খসড়া পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৩০ সালে জিডিপির ২ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে জিডিপির ৯ শতাংশের বেশি ক্ষতি হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে দেশকে বাঁচাতে আগামী ২৭ বছরে ২৩ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়।
এই অভিযোজন পরিকল্পনা বা ন্যাশনাল অ্যাডপটেশন প্ল্যানে (এনএপি) আগামী বছর থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এই অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই পরিকল্পনার খসড়া পাঠানো হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। শিগগিরই জাতীয় এই দলিল অনুমোদন দেওয়া হতে পারে বলে আশা করছেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুল হক চৌধুরী।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর বা দীর্ঘ মেয়াদে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে এবং তা কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায়, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে সেটি তুলে ধরতে এই পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় ওই পরিকল্পনা প্রণয়ণের দায়িত্ব দেয় বেসরকারি জলবায়ু পরিবর্তন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসকে (সিইজিআইএস)।
সিইজিআইএ’র হিসাব বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ হারে ক্ষতি হচ্ছে।
গত অর্থবছরে দেশের জিডিপির আকার ছিল ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। সেই হিসোবে প্রতি বছর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬৫ কোটি ডলার।
খসড়ায় বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে বছরে ক্ষতির এই পরিমাণ ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ২ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে জিডিপির ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
তেমন ঘটলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিশাল ক্ষতি মোকাবেলায় বছরে বাংলাদেশকে ৮৫০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। আর ২০২৩-২০৫০ সাল পর্যন্ত ২৭ বছরে ২৩০ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন পড়বে।
বড় আকারে ছয়টি জলবায়ু পরিবর্তন সহিঞ্চু এজেন্ডার মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
ব্যয়ের উৎস কী?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবেশ বিপর্যয় থেকে দেশ বাঁচাতে এই বিপুল অর্থ শুধু সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে ব্যয় করা হবে, এমন নয়। এই ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশের যোগান দেবে উন্নত বিশ্ব, জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থা।”
তিনি বলেন, “আমরা যখন বিভিন্ন জলবায়ু সম্মেলন বা কপ এ অংশগ্রহণ করি, সেখানে আমাদের কাছে জলবায়ুর কারণে আমাদের কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু আমাদের কাছে সেই ক্ষতির কোনো অংক আমরা বলতে পারি না।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালী গ্রামে একটি বেসরকারি সংস্থার বসানো গভীর নলকূপ থেকে খাবার পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন কয়েকজন নারী ও শিশু। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এ এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট। ফলে চার কিলোমিটারের বেশি পথ পায়ে হেঁটে স্থানীয় বাসিন্দাদের খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালী গ্রামে একটি বেসরকারি সংস্থার বসানো গভীর নলকূপ থেকে খাবার পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন কয়েকজন নারী ও শিশু। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এ এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট। ফলে চার কিলোমিটারের বেশি পথ পায়ে হেঁটে স্থানীয় বাসিন্দাদের খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। |ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
“এমন পরিস্থিতিতে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের কী পরিমাণ ক্ষতি হয় এবং কীভাবে আমরা এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব, এ বিষয়গুলো বের করে আমরা একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা দলিল তৈরি করেছি।”
মালিক ফিদা বলেন, “দাতারা কথা বলার সময় আমাদের পরিকল্পনা দেখতে চায়। তাই সরকার নতুন এই পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এই পরিকল্পনা আমরা জলবায়ু সম্মেলন বা কপ এ আমরা নিয়ে যাব। জলবায়ু তহবিল, উন্নত বিশ্ব, দাতাসংস্থা এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কাছে আমরা উপস্থাপন করব।”
‘অপর্যাপ্ত বাজেটে কঠিন হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা’
জলবায়ু পরিবর্তন: ‘প্রয়োজন টেকসই উন্নয়নবান্ধব পরিকল্পনা’
এই দলিল উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরকষাকষিতে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন।
২৭ বছরের জন্য ২৩০ বিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখন বৈঠকে আলোচনা হতে পারে যে, এতে দাতারা কী পরিমাণ অর্থের যোগান দেবে। যেসব খাতে আমরা অর্থ ব্যয় করতে চাই, সেসব অগ্রাধিকারের মধ্যে আবার তারা উচ্চ অগ্রাধিকার জানতে চাইতে পারে। এরপর হয়ত তারা সহযোগিতার বিষয়ে উল্লেখ করতে পারেন।
“এরপর ঠিক করতে হবে আমাদের কত যোগান দিতে হবে। এরপর বাস্তবে আমরা কত যোগান দিতে পারব তা ঠিক করতে হবে।”
পরিকল্পনা কীভাবে?
খসড়া পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ভৌগলিক অবস্থান ও সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় সমতলে অধিকাংশ ভূমি হওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। পানি সম্পদ, কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদের উপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই খাতগুলোর বিপন্নতা ও ঝুঁকি বাড়ছে।
ফলে জলবায়ুজনিত দুর্যোগ যেমন- তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, অসময়ে তীব্র বৃষ্টি, ঘন ঘন মৌসুমি ও আকস্মিক বন্যা, শহুরে বন্যা ও দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা, উচ্চ তাপপ্রবাহ, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণায়ন ও অম্লতা বৃদ্ধি প্রভৃতির ক্ষতিকর প্রভাব জনজীবন এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তথা সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত করছে।
জলবায়ু সম্মেলন কপ-২১ এ প্যারিস চুক্তিতে ঝুকিপূর্ণ প্রত্যেকটি দেশকে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলা হয়। ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অভিযোজনের জন্য বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করে। এই পরিকল্পনা জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যতের ঝুঁকি নিরসনে মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী অভিযোজন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের টেকসই ও জলবায়ু সহিষ্ণু উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করবে।
দূষণ কমানোর মূল দায়িত্ব ধনী দেশগুলোর: প্রধানমন্ত্রী
জলবায়ু নিয়ে ‘সারশূন্য’ প্রতিশ্রুতি নয়, দরকার বৈশ্বিক পরিকল্পনা: হাসিনা
খসড়ায় বলা হয়, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসনে অভিযোজন কৌশল নির্ধারণে ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে দেশের সকল জাতীয় ও স্থানীয় অংশীজনদের মতামত ও পরামর্শকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এজন্য সারা দেশে জাতীয় পর্যায়ে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৩৫টির বেশি পরামর্শমূলক কর্মশালা, ১০০টির বেশি দলভিত্তিক আলোচনা ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাক্ষাৎকার আয়োজন করা হয়েছে।
এছাড়া প্রায় ৫ হাজার জনের বেশি মানুষের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এই পুরো কর্মযজ্ঞে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে, লিঙ্গসংবেদনশীল জনগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, প্রবীণ ও যুব সম্প্রদায়, নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মতামত নেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার অধিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, জেলা ও উপজেলার জনপ্রতিনিধি শিক্ষার্থী, সম্প্রদায় ভিত্তিক সংস্থা, প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদসহ সমাজের সকল স্তরের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হয়েছে।
উদ্বাস্তু হতে পারে প্রায় ২ কোটি মানুষ
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় দেশে মোট ১৪টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ও ১১টি জলবায়ু সঙ্কটাপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন: যুক্তরাজ্যের প্রতিশ্রুতি ২৯ কোটি পাউন্ড
জলবায়ু সঙ্কটে অতি উচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ
এই এলাকাগুলোর বেশিরভাগই একের অধিক জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগের সুম্মুখীন, যা ভবিষ্যতে আরও তীব্র ও ঘন ঘন দুর্যোগ হবে।
ফলে সামগ্রিকভাবে অবকাঠামো, জীবিকা এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর অসমভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, এতে প্রায় ২ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হতে পারে।
অভিযোজন লক্ষ্য
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার পরিকল্পনায় একটি সমৃদ্ধশালী সমাজ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু জাতি গড়ে তোলা হবে। এ জন্য অভিযোজনের ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
>> জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ধীরগতির ও আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা।
>> খাদ্য, পুষ্টি ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
>> শহরের পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সমৃদ্ধ নাগরিক জীবন নিশ্চিতে জলবায়ু সহিষ্ণু নগর গড়ে তোলা।
>> বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে পরিবেশবান্ধব অভিযোজনে উৎসাহ করা।
>> সুশাসন জোরদার করা।
>> সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিশ্চিত করা।
এই ছয় লক্ষ্য পূরণে ২৩টি অভিযোজন কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। যার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে জাতীয় পর্যায়ে ২৮টি চিহ্নিত ফলাফল অর্জনে এবং প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সুত্রঃ বিডি নিউজ ২৪