নিউজ ডেস্কঃ
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা গতিপথ পরিবর্তন করেছে। সাম্প্রতিক বন্যায় শেখ হাসিনা গঙ্গাচড়া সেতুর উজানে ভিন্ন চ্যানেল দিয়ে তিস্তার পানি প্রবাহিত হওয়ায় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের শংকরদহ গ্রাম বিলীন হওয়ায় প্রায় ৪০০ পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। তিস্তার ভাঙনে ইচলী গ্রামসহ হুমকিতে রয়েছে রংপুর-কাকিনা সড়ক। সোমবার ওই সড়কের একটি সেতুর ব্লক ধসে পড়েছে ১৫ মিটার জুড়ে।
ভাঙনরোধে বাঁধ নির্মাণের দাবিতে মঙ্গলবার ১০ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের ইচলী গ্রামে এসকেএস বাজারসংলগ্ন জোড়া সেতুর ওপর ও রংপুর-কাকিনা সড়কে তিন ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করে। শেখ হাসিনা গঙ্গাচড়া সেতু হতে শংকরদহ ও ইচলী চর হয়ে কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের দাবি জানানো হয় মানববন্ধন থেকে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, সেতুর উজানে কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা নামক স্থানে তিস্তার পানি গতিপথ পরিবর্তন করে ইচলী এলাকা হয়ে জোড়া সেতু দিয়ে পুনরায় তিস্তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় চরম বেকায়দায় পড়েছে চরের লোকজন।
সরেজমিনে ভাঙন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তিস্তার পানি আবারো বৃদ্ধি পেয়ে প্রবল স্রোতে শেখ হাসিনা গঙ্গাচড়া সেতু পেরিয়ে রংপুর-কাকিনা সড়কে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সড়কের একটি সেতুর পাশে ১৫ মিটার ব্লক ধসে হুমকিতে পড়েছে সড়কটি। দ্রুত এখানকার ভাঙন রোধ করা না গেলে সড়কটি বিলীন হওয়ার শঙ্কা করছে স্থানীয় লোকজন। তারা জানান, এই সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বুড়িমারী স্থলবন্দরের সাথে রংপুর শহর তথা দেশের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যাবে। এছাড়া এবারের কয়েক দফায় বন্যা-ভাঙনে শংকরদহ গ্রামটি বিলীন হয়ে গেছে। পশ্চিম ইচলী গ্রামেরও ৫০ ভাগ এখন নদীগর্ভে। চরের মানুষজনের চলাচল সমস্যাসহ বাড়িভাঙা পরিবারগুলো আশ্রয়হীন অবস্থায় আছে।
একসময়ে অবস্থাসম্পন্ন মানুষের এলাকা হিসেবে পরিচিত শংকরদহ গ্রাম। সাম্প্রতিক বন্যাসহ নদীভাঙনে তছনছ হয়েছে গ্রামটি। সর্বশেষ শংকরদহ আদর্শ গ্রাম (আশ্রয়ণকেন্দ্র) বিলীন হওয়ায় নতুন করে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে ৩০ পরিবার। সেখানে আশ্রিত লোকজন নতুন করে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ায় এলাকার মায়া ত্যাগ করে বাড়ি-ঘর সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে এখানকার বাসিন্দা মোখলেছ ও ছলিমুদ্দিন এখন অন্যের জমিতে বাড়ি করেছেন। নওশা মিয়া জানান, তিনি আশ্রয় নিয়েছেন একই ইউনিয়নের বাগেরহাট আশ্রয়ণকেন্দ্রে। পুরো গ্রামটি প্রায় বিলীন হওয়ায় এদের মতো সবাই অন্যের জমিতে, বাঁধ কিংবা উঁচু জায়গায় বাড়ি-ঘর সরিয়ে নিয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছেন। এবারের বন্যার পানির স্রোতে শংকরদহ এলাকার সবকিছু ভেসে গেছে। তিস্তার ভাঙনে প্রায় ৪০০ শতাধিক পরিবার আজ গৃহহারা। ঘরবাড়িসহ সহায়-সম্বল হারিয়ে অসহায় পরিবারগুলো এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। সবমিলে বিধ্বস্ত-বিরানভূমিতে পরিনত হয়েছে শংকরদহ গ্রাম।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শেখ হাসিনা গঙ্গাচড়া সেতু পেরিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিম দিকে দুর্গম চর শংকরদহ। সেখানে সহজে যাওয়ার কোনো পথ নেই। সাম্প্রতিক বন্যায় রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শংকরদহ আদর্শ গ্রামে থাকতো ৩০টি পরিবার, অন্য এলাকায় নদীভাঙনে যারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। এবারে গোটা আশ্রয়ণকেন্দ্রটি বিলীন হওয়ায় সেই ঠিকানাও তাদের বদল করতে হচ্ছে। এছাড়া আদর্শ গ্রামের ধারঘেঁষে আরো প্রায় ১৫০ পরিবার সেখানে বসতি গড়েছিল। কিন্তু গৃহহীন হয়ে তারা বাধ্য হয়েছে অন্যত্র চলে যেতে।
এলাকার ইউপি সদস্য আব্দুল মোন্নাফ জানান, শংকরদহ গ্রামে প্রায় ৫০০ পরিবারের বাস ছিল। বর্তমানে ১০০ পরিবারও নেই। এবারের বন্যাসহ তিস্তার ভাঙনের শিকার প্রায় ৪০০ পরিবারই এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে বাকি পরিবারগুলোও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তিনি বলেন, গত বছরও এই এলাকায় ভাঙন ছিল। তবে এতটা নয়। এ বছর ব্যাপক আকারে ভাঙন শুরু হয়েছে। উজানে বাঁধ না দেওয়া পর্যন্ত তিস্তার নতুন এ চ্যানেলটি বন্ধ হবে না। আর এতে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে।
লক্ষ্মীটারি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী শংকরদহ গ্রামটি তিস্তার করাল গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এখানে। এলাকায় এখন কাজও নাই, খাবারও নাই। এখানকার বাসিন্দারা তাই বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে চলে যাওয়ায় অনেকটা বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে শংকরদহ গ্রাম।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রকৌশলী এ জেড এম আহসান উল্লাহ বলেন, রংপুর-কাকিনা সড়কের ভাঙনরোধে আপাতত বালুর বস্তা ডাম্পিং করা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলীমা বেগম বলেন, ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং এলজিইডির সমন্বয়ে বালির বস্তা ও জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান শেখ হাসিনা গঙ্গাচড়া সেতুর সংযোগ সড়কে ভাঙনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ভাঙনরোধে জিও ব্যাগ ও সিনথেটিক ব্যাগে বালি ভরে ডাম্পিং করা হচ্ছে।
সুত্রঃ কালের কণ্ঠ