বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কৃষকদের পাট বীজ করার জন্য নিজের বীজ নিজে করি প্রযুক্তিটির উপর গুরুত্বরোপ করেন। আজ আমরা পাট বীজ উৎপাদন পদ্ধতি ও সংরক্ষণের কলাকৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
মূলত পাট বীজ ফসল দুভাবে উৎপাদন করা যায়-
ক) আঁশ ফসলের সময় পাট বীজ উৎপাদন :-
সাধারনত কৃষক পাট আঁশ ফসলের ক্ষেতের এক কোণায় কিছু পাট গাছ বীজ উৎপাদনের জন্য বেঁধে রাখেন যা থেকে পরবর্তীতে পাট বীজ সংগ্রহ করে থাকেন। আবার
খ) নাবী পাট বীজ উৎপাদন ঃ-
নাবী শব্দের অর্থ দেরীতে বীজ বপন করে পাট গাছের দৈহিক পর্যায়ের বৃদ্ধির সময় কমিয়ে, জনন পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এর ফলে পাট গাছের বৃদ্ধি কম হলেও অধিক সংখ্যক ডালপালাসহ সুপুষ্ট ফল ও উন্নতমানের অধিক সংখ্যক বীজ উৎপাদন করা যায়।
আঁশ ফসলের সময় পাট বীজ উৎপাদন করতে কি কি সমস্যা এবং করনীয় –
তোষা পাটের জমিতে বন্যার পানি উঠলে পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে গাছ মরতে শুরু করে এবং তাতে প্রায় সমগ্র গাছ মারা যায়, ফলে বীজ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে তোষা পাট বীজের সংকট দেখা দেয়। আবার, দেশী পাটের জমিতে বন্যার পানি উঠলেও বেশ কিছু বীজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আঁশ ফসলের গাছ দীর্ঘদিন মাঠে থাকার ফলে ঝড়, শিলাবৃষ্টি, বন্যা, রোগ, পোকা-মাকড়ের আক্রমণে গাছ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সেই গাছ থেকে মানসম্মত বীজ পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায় ।
নাবী পাট বীজ উৎপাদন পদ্ধতি-ঃ-
মোটামুটিভাবে তিনটি পদ্ধতিতে নাবী পাট বীজ উৎপাদন করা যায়। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে-
ক) সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতি
খ) কান্ড ও ডগা রোপন পদ্ধতি
গ) চারা রোপন পদ্ধতি
সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতিঃ-
পদ্ধতিতে দেশী ও তোষা পাট এবং কেনাফ ও মেস্তার পাট ফসলের বীজ উৎপাদন করা হয়।
শ্রাবণ মাসের প্রথম থেকে ভাদ্র মাসের শেষ সময় (মধ্য জুলাই- সেপ্টেম্বর) এর মধ্যে পাট বীজ বপন করতে হয়।
দেশী ও তোষা পাটের বেলায় প্রায় কাছাকাছি পরিমাণ সারিতে প্রতি শতাংশ জমিতে ১৬-২০ গ্রাম বীজ অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে ৫ কেজি বীজ অথবা একরে ২ কেজি বীজ বপন করতে হয় এবং ছিটিয়ে বপন করলে শতাংশে ২৫-৩০ গ্রাম বীজ এবং কেনাফ প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম বীজ অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে ১২ কেজি অথবা একরে ৫ কেজি বীজ বপন করতে হয়। ছিটিয়ে বুনলে বীজের পরিমাণ কিছুটা বেশি লাগে।
কান্ড ও ডগা রোপন পদ্ধতিঃ- এ পদ্ধতিতে ডগা নির্বাচনের উপর্যুক্ত সময় হলো শ্রাবণ মাসে (মধ্য জুলাই) গাছের বয়স যখন ১০০-১১০ দিন তখন আঁশ ফসলের জমি থেকে সুস্থ ও সবল সতেজ গাছের কান্ড ও ডগা বেছে নিতে হবে। তবে যে সব মাতৃগাছে ফুল ধরেনি কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে ফুল আসবে, সেসব গাছের কান্ড ও ডগা নির্বাচন করতে হবে। গাছ নির্বাচনের পর ডগাগুলো ধারালো চাকু বা ব্লেডের সাহায্যে তেরচা বা ৪৫ ডিগ্রি কোণে কেটে নিতে হবে। প্রতিটি ডগার দৈর্ঘ্য ২০-২৫ সেঃ মিঃ হতে হবে। ডগা কাটার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কাটা জায়গা থেতলে না যায় এবং ডগা সংগ্রহ করার সাথে সাথেই রোপন করতে হবে। তবে মেঘলা দিনে বা পড়ন্ত বিকাল বেলা ডগা রোপন করা উত্তম। ডগা/কান্ড সারি করে রোপন করতে হবে। লাইন থেকে লাইন এর দুরত্ব ৩০ সেঃ মিঃ এবং ডগা থেকে ডগার দুরত্ব ১০ সেঃ মিঃ হতে হবে। প্রতিটি ডগার প্রায় ৫ সেঃ মিঃ পরিমাণ অংশ ৪৫ ডিগ্রী কোণে অর্থাৎ তীর্যকভাবে মাটির নীচে পুতে দিতে হবে।
চারা রোপন পদ্ধতিঃ-
এ পদ্ধতিতে আষাঢ়ের শেষ থেকে শ্রাবণ মাসের (জুনের শেষ থেকে জুলাইয়ে মাঝামাঝি) সময়ের মধ্যে ৩ মিঃ দৈর্ঘ্য ও ১ মিঃ প্রস্থ আকারের বীজতলায় ৫০-১০০ গ্রাম বীজ বপন করে চারা উৎপাদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আষাঢ় -শ্রাবণ (১৫ জুন-১৫ জুলাই) মাসে বপনকৃত বীজতলার চারার বয়স ২০-২৫ দিন হলে চারাগুলো ভাদ্র মাস থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি ( জুলায়ের শেষ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত রোপন করা যায়। বীজতলা থেকে চারা তুলে নিয়ে ছায়ায় রাখতে হবে। প্রতিটি চারার ডগার ২/৩ টি পাতা রেখে অন্যান্য সব পাতার বোটা বাদে বাকী অংশ কাঁচি দিয়ে কেটে দিতে হবে। বীজতলা থেকে যেদিন চারা তুলা হবে ঐদিনই মূল জমিতে চারা রোপন করা ভাল। মূল জমিতে সারি থেকে সারির দুরত্ব হবে ৩০ সেঃ মিঃ বা ১ ফুট এবং চারা থেকে চারার দুরত্ব ১০ সেঃ মিঃ বা প্রায় ৪ ইঞ্চি করে চারা রোপন করতে হবে। মেঘলা দিনে অথবা সন্ধ্যার আগে যখন রোদ থাকে না তখন চারা রোপন করার সঠিক সময়।
বীজ ফসলের পরিচর্যা, আগাছা দমন, সার প্রয়োগ ও রোগ, পোকামাকড়ে করনীয়ঃ-
মাঝে মাঝে আঁচড়া বা নিড়ি দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরে রাখতে হবে।যদিও অনেক সময় বৃষ্টি থাকায় জমিতে কিছুটা পানি জমে থাকে তখন কাঁচি দিয়ে আগাছা অথবা অনেক এলাকায় এক ধরনের আগাছা কাটার অল্প মূল্যের যন্ত্র পাওয়া যায় যা দিয়ে আগাছাকে দমিয়ে রাখা যায়। ২য় কিস্তির সার প্রয়োগের ২/১ দিন পূর্বে নিড়ানী দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। শেষ বা ৩য় কিস্তির সার প্রয়োগের পূর্বে আরও একবার নিড়ানী দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। জমিতে আগাছা বেশী হলে সানরাইজ ১০৫ ডব্লিউ জি ৫ শতক জমির জন্য ৪ গ্রাম, ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে এবং হুইপ সুপার ৯ ইসি ৫ শতকের জন্য ১৩ মিলিমিটার, ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করে মূথা,ক্ষুদে শ্যামা, আঙ্গুলী ঘাসসহ অন্যান্য আগাছা দমন করা যায়।
সার ব্যবস্থাপনাঃ-
তোষা পাটের বীজ উৎপাদনের জন্য প্রতি শতকে জমিতে ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম, টিএসপি ৩০০-৪০০ গ্রাম, এমপি ১৮০ গ্রাম, জিপসাম ৩০০-৪০০ গ্রাম শেষ চাষে প্রয়োগ করতে হবে। কেনাফ ও মেস্তার ক্ষেত্রে শেষ চাষে প্রতি শতক জমিতে ইউরিয়া ৩৫০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০ গ্রাম, এমপি ১২৫ গ্রাম, জিপসাম ২০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। গাছে রোগ দেখা দিলে ডাইথেন এম-৪৫, ৯ গ্রাম প্রতি ৫ লিঃ পানিতে মিশিয়ে প্রতি শতাংশ জমিতে দুদিন পর পর কমপক্ষে দুবার ছিটিয়ে দিতে হবে। মাঝে মাঝে মাঠ পরিদর্শন করে রোগাক্রান্ত গাছ শিকড়সহ উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে অথবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ফসল সংগ্রহের উপযুক্ত সময় ও বীজের ফলন
দেশী ও তোষা পাট এবং কেনাফসহ সকল জাতের পাট গাছের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ফল বাদামী রং ধারণ করলে গাছের গোড়া সহ কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হয়। মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে পাকা ফল সংগ্রহ না করাই উত্তম। পাট, কেনাফ ও মেস্তার ক্ষেত্রে বীজের ফলন ক্ষেত্র বিশেষে প্রতি শতকে ২-৩ কেজি এবং প্রতি একরে প্রায় ২০০-৩০০ কেজি হয়ে থাকে।
পাট বীজ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
আমাদের দেশের চাষ যোগ্য জমির পরিমান কিন্তু দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে পাটের জমি অন্যান্য ফসলের আওতায় চলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অল্প জমিতে উৎপাদিত পাট বীজ দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করতে না পারলে বপনের সময় পাট বীজের প্রকট সংকট দেখা দেয়। তাই পাট বীজ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরী।
কারণঃ-
• পাট বীজের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে সহজেই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, রোগ, পোকা -মাকড় সহজেই বীজকে আক্রমণ করে।
• প্রাকৃতিক দুর্যোগে বীজ ফসল নষ্ট হয়ে গেলে আপদ কালীন মজুদ হিসাবে বীজের সংকট দেখা দিবে।
• পরবর্তী বপন মৌসুমে ভাল বীজ পাওয়ার জন্য বীজ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
• বীজে সুপ্তাবস্থা দীর্ঘায়িত করার জন্য সংরক্ষণ প্রয়োজন।
কৃষক পর্যায়ে পাট বীজ যেভাবে সংরক্ষণ করা যাবে
আমাদের দেশের বেশীর ভাগ পাটচাষিই ক্ষুদ্র চাষী এবং তাদের বীজের পরিমাণও কম লাগে। তাই বীজ সংরক্ষণের পূর্বে সংগ্রহকৃত বীজের মধ্যে গাছের ডাল-পালা, ফলের খোসা, মাটির কণা, চিটা বা অর্ধ পুষ্ট, রোগাক্রান্ত বীজ এবং অন্যান্য আবর্জনা থাকলে তা ভাল করে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ভালভাবে শুকানোর পর শুকনো বীজকে দুই দাঁতের ফাঁকে নিয়ে চাপ দিলে যদি কট করে বীজটি ভেঙ্গে যায়, তাহলে বুঝতে হবে বীজ ভাল ভাবে শুকানো হয়েছে। শুকানোর পর বীজের আর্দ্রতা যখন শতকরা ৮-৯ এর কাছাকাছি কিন্তু কোন অবস্থায় ই ১০% এর বেশি নয়, তখন তখন টিনের কৌটা, প্লাষ্টিকের ক্যান, প্লাষ্টিক ড্রাম ইত্যাদি বায়ুরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করা ভাল। যদি বায়ুরোধী পাত্র না পাওয়া যায় তখন মাটির কলসী, হাড়ি বা মটকায় বীজ রাখা যেতে পারে। তবে এসব পাত্রে বীজ রাখার পূর্বে মাটির কলসী, হাড়ি বা মটকায় আলকাতরা বা রংয়ের প্রলেপ দিতে হবে অথবা বীজ রাখার পুর্বে মোটা পলিথিন দিয়ে ভালভাবে ঐ পাত্র মুড়ে দিতে হবে যাতে মাটির পাত্রটি বায়ুরোধী হয়। বড় পাত্রে কম পরিমান বীজ রাখা ঠিক হবে না। কারণ এতে করে পাত্রের খালি অংশের আর্দ্রতা বীজের গুনগত মানকে নষ্ট করে দিতে পারে। সঠিক আর্দ্রতায়, সাধারণ তাপমাত্রায় লেমোফয়েল ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করলে প্রায় ৩ বছর পর্যন্ত বীজ ভাল থাকে। বায়ুরোধী প্লাষ্টিক বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণকৃত বীজ প্রায় ২ বছর পর্যন্ত ভাল থাকে। আর অন্যান্য পাত্র যেমন- পাতলা পলিথিন ব্যাগ, কাপড়/ছালা বা কাগজের ব্যাগ অথবা সরাসরি মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করলে তা ৩-৪ মাস পর্যন্ত ভাল থাকে।
কৃষক ভাইদের উদ্দেশ্যে এই মুহুর্তে পরামর্শ –
যাদের আমনের বীজতলা আছে তারা আমনের চারা উঠিয়ে ঐ জমিতে পাট বীজ করতে পারেন। যেহেতু বর্ষার সিজন তাই যাদের জমিতে বীজ ছিটিয়ে বপন করা সম্ভব নয় তারা এই মাসের মধ্যেই পাটের জন্য আলাদা অল্প উঁচু জমিতে বীজতলা করতে পারেন যা পরবর্তীতে চারা রোপণ পদ্ধতিতে বীজ করতে পারেন। কৃষক ভাইদের প্রতি অনুরোধ, আপনারাই দেশের প্রাণ যা মহামারী করোনা আমাদের সবাইকে আবারও আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আপনারা সাবধানে সচেতনতার সাথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করবেন। আল্লাহ আপনাদেরকে হেফাজতে রাখুন।
কৃষিবিদ মোঃ আবুল বাশার
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট,
আঞ্চলিক কেন্দ্র কিশোরগঞ্জ