চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে রাজশাহী অঞ্চল

 

দেশে সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হয় রাজশাহী অঞ্চলে। জনসংখ্যাও কম হওয়ায় এখানে উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা অনেক কম। উৎপাদিত চালের বেশির ভাগ সরবরাহ হয় দেশের অন্য অঞ্চলে। আবার এ অঞ্চলভুক্ত জেলাগুলো দিয়ে ভারত থেকে বৈধ-অবৈধ পথে প্রচুর চাল আমদানিও হয়। এ মুহূর্তে রাজশাহী অঞ্চলকেই ধরা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় চাল সরবরাহকারী অঞ্চল হিসেবে। দেশে পণ্যটির বাজার-সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে এখানকার মিলারদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, চালের বাজার এখন অনেকটাই বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এ কারণে শুধু রাজশাহী অঞ্চলের বাজারে নীতিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও গোটা দেশের চালের বাজারে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বাংলাদেশে চালের সবচেয়ে বেশি সরবরাহ আসে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলভুক্ত নওগাঁ জেলা থেকে। আবার সীমান্তবর্তী এ জেলায় ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে আমদানীকৃত চাল প্রবেশ করছে। মূলত এ অঞ্চলের মিল মালিকদেরই দেশের চালের বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী বলে ধরা হয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ (ব্রি) দেশী-বিদেশী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক যৌথ গবেষণায়ও এমন তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই দশকেরও বেশি সময়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দামের তথ্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ গবেষণা করা হয়। গবেষণায় ৬৪ জেলার উৎপাদন, চালকলের সংখ্যা এবং বাজারদর বিবেচনায় নিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাজারে চালের দামকে প্রভাবিত করছে রাজশাহী অঞ্চল। শুধু খুলনা বিভাগের সঙ্গে এ সম্পর্ক অনেকটাই দ্বিমুখী। অর্থাৎ দুই অঞ্চলই একে অন্যের বাজারকে প্রভাবিত করছে। চালের বাজারে রাজশাহীর পর আঞ্চলিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহের। ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাজারে ময়মনসিংহ অঞ্চলেরও প্রভাব দেখা যায়। চট্টগ্রাম ও ঢাকা অঞ্চলে খুলনারও কিছুটা প্রভাব দেখা যায়। আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সম্পর্ক দ্বিমুখী। সার্বিকভাবে সব অঞ্চলেই রাজশাহী অঞ্চলের বাজারের প্রভাব দেখা যায়।

গবেষণায় উঠে আসা তথ্য কিছুদিন আগেই ‘স্পেশাল মার্কেট ইন্টিগ্রেশন অব রাইস ইন বাংলাদেশ ইন দ্য প্রেজেন্স অব ট্রানজেকশন কস্ট’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক জার্নাল স্প্রিঙ্গারে প্রকাশ হয়েছে। গবেষকদের অন্যতম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, এ গবেষণার জন্য আমরা দীর্ঘ সময়ের চালের বাজারদর নিয়ে তথ্য সংগহ করেছি। ঢাকায় দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। চাহিদার চেয়ে জোগান কম হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অন্য জেলাগুলো সে চাহিদা পূরণ করছে। এর কারণে অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী এক জায়গায় দামের পরিবর্তন হলে আরেক জায়গায় পরিবর্তন হবে। আমরা এক বিভাগের চালের দাম অন্য বিভাগে প্রভাব ফেলে কিনা সেটি বের করার চেষ্টা করেছি। এ প্রভাব একমুখী নাকি দ্বিমুখী তাও বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজার সম্পর্ক দ্বিমুখী। অর্থাৎ এক বিভাগের বাজারদর অন্য বিভাগের বাজারদরকে প্রভাবিত করছে। মডেল ইকোনমেট্রিক্স সফটওয়্যার দিয়ে যখন আমরা তথ্য ইনপুট দিয়েছি তখনই এ চিত্রটা উঠে এসেছে এবং আমরা বাস্তবেও তা দেখতে পাচ্ছি। কারণ একদিকে রাজশাহীতে প্রচুর চাল উৎপাদন হয়, অন্যদিকে ভারত থেকে আসা সরবরাহের সঙ্গেও রাজশাহীর বাজারের এক ধরনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে চাল আমদানির বড় এক অংশ ভারত থেকে আসে। আবার অবৈধভাবেও একটি অংশ আমদানি হয়। মূলত বাংলাদেশে চালের দাম বাড়লে ভারত থেকে অবৈধভাবে চাল আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর সেটা রাজশাহী অঞ্চল দিয়েই আসার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আগের একটি গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, দিনাজপুর থেকে চট্টগ্রামেও চাল সরবরাহ হয়। রাজশাহী বিভাগে জনসংখ্যার ঘনত্বও অন্যান্য বিভাগের চেয়ে কম। উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে তাদের উৎপাদিত চাল সব অঞ্চলে যায়। এ কারণে তারা চাইলেই চালের দামকে প্রভাবিত করতে পারবে।

তিনি আরো বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরকারিভাবে স্বীকৃত চালকলের সংখ্যা দেয়া আছে। সেটি বিবেচনায় নিয়ে আমরা দেখেছি, সবচেয়ে বেশি চালকল রয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। এছাড়া জেলাভিত্তিক উৎপাদন বিবেচনায় নিলেও সেখানে উৎপাদন বেশি। অর্থাৎ শুধু উৎপাদন কিংবা শুধু মিল সংখ্যা নয়, বরং দুটোর সমন্বয় করেই এ গবেষণা করা হয়েছে। সাধারণত উৎপাদন যে এলাকায় বেশি হচ্ছে সেখানে মিলের সংখ্যাও বেশি।

দেশে চালের বাজারে সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশীদার ধরা হয় নওগাঁ জেলার চালকল মালিকদের। খাদ্য অধিদপ্তরের নওগাঁ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় চালকল রয়েছে ৭৬০টি। এর মধ্যে ৫৯২টি এখন সচল রয়েছে। ৫৪টি অটো রাইস মিল ও ৫৩৮টি হাসকিং মিল। তবে স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুুযায়ী, জেলায় নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত চালকল রয়েছে সহস্রাধিক। যদিও চালকল মালিক সমিতি বলছে, এ ধরনের চালকলের সংখ্যা ৮৫৬।

নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বণিক বার্তাকে বলেন, নওগাঁয় হাসকিং মিল রয়েছে ৮০০ এবং অটো রাইস মিল রয়েছে ৫৬টি। আগের হিসাবে সারা দেশে প্রায় ২০ হাজার মিল রয়েছে। তবে অনেকে এরপর ঝরে গিয়েছে। এত বেশি লাভ থাকলে এত ব্যবসায়ী দেউলিয়া হতেন না। অনেকেই দেউলিয়া হয়ে গিয়েছেন। লিডিং পার্টে থাকার কারণে আমাদের মোকামের ওপর মূল্যবৃদ্ধি ও হ্রাস নির্ভর করে। বর্তমান হিসাব আমার জানা নেই। আমাদের এখানে যেহেতু সবচেয়ে বেশি ধান-চাল হয় সেক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধিতে আমাদের ওপর দায় আসবে এটা স্বাভাবিক। যেমন গত এক সপ্তাহ বিক্রি নেই বললেই চলে। লসে বিক্রি করছি। নওগাঁ জেলায় একসময় ১ হাজার ৮০০ হাসকিং মিল ছিল। এখন কমে তা ৮০০ হয়েছে। যখন কাস্টমার বাড়ে এবং আমদানি কমে তখন বাজারে দাম বাড়ে। আবার যখন কাস্টমার কমে আর আমদানি বাড়ে তখন দাম কমে। এটা বাজারের নিয়ম। নওগাঁ, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ধান উৎপাদন বেশি। ফলে এসব অঞ্চলকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বেশির ভাগ মিল-কারখানা। শিল্প সাধারণত কাঁচামাল যেখানে বেশি সেখানেই গড়ে ওঠে। এখানে অনেক কোম্পানি ও ব্যবসায়ীও মিল-কারখানা দিয়ে ব্যবসা করছেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলে যেহেতু উৎপাদন বেশি, মিলও বেশি, সে কারণে তাদের একটি প্রভাব থাকতে পারে। তবে ঢাকা যেহেতু কেন্দ্র, সে কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ব্যবসায়ীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে একক কোনো গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা যাবে না। আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে মিলার পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে দাম নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছি। তাহলে হয়তো বলা যাবে যে কারা প্রভাব রাখছে বেশি।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে আমন উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ৩৯০ টন, আউশ উৎপাদন হয়েছে ৩০ লাখ ৮৫৭ টন। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরো উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৫ হাজার ২৮৩ টন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ তিন মৌসুম মিলিয়ে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৪ হাজার ৫৩০ টন। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ৬৩ লাখ ১৫ হাজার ৪৪৭ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। ঢাকা বিভাগে উৎপাদন হয়েছে ৪৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩৯২ টন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫২ লাখ ১৪ হাজার ৩২৫, খুলনা বিভাগে ৫১ লাখ ১১ হাজার ৪১৯ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৩ লাখ ৫২ হাজার ৩৫২ টন। যদিও সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হয় রংপুর বিভাগে। বিভাগটিতে ৬৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫৬ টন চাল উৎপাদন হয়। তবে বিভাগটি গবেষণার আওতাভুক্ত ছিল না।

১৯৯৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গড়ে সবচেয়ে কম দাম ছিল খুলনা ও রাজশাহীর পাইকারি বাজারে। সেখানে গড়ে প্রতি কুইন্টালের দাম ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৩৭৭ ও ২ হাজার ৩৮১ টাকা। এছাড়া ঢাকার পাইকারি বাজারে চালের দাম ছিল গড়ে কুইন্টালপ্রতি ২ হাজার ৪৪০ টাকা, ময়মনসিংহ বিভাগে ২ হাজার ৬৬৯ ও চট্টগ্রাম বিভাগে ২ হাজার ৪০৮ টাকা।

সুত্রঃ বনিক বার্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *