গোলাপের কী হলো! মাঠে রং নেই, আঁধার দেখছেন চাষিরাগোলাপের কী হলো! মাঠে রং নেই, আঁধার দেখছেন চাষিরা

 

২০১৭ সালে একই রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন সাভারের গোলাপ চাষিরা। যে যাত্রায় কোনরকমে রক্ষা পেয়েছিলেন তারা। তবে ৪ বছরের পর নতুন বছরের শুরুতে আবার একই ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে পথে বসার অবস্থা তাদের। একদিকে করোনার আঘাত, তার ওপর অজানা রোগের দাপটে দিশেহারা এই ফুল চাষিরা।

গ্রামজুড়ে মানুষের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। সারাবছর কোনমতে থাকলেও ফেব্রুয়ারি মাসের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে ভালো দামে বেশি বিক্রির প্রত্যাশা থাকে কৃষকের। সৌভাগ্যের মাসেই চরম দুর্ভাগ্যের শিকার তারা।

তুরাগ নদীর কোলঘেঁষে সাভার বিরুলিয়ার ইউনিয়ন। ৯০ দশকে এই গ্রামে গোলাপ ফুলের চাষাবাদে বদলে যায় গ্রামের ভাগ্য। গ্রামগুলো পরিচিত পায় ‘গোলাপ গ্রাম’ হিসেবে। ইউনিয়নের সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, ভাগ্নিবাড়ি, মোছতাপাড়া, নয়াপাড়া গ্রামগুলোই এই গোলাপের রাজ্য। চাষির সংখ্যা প্রায় ৮ শতাধিক।

বিরুলিয়া গ্রামের ঢুকতেই লাল গোলাপের সারি সারি বাগান। সবুজ পাতার ফাঁকে টকটকে লাল গোলাপের হাঁসি। ব্যস্ত কৃষক। সেই অপরূপ দৃশ্য দেখতে ফুলপ্রেমীরা ছুটে এসেছেন গোলাপ রাজ্যে। গোধূলী লগ্নে স্থানীয় ফুলে বাজারে বসেছে লাখ লাখ ফুলের সমারহ। বিগত দিনে যারা গিয়েছেন, তারা এমন চিত্র দেখছেন। কিন্তু মাসের ব্যবধানে সেই চিত্র বদলে গেছে।

এখন সুবজ গাছের ফাঁকে বিপর্যস্ত ফুলের করুণ আর্তনাদ। পাঁপড়িসহ ফুলের বিবর্ণ রূপ, ঝড়ে পড়ছে মাটিতে। কৃষকের অক্লান্ত চেষ্টাতেও ভালো খবর নেই। হতাশ চাষিরা অনেকে ভাগ্য ওপর হাল ছেড়েছেন নিজেদের। ফুলের বাগানে ঘুরতে আসা দর্শানার্থীরাও হতবাক। বিবর্ণ ফুলের করুণ পরিণতির গল্প আর চোখে মুখে হতাশা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের। চাহিদা থাকলেও বাগানে ফুল নেই। যা পাওয়া যায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নেই মূলত গোলাপের চাষ হয়। এখানে ২৫০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়। এখন থেকে বছরে প্রায় ৭৫ কোটির ফুলের বাজার। প্রায় ৮ শতাধিক গোলাপ চাষি রয়েছে। করোনার কারণে বিগত দুই বছর সেই বিক্রির পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। রোগের বিষয়টি জানার পর ইতিমধ্যে গোলাপ গ্রাম ঘুরে কৃষি কর্মকর্তা ও গবেষকরা মাটিসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছেন। প্রাথমিকভাবে রোগটি শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কৃষককে পরামর্শও দিয়েছেন। তবে এই মৌসুমে প্রায় ১৯ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

একাধিক চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ডিসেম্বর শেষ দিকে বৃষ্টির পর থেকে গোলাপ বাগানে রোগে বিস্তার শুরু হয়। গাছে ফুল আসলেও ঝড়ে পড়ে। গাছের পাতা থেকে শুরু করে ফুলের পাঁপড়ি থেকে কেমন সাদা হয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। ওষুধ ছিটিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। প্রায় ৮০ শতাংশ ফুল চাষির বাগানেই এমন করুণ অবস্থা।

অনিক হোসেন নামের এক ফুল চাষি কালের কণ্ঠকে বলেন, আমাদের ব্যবসা হলো ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে। এই শীতের মাসেই আমাদের ব্যবসা। বৃষ্টির পর থেকে ফুলের কলি পচে যাচ্ছে। গত বছরে এ সময় আমাদের বাগানভরা ফুল থাকে। আমার এক বিঘা বাগান থেকে গত বছর দেড় লাখ টাকার ফুল বিক্রি করছি। এবার দেড় টাকাও বিক্রি হবে না। বাগানে ১০টা ফুলও নাই। আমাদের তো আর কোনো ব্যবসা নাই। এই গ্রামে সবাই ফুল চাষের ওপর নির্ভারশীল। কী কইরা আমরা খামু। দুই একটা বাগান ছাড়া সবই একই অবস্থা।

কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, কৃষি কর্মকর্তা মাঝে মধ্যে আসেন। গাড়ি নিয়ে আসেন, ঘুরে চলে যান। দেখে খাতায় লিখে দিয়ে যান। কৃষি কর্মকর্তার কথায় একটা বিষের ওষুধ দিছে বাগানে। পরে বাগানের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে।

আরেক ফুল চাষি আব্দুল খালেক বলেন, শীতের সময় বৃষ্টির কারণে গোলাপ বাগানে হয়তো এই সমস্যা হয়েছে। আমার এক বাগান ভালো থাকলেও আরেকটি ৬০ শতাংশের বাগান পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কলি পচে যায়, পাতা ঝড়ে পড়ে যায়। গাছের মাথা কিছু থাকে না। কৃষি অফিসার আসেন। তারা পুরেপরি বুঝতে পারছেন না। তাদের পরামর্শ ওষুধ ব্যবহার করে তেমন কোনো ফল পাইনি।

গোলাপ গ্রামে ঘুরতে আসা লামিয়া আক্তার বলেন, বন্ধুদের মুখ শুনে গোলাপ গ্রামে ঘুরতে এসেছি। কিন্তু যেমন শুনেছি, তেমনটা না এখন। গোলাপ নেই বাগানগুলো অনেক খালি খালি। যা শুনেছি। পুরোটাই অন্যরকম লাগতেছে। ফুলের দামও বেশি।

সাভার উপজেলার (বিরুলিয়া) উপ-সহকারী কৃষি অফিসার মোজ্জামেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা গোলাপের রোগের বিষয়টি জানতে পেরে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। সদর দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও গবেষক দল গ্রাম ঘুরে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছেন। প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, পাউডারি মিলডিউ ছত্রাক রোগের আক্রান্ত হয়েছে। সে অনুযায়ী কৃষককে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আরো কিছু নমুনার পরীক্ষা নীরক্ষিা চলছে। সেগুলো এখনো হাতে পাইনি। কিছু বাগানে গাছের পাতা ঝড়া, আগা ও ডগা মরা রোগও দেখা গেছে।

তিনি আরো বলেন, গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী, ছত্রাক প্রতিরোধে থিওভিট ২ গ্রাম ও এক লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করা জন্য বলা হয়েছে। সাথে সাথে রিডোমিল গোল্ড নামে ওষুধ গাছের শিকড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। রিডোমিল গোল্ড ৬ গ্রাম ওষুধ ও এক লিটার পানিতে মিশিয়ে দিতে হবে। অনেকে ভালো ফল পেয়েছেন। কেউ হয়তো পাননি। কারণ সঠিক মাত্রায় হয়তো প্রয়োগ করেননি তারা। আরেকটি বিষয় হলো, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। আর শীতের সময় বৃষ্টির ফলে গাছের গোড়ায় দীর্ঘদিন পানি জমে থাকাতেও এই সমস্যা বেশি হয়েছে।

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *