দুর্দিনের সারথি কৃষি: প্রসঙ্গ করোনা ও আমফানদুর্দিনের সারথি কৃষি: প্রসঙ্গ করোনা ও আমফান

মোহাম্মদ লোকমান হোসেন মজুমদার
মানব সভ্যতার সূচনা কৃষি থেকে, কেননা কথা আছে- ‘কৃষিই কৃষ্টি’। আদিমকালে ক্ষুধা নিবারণের জন্য সংগৃহীত ফলের ফেলে দেয়া বীজ থেকে জন্মানো গাছে অনুরুপ ফল দেখেই মানুষ ধীরে ধীরে কৃষিকাজ করতে শিখে। তারপর পার¯পারিক পণ্য বিনিময়, কালক্রমে মুদ্রাপ্রথা থেকে অর্থনীতি কিংবা মুক্তবাজার অর্থনীতি হয়ে আজকের বিশ্বায়ন, সে এক বিশাল পথ পরিক্রমা। মানব সভ্যতা আজ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেও যেন সে একই বৃত্তেই বাঁধা। করোনার যাঁতাকলে গভীর সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি, চরম ঝুঁকিতে খাদ্য নিরাপত্তা। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা’র দুর্ভিক্ষের হুঁশিয়ারি এবংবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা‘র অন্তহীন করোনা ঝুঁকির ভবিষ্যতবাণীতে উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী। এর সাথে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’র প্রক্ষেপণ স্পষ্টত দৃশ্যমান যাতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির অর্ধেক বা ১৬০ কোটি মানুষ জীবিকা হারাতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সুড়ঙ্গের শেষ আলো কৃষি। হ্যাঁ, দেশী-বিদেশী সকল বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক একটি বিষয়ে একমত যে, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের সাথে জীবিকার গতি সচল রাখতে কৃষিই একমাত্র অবলম্বন। সভ্যতার উষালগ্ন থেকে কৃষি যেমনি মানুষের ক্ষুধা নিবারণ তথা জীবিকা নির্বাহের বাহন ছিল তেমনি আজকের দিনেও কৃষিই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার বাহন। “একমাত্র কৃষিই পারে দেশকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাাঁচাতে” বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

স্বাধীনতার প্রাক্কালে আমাদের খাদ্যশস্যের উৎপাদন যেখানে ছিল মাত্র ১ কোটি মেট্রিক টন, সেখানে বর্তমানে তা প্রায় চার গুন হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৮৪ কোটি মেট্রিক টন (বিবিএস, ২০১৯)। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পিছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। আরও আশার কথা, করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনের সম্ভাব্যতা শীর্ষক এক প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কৃষি সংস্থা [ইউএসডিএ] জানিয়েছে ধান, গম ও ভূট্টার মোট উৎপাদন স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ মে. টন বেশী হবে। আপাত মজুদের সাথে অতিরিক্ত এ উৎপাদন যোগ হয়ে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত একটি মজুদের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। সে নিরিখে আপাতত বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের সম্ভবনা নেই। কিন্তু, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত দেশ সমুহের মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ। সাইক্লোন সিডর, আইলা, মহাসেন, মোরা, বুলবুল, ফণী ও আমফানের মত হঠাৎ দুর্যোগ আর বন্যা, খরা ও ঝড়-জলোচ্ছাসের মত নিয়মিত দুর্যোগে প্রায়শই ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের কৃষি উৎপাদন, ঝুঁকিতে পড়ে খাদ্য নিরাপত্তা, বাধাগ্রস্থ হয় অর্থনীতির গতি। তাই, সুসময়ে সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষি উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। করোনা জনিত খাদ্য সংকটের ঝুঁকি মোকাবেলায় ‘কর্মপরিকল্পনা ২০২০’ প্রণয়নে কৃষি সংশ্লিষ্ট গুনীজন ও অংশীজনদের সাথে জুম মিটিং ফ্লাটফর্মে ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনার সময় মাননীয় কৃষিমন্ত্রীও কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল কৃষি প্রধান দেশ এবং আমাদের অর্থনীতির ভীত কৃষি নির্ভর। তাই, কৃষিখাতে বিপর্যয় মানে আমাদের অর্থনীতিতে বিপর্যয়। তখন নীতি-নির্ধারণী মহলের টনক নড়ে কৃষিখাত নিয়ে, সাময়িক গুরুত্ব পেতে থাকে কৃষি। কৃষি উৎপাদন যখন অর্থনীতির চাকাকে সচল করে তোলে তখনই আবার গুরুত্ব হারাতে থাকে এ খাত, আবার নেমে আসে বিপর্যয়। এই ধারাবাহিকতা ছিল প্রায় গতানুগতিক। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে অতীতের গতানুগতিক এই ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আশার কথা, বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে। ক্ষমতায় এসে পূণ: পূণ: সারের মূল্য হ্রাস, মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার মাধ্যমে সরাসরি কৃষকদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা (এখন ‘নগদ’ একাউন্টের মাধ্যমে দেয়ার প্রক্রিয়া চলমান) প্রদান, শ্রমিক সংকট এড়িয়ে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সহজ করতে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০-৭০% ভর্তুকিমূল্যে কৃষকদের মাঝে কম্বাইন হারভেস্টার, রীপার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ইত্যাদি কৃষিযন্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকিকরণে বিপ্লব সাধন এবং এ কার্যক্রম আরো জোরদার করতে নতুন বাজেটে ৩,১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ, এ বোরো মৌসুমে সরাসরি কৃষক থেকে ১০৪০ টাকা মণে ৮ লাখ মে. টন ধান ও ১৪০০-১৪৪০ টাকা মণে ১২ লাখ ২০ হাজার মে. টন চাল সংগ্রহের ঘোষণা, বিভিন্ন সময়ে ঝুঁকি হ্র্রাসে ভর্তুকি ও প্রনোদনা প্রদান বিশেষত করোনা মহামারি জনিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষি, মৎস ও প্রাণী সম্পদ খাতে মাত্র ৪% সুদে ৫,০০০ কোটি (নিয়মিত ১৪,৫০০ কোটি সহ মোট ১৯,৫০০ কোটি) টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা সহ সামগ্রিক কৃষিখাতে সর্বমোট ৯,৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ও আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ঘোষণা, নতুন বাজেটে উৎপাদনমূখী খাতের মধ্যে কৃষিতে সর্বোচ্চ ২৯,৯৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং বিলম্বে হলেও প্রথমবারের মত কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদ সহ সকল কৃষিকর্মীদের জন্য একজন যোগ্য কান্ডারী কৃষিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি‘র হাতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান এর বড় প্রমাণ।

গত কয়েক দশক ধরে গার্মেন্টস শিল্প এবং প্রবাসী আয় অর্থনীতিতে চালকের ভূমিকায় থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে এ দু’টি খাতই প্রায় বিপর্যয়ের মুখে। প্রকৃতপক্ষে, যুগে যুগে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা যুদ্ধ বিগ্রহে যখনই অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়েছে সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে কৃষি উৎপাদন দিয়েই। উদাহরণসরুপ, ২০০৭ সালের প্রলয়ংকারী সাইক্লোন সিডরে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি এবং ২০০৮ সালের মহামন্দার ফলশ্রুতিতে খাদ্য শস্যের মূল্য সাধারণ জনগনের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে যায়, উঁকি দেয় খাদ্য সংকট। সে সঙ্কটকালে রপ্তানীকারক দেশ সমূহের আপত্তি ও টালবাহানায় আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়েছিল তা সহজে ভুলার কথা নয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় প্রচার মাধ্যম ও নীতি-নির্ধারণী মহলে হৈ চৈ পড়ে যায়। কৃষি বিভাগের বিশেষ তৎপরতায় ফসলের বাম্পার ফলন এবং বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে কৃষি খাতে ভর্তুকী বৃদ্ধি তথা উত্তরোত্তর সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী তেলের মূল্য হ্রাস করায় খাদ্যশস্যের মূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মন্দার ছোবলে বিশ্বব্যাপী যখন কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়ে রাস্তায় নেমে পড়চ্ছিল, বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল শিল্প-কারখানা ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান, তখন আমাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি না হোক অন্তত স্বাভাবিক ছিল সে কৃষি নির্ভর অর্থনীতির কারনেই। এছাড়া ’৭৬ এর মন্বন্তর, ১৯৪৩ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং আমেরিকার চক্রান্তের ফলে সৃষ্ট ১৯৭৪ এর কৃত্রিম খাদ্য সংঙ্কট মোকাবেলায় কৃষির অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। করোনা জনিত সম্ভাব্য খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং আম্পানের ক্ষতি কাটিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনেও তাই কৃষিই আমাদের ভরসা।

যে দেশের প্রধানমন্ত্রী কৃষকের ধান কাটার খবর রাখেন, যে দেশের কৃষিমন্ত্রী করোনা ঝুঁকি উপেক্ষা করে কৃষকের মাঠে ছুটে চলেন, যে দেশের কৃষি বিভাগের প্রধান (করোনা জয়ী) থেকে সকল কৃষিবিদ ও তৃণমূলের কৃষিকর্মীরা মানসম্মত সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই প্রতিনিয়ত কৃষিসেবা দিয়ে যাচ্ছেন আর একের পর এক করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং যে দেশের কৃষকরা মৃত্যুকে পরোয়া না করে কৃষিকে নিয়ে আঁকড়ে থাকেন দিবারাত্রি, সে দেশে অন্তত দুর্ভিক্ষ হবেনা, একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি, যদি অব্যাহত থাকে এ রীতি ও গতি।

মোহাম্মদ লোকমান হোসেন মজুমদার
বিসিএস (কৃষি), কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ এবং পিএইচডি গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *