ফজলুল করিম বাবলু:
রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত গোদাগাড়ীতে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি অধিক লাভজনক ড্রাগন ফলের চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ফল চাষে শিক্ষিত যুবকরা এগিয়ে আসছে। তারা চাকরীর পিছনে না দৌড়ে কৃষিতে মনোনিবেশ করতে শুর করেছে। এই ধরনের ফসল চাষ করে তারা বেকারত্বের গ্নানি থেকে মুক্ত হচ্ছে। গেদাগাড়ীর অনেক বেকার যুবক এখন বিভিন্ন ধরনের কৃষি ফসলের উপর প্রশিক্ষণ করতে শুরু করেছে। আর কাজ করে বেকার যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থানে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ। এতে করে একদিকে যেমন বেকারত্ব কমছে, তেমনি আগামীতে দেশের টাকা খরচ করে আমদানী করা বন্ধ হবে। সেইসাথে পুষ্টি ও ভিটামিনের চাহিদাও পুরণ হবে অনেকাংশে। গোদাগাড়ীতে এক যুগের বেশী সময় পূর্বে পানির অভাবে ধান ছাড়া তেমন কোন ফসলের চাষ হত না। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির উপর নির্ভর করে কৃষকেরা একটি মাত্র ফসল হিসেবে ধান চাষ করতেন। সময়ের বিবর্তনের সাথে ঘুরতে থাকে গোদাগাড়ী অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নের চাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অক্লান্ত পরিশ্রমে বরেন্দ্র অঞ্চল সবুজে ভরে উঠতে থাকে। সময়োপযোগী আধুনিক ও জলবায়ুসহিষ্ণু বিভিন্ন জাতের ফসলের বিস্তৃতিতে ধীরে ধীরে উত্তরের শস্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে এক সময়ের রুক্ষ মাটির অঞ্চল গোদাগাড়ী। এই এলাকার জমি উঁচু হওয়ায় এবং বন্যার পানি মাঠে প্রবেশ না করায় নিরাপদে চাষ করা যাচ্ছে বিভিন্ন জাতের ফল ও ফসল। অত্র উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় এই ড্রাগন ফলের চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে বাগানে গেলে গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নের পিরিজপুর গ্রামের বাসিন্দা শীষ মোহাম্মদ বলেন, পিরিজপুর এগ্রো ফার্ম নামে এই বাগানের মূল মালিক তার ভাবী আমেনা সিদ্দিকা খান। আমেনা মালিক হলেও বাগানের মূল দায়িত্বে রয়েছেন চাচা মাটিকাটা ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম শিক্ষক শরিফুল ইসলাম এবং তিনি নিজে। তারা তিনজন পর্যায়ক্রমে বলেন, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইউটিউব এর দেখে এই ফল চাষে আগ্রহী হন। এরপর গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের পরামর্শে ২০১৯ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে বাগান তৈরীর কাজ শুরু করেন। তারা বলেন, জমি ভাল করে চারটি চাষ দিতে হয়। এরপর প্রতিটি সারি ও বেডের দুরত্ব ৩মিটার বাই ৩মিটার পদ্ধতি অনুসরন করা হয়। এরপর চারপাশের মাটি তুলে বেড তৈরী করতে হয়। এরপর বেডের মাঝখানে শক্ত সিমেন্টের খুঁটি দিতে হয়। খুটি স্থাপনের পূর্বে বেডে ১০-১২ কেজি জৈব সার মাটির সাথে মিশ্রন করে ১০দিন রাখতে হয়। এর ড্রাগনের কাটিং রোপন করতে হয়। রোপন করে প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন বেডে পানি দিতে হয়। পরের সপ্তাহে ৩দিন পানি দেয়ার পরে সমস্ত জমি পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হয়। তবে জমিতে কোনভাবেই পানি জমে থাকতে দেয়া যাবেনা বলে জানান তারা। এর পর খরা মৌসুমে মাসে দুইবার করে পানি দিলেই চলে। তারা আরো কলেন, ভালো জাতের কাটিং হলে রোপনের এক বছরের মধ্যেই ফুল ও ফল আসে। তবে রোপনের ৩-৪ মাসের মধ্যে ফুল আসলে তা ভেঙ্গে দেয়াই ভাল বলে জানান। তারা বলেন, বিঘাপতি কাটিং রোপন থেকে শুরু করে ফল উত্তোলন পর্যন্ত সর্বমোট তিন লক্ষ টাকা খরচ হয়। তারা বলেন, এপ্রিল মাস হতে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সার্বক্ষণিক গাছে ফুল ও ফল আসে। প্রতি কেজি ফর বাজারে ৩৫০-৪০০টাকায় বিক্রি হয়। আর এক বিঘা জমিতে প্রায় দুই টন ড্রাগন ফল পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতি বছল এক বিঘা জমিতে ৮,৬৪,০০০টআকা আয় কার সম্ভব বলে জানান তারা। মাটিকাটা ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, ড্রাগন গাছ ও ফলের উল্লেখযোগ্য কোন রোগবালাই নাই। এরজন্য রাসায়নিক সার ও কিটনাশক এই বাগানে ব্যবহার করা হয় না। সম্পূর্ণ অর্গানিকভাবে এই ফলের চাষ করা হচ্ছে। সেইক্ষেত্রে এই ফল একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং সেচ একেবারেই কম লাগায় খরচ অনেক হয়। বর্তমানে তার বাগানে মোট ৪৫০০টি গাছ রয়েছে। চলতি মাসের ৬ তারিখ থেকে তারা ফল উত্তোলন ও বাজারজাত করণ শুরু করেছে বলে জানান তিনি। উপজেলা কৃষি অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেন- ড্রাগন একটি উচ্চ মূল্যের সুস্বাদু বিদেশি ফল। এই ফল ঔষধি গুণসম্পন্ন ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা মানুষের শরীরের জন্য ভালো। একবার লাগানো হলে প্রায় ১৫-২০ বছর ফল দেয়। পানি কম লাগে। বরেন্দ্র অঞ্চলে চাষের উপযোগী। বরেন্দ্র অঞ্চলে যেহেতু পানির সংকট রয়েছে তাই ড্রাগন ফলের চাষ এই এলাকার জন্য একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে চাষ করা যেতে পারে। কৃষি বিভাগ বরেন্দ্র অঞ্চলে ড্রাগন ফলের সম্প্রসারনে কৃষকদের পরামর্শ এবং সহযোগিতা করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন এই কৃষি কর্মকর্তা। কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মতিয়র রহমান বলেন, যেসব বিদেশি ফল এদেশে অভিযোজনের চেষ্টা করা হচ্ছে, তার মধ্যে ক্যাক্টাস পরিবারের এই ড্রাগন উল্লেখযোগ্য। কয়েক বছরের ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগনের চাষ হচ্ছে। শুরুতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করে লম্বা সময় ধরে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, প্রচুর পরিমাণ পুষ্টিগুনসম্পন্ন এই বিদেশি ফল লিভারের রোগ ও ডায়াবেটিকস-এর জন্য উপকারী। দিন দিন শিক্ষিত ও শহুরে সমাজে এই ফলের গুরুত্ব বাড়ছে বলে জানান মতিয়র। তিনি আরো বলেন, গোদাগাড়ীতে প্রায় ২.৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হচ্ছে। বরেন্দ্র মাটিতে খরাসহিষ্ণু ড্রাগন সহজেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে বলে বর্তমানে গোদাগাড়ী উপজেলায় ড্রাগন চাষের ভালো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।