নিউজ ডেস্কঃ
তুলনামূলক স্বল্প খরচে কোনো পণ্য নিজ দেশে উৎপাদন সম্ভব হলে তা ওই পণ্যটির ক্ষেত্রে তুলনামূলক সুবিধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কোনো কৃষিপণ্য স্বল্প খরচে দক্ষতার সঙ্গে ঊৎপাদন করার বিষয়টি এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। এটি পরিমাপে ব্যবহার করা হয় রিভিলড কমপারেটিভ অ্যাডভানটেজ (আরসিএ) স্কোর। আর সেই মানদণ্ডে দেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এখন পাট। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আরসিএ স্কোর ১-এর থেকে বেশি হলে পণ্যটি প্রতিযোগী দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। সেটি দেশে উৎপাদন করার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে পাটের আরসিএ মান ৪৮৮। দেশে গত বছর প্রায় ৮৬ লাখ বেল পাটের উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের মাধ্যমে রফতানি আয় হয়েছে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ফলে আরসিএ মান বেশি থাকায় দেশে আরো বেশি পাটের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে অধিক সুবিধা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। কৃষিজ অন্যান্য যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে আরসিএ মান ভালো সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সরিষা, রসুন, তিল ও তুলা। পাশাপাশি মাছ, মসলা, তামাক, পালংশাক, পেঁপে, আলু ও মরিচে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশের একটি বড় সুবিধা হলো ইচ্ছে করলেই সব উৎপাদন করতে পারি। আমাদের আবহাওয়া ও মাটি সেটিকে সাপোর্ট করে। তবে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো ও শস্যের বহুমুখীকরণে অবশ্যই বাণিজ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিতে হবে। যে পণ্যটি বেশি সুবিধা দেবে সেটি দেশেই উৎপাদনে নজর দিতে হবে। তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেটি কম সুবিধা দেবে, সে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর অর্থ হলো কৃষককে কার্যকর সুবিধা দিতে পারব না। যদি না সরকারের সরাসরি ইন্টারভেনশন থাকে।
কৃষিপণ্যের তুলনামূলক সুবিধা একটি পরিবর্তনশীল বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি কার্যকর আরসিএ তালিকা থাকা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে নতুন কোনো পণ্য দেশে উৎপাদন করতে গেলে নীতি ও কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তি, জ্ঞান ও উপকরণ সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে।
কমপারেটিভ অ্যাডভানটেজ বা তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্বটি প্রথম প্রবর্তন করেন ১৮১৭ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো। যার মূল বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানির চেয়ে দেশে উৎপাদন করে যেসব পণ্যে বেশি লাভবান হওয়া যাবে, সে পণ্যই দেশে উৎপাদন করা। যেটি কম লাভ দেবে, সে পণ্য প্রতিযোগী দেশে উৎপাদনের জন্য ছেড়ে দেয়া। আর এভাবেই দুটি দেশ দুটি পণ্য উৎপাদন ও বাণিজ্য করে তুলনামূলক সুবিধা পাবে। তখন দুই দেশের মধ্যে একটি পণ্য উৎপাদন অন্য পণ্যটি আমদানির মাধ্যমে ব্যয়ের সাশ্রয় ও দক্ষতা অর্জন করবে। দুটি দেশের দুটি পণ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরীকৃত এ তত্ত্বটি জনপ্রিয় করে আরসিএ মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয়। আর বাংলাদেশে সেখানে আরসিএ মানে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে কলা, দুধ, আঙুর, তিসি। এছাড়া যব, কপি ও ব্রকলি, সয়াবিন, লেবু ও আদার মান নিম্ন সারিতে রয়েছে। এসব কৃষিজ পণ্যে আরসিএ মান শূন্য দশমিক ১ শতাংশেরও কম। ১ শতাংশের নিচে রয়েছে বেশকিছু কৃষিজ পণ্য। এর মধ্যে পেঁপেতে শূন্য দশমিক ৯৩, আলুতে শূন্য দশমিক ৭৫, মরিচে শূন্য দশমিক ৭১। ফলে বাণিজ্য সুবিধায় পিছিয়ে রয়েছে এসব কৃষিজ পণ্য।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, সব কৃষিজ পণ্য একই সঙ্গে উৎপাদনের প্রয়োজন নেই। কৃষকের কাছে জোর করে কোনো পণ্য উৎপাদন বাড়াতে গেলে দক্ষতার পরিচয় হবে না। এক্ষেত্রে শস্যের উৎপাদন খরচ, প্রয়োজনীয়তা ও বাণিজ্যের তুলনামূলক সুবিধা বিশ্লেষণ জরুরি। পাশাপাশি ভূপ্রাকৃতিক গঠন, বাজারদর, আবহাওয়া উপযোগিতা ও মাটির কার্যকারিতা বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। বাণিজ্যিক ও রফতানিমুখী কৃষি এগিয়ে নিতে শস্য আবাদে বহুমুখীকরণে জোর দিতে হলে অবশ্যই বাণিজ্য সুবিধাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
জানা গেছে, আরসিএ মানে ভালো অবস্থানে থাকা অন্যান্য কৃষিজ পণ্যের মধ্যে সরিষা ও রসুনে স্কোর ১০ দশমিক ৫২। এছাড়া তিলে ৪ দশমিক ৮২, তুলায় ২ দশমিক ৩৪ ও মাছে ২ দশমিক ১৮। এছাড়া মসলায় ১ দশমিক ৫৪, তামাকে ১ দশমিক ২৬, পালংশাকে ১ দশমিক শূন্য ৪। এসব পণ্য আমদানি না করে দেশেই উৎপাদনে নজর দিলে দেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। পাশাপশি উৎপাদন প্রক্রিয়া হবে দক্ষ ও কার্যকর। কৃষিজ পণ্যের আমদানি প্রতি বছরই বাড়ছে। গত অর্থবছরে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করতে হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তুলা। গত অর্থবছরে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার তুলা আমদানি করতে হয়েছে। এছাড়া তেল ও মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানিও বাড়ছে। এসব পণ্য দেশে উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষিজ পণ্যের উৎপাদনে আমাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাই ছিল দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। সরকারের সঠিক নীতিসহায়তা ও কার্যকর উদ্যোগের কারণে দানাদার খাদ্যে এখন আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। এখন আমরা শস্যের বহুমুখীকরণ ছাড়াও কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে জোর দিচ্ছি। সেখানে যেসব কৃষিজ পণ্য মূল্য সংযোজন কিংবা কৃষকের বাড়তি মুনাফা দিতে পারবে এমন শস্য আবাদে কৃষকের উৎসাহিত করা হচ্ছে। বাণিজ্য সুবিধা ছাড়াও দেশের প্রয়োজন ও চাহিদাকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। সার্বিকভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখতে উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি, বিশেষ করে শস্য খাত।
সুত্রঃ বনিক বার্তা