দেশীয় স্বাদে পোল্ট্রির নতুন জাত; কমাবে আমদানি বদলাবে দৃষ্টিভঙ্গিদেশীয় স্বাদে পোল্ট্রির নতুন জাত; কমাবে আমদানি বদলাবে দৃষ্টিভঙ্গি

ড. মো: রাকিবুল হাসান

সুস্থ-সবল, মেধাবী জাতি গঠনে প্রাণিজ আমিষের কোন বিকল্প নেই। আর দেশের সেই প্রানিজ আমিষের শতকরা ৪০-৪৫ শতাংশ আসে পোল্ট্রি থেকে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ায় বাড়ছে আমিষের চাহিদাও। আর সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের জন্য দৈনিক ৩৫-৪০ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদন করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে মুরগির মাংসের অর্ধেকের বেশি আসে বাণিজ্যিক ব্রয়লার থেকে যার জাত পুরোটাই আমদানি নির্ভর। বৈশ্যিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পোল্ট্রি শিল্পের উপরও পড়ছে, তাই এই নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় দেশি আবহাওয়া উপযোগী অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করা ছিলো জরুরি। সেই বিবেচনায়, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)-এর পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীবৃন্দ দেশীয় জার্মপ্লাজম ব্যবহার করে ধারাবাহিক সিলেকশন ও ব্রিডিং এর মাধ্যমে সম্প্রতি একটি অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশীয় পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী মুরগির এই জাতটির নামকরণ করা হয়েছে “মাল্টি কালার টেবিল চিকেন (এমসিটিসি)”।

কীভাবে করা হলো এই জাত উদ্ভাবন, লালন-পালন প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নীচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-

প্রযুক্তির বিবরণঃ
উদ্ভাবিত মাংসল জাতের এ মুরগিগুলো একদিন বয়সে হালকা হলুদ থেকে হলুদাভ, কালো বা ধূসর রংয়ের পালক দেখা যায় যা পরবর্তীতে দেশি মুরগির মতো মিশ্র রংয়ের হয়ে থাকে। তবে, গাঢ় বাদামী, সোনালী, সাদা-কালো, সাদা-কালোর মিশ্রণ পালক বিশিষ্ট মুরগির উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। এগুলোর ঝুঁটির রং গাঢ় লাল এবং একক ধরনের। চামড়ার রং সাদাটে এবং গলার পালক স্বাভাবিকভাবে বিন্যস্ত। নতুন এ জাতের মুরগিগুলোর পায়ের নলার রং হালকা হলুদ বা কালো রংয়ের হয়ে থাকে।

খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ
সাধারণত, মুরগি পালনে মোট ব্যয়ের শতকরা ৬০-৭০ ভাগই খরচ হয় খাদ্য বাবদ। তাই, খাদ্য অপচয় রোধে যথাসম্ভব সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে। বাচ্চা উঠানোর কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত লিটারের উপর পেপার বিছিয়ে খাদ্য ছিটিয়ে দিতে হবে। ৩-৪ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত চিক ফিডারের এক-তৃতীয়াংশ পূর্ণ করে দিনে ৩-৪ বার খাবার দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে বড় খাবার পাত্রে দিনে ৩-৪ খাবার দেওয়া যেতে পারে। খাবার পাত্রের সংখ্যা, উচ্চতা অবশ্যই মুরগির সংখ্যা ও বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

জায়গা, তাপমাত্রা, আলো ও বায়ু ব্যবস্থাপনাঃ

এমসিটিসি জাতের মুরগি পালনে জায়গার পরিমাণ, ব্রিডিং তাপমাত্রা, আলো ও বায়ু ব্যবস্থাপনা অন্যান্য মুরগির মতই। মুরগির ঘরে বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও ব্যবস্থপনা ত্রুটির কারণে ঘরের ভেতর আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও দূষিত বাতাসের পরিমাণ বেড়ে গেলে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তাই, এমসিটিসি মুরগির জন্য ঘরের ভেতরে সবর্দা পর্যাপ্ত অক্সিজেন (>১৯.৬০%), নূন্যতম কার্বন-ডাই অক্সাইড (<৩০০০ পিপিএম), কার্বন-মনো অক্সাইড (<১০ পিপিএম), অ্যামোনিয়া (<১০ পিপিএম) এবং দূষিত পদার্থ (<৩.৪ মিলিগ্রাম/ঘনমিটার) নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এছাড়াও, ঘরের ভেতরের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৪৫-৬৫% এর মধ্যে রাখতে হবে।

ঘরের আকারঃ

এমসিটিসি জাতের ১০০০ টি মুরগি পালনের জন্য পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল করতে পারে এমন জায়গায় উত্তর-দক্ষিনমুখী করে ৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের দোচালা ঘর নির্মান করতে হবে। ঘরের দরজা সংলগ্ন কিছু অংশ আলাদাভাবে বেষ্টনি দিয়ে খাবার, জীবাণুনাশকসহ অন্যান্য উপকরণ রাখার জন্য ব্যবহার করতে হবে। মেঝে থেকে ১০ ফুট উচ্চতার ঘরের চালা ৩-৪ফুট বাড়তি রাখতে হবে যেন মুরগিকে বৃষ্টির পানির ঝাঁপটা না লাগে। ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ঘরের পর্দা দুই অংশে ভাগ করতে হবে; উপরের অংশটি প্রাথমিক বায়ু চলাচলের জন্য ব্যবহার করতে হবে, ঠান্ডার সময় মুরগিকে সরাসরি বাতাসের হাত থেকে রক্ষা করতে নিচের অংশের অন্য পর্দাটি আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ভেদে উঠা-নামা করতে হবে।

লিটার ব্যবস্থাপনাঃ

এমসিটিসি জাতের মুরগির স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য লিটার বা বিছানা শুষ্ক ও দুর্গন্ধমুক্ত হতে হবে। মুরগির বয়স ও আবহাওয়া অনুযায়ী সঠিক উপাদানের লিটার ব্যবহার করতে হবে। গ্রীষ্মকালে ১-২ ইঞ্চি এবং শীতকালে ৩-৪ ইঞ্চি পুরু লিটার ব্যবহার করতে হবে। ব্রিডিং-এর সময় লিটারের উপর পেপার বিছিয়ে দিতে হবে এবং প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়াও, কোন কারণে লিটার ভিঁজে গেলে বা আর্দ্র হয়ে গেলে সেগুলো সাথে সাথে সরিয়ে ফেলতে হবে, প্রয়োজনে নতুন লিটারের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। লিটার নিয়মিত উলট-পালট করতে হবে।

এমসিটিসি মুরগির উৎপাদন দক্ষতাঃ

বিএলআরআই পরিচালিত গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন বয়সে এমসিটিসি মুরগির গড় ওজন ০-৮ সপ্তাহে ৯৭৫ গ্রাম-১.০ কেজি মোট খাদ্যগ্রহণ ২.২০-২.৪০ কেজি এবং খাদ্য রুপান্তর হার প্রায় ২.২২-২.৩৫ কেজি।

টিকাদান কর্মসূচীঃ

এমসিটিসি জাতের মুরগির মৃত্যুর হার খুবই কম। বিএলআরআই পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় সর্বোচ্চ ১.৫% মৃত্যুহার পাওয়া গেছে। এই জাতের মুরগিগুলো অধিক রোগ প্রতিরোধক্ষম এবং দেশীয় আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় সঠিক বায়োসিকিউরিটি বা জীব-নিরাপত্তা এবং প্রতিপালন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে রোগ-বালাই হয় না বললেই চলে।

আর্থ-সামাজিক প্রভাব/আয় ও ব্যয়ের হিসাবঃ

বিএলআরআই-এ পরিচালিত গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, আট সপ্তাহ পর্যন্ত ১ হাজার এমসিটিসি জাতের মুরগি এক ব্যাচ লালন-পালন করে বাজার মূল্যভেদে প্রায় ৪৫-৬০ হাজার টাকা তথা বছরে অন্তত ৪টি ব্যাচ পালন করলে ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। এছাড়াও, এমসিটিসি জাতের মুরগিগুলো মাংসের স্বাদ ও পালকের রং দেশি মুরগির ন্যায় মিশ্র বর্ণের হওয়ায় খামারীগণ বাজার মূল্যও প্রচলিত সোনালী বা অন্যান্য ককরেল মুরগির তুলনায় বেশি পাবেন।

পরিবেশের উপর প্রভাবঃ

বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের ঝুকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার প্রথম দিকে। প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব কম-বেশি সব খাতের উপরই দৃশ্যমান। অন্যান্য প্রাণীকুলের তুলনায় পোল্ট্রি প্রজাতি পরিবেশের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যদিকে, দেশের ব্রয়লার-লেয়ারের সব জাতই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে সেগুলোর কাঙ্খিত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেই দিক বিবেচনায় বিএলআরআই উদ্ভাাবিত মাংস উৎপাদনকারী জাতটি (এমসিটিসি) পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী এবং উৎপাদনের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই। তাছাড়া, খামারের বিষ্ঠা দিয়ে বায়োগ্যাস করা যেতে পারে এবং বায়োগ্যাসের উপজাত জৈব সার হিসেবে বিভিন্ন ফসল, খাদ্যশস্য ও ঘাস উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলে, খামারিগণ অধিক লাভবান হবেন।

মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ কার্যক্রমঃ

মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ধারাবাহকি গবষেণার মাধ্যমে দশেরে বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তকি খামারি র্পযায়ে উৎপাদন দক্ষতা, অভিযোজন ক্ষমতা, মৃত্যুহারসহ রোগ বালাইয়রে প্রার্দুভাব মুলায়ন করা হচ্ছে । বাণিজ্যিক খামার র্পযায়ে মুল্যায়ন ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে আফতাব বহুমুখী র্ফামস লমিটিডে কোম্পানির সাথে যৌথ গবষেণা চলমান রয়ছে। এই মাসের মধ্যেই প্যারেন্ট মুরগগিুলো ডিম পাড়া শুরু করবে। আশা করা যায়, এ বছরের জুলাই-আগস্ট মাস থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাচ্চা উৎপাদন শুরু হবে এবং খামারী পর্যায়ে সম্প্রসারতি হবে।

নতুন উদ্ভাবিত মাংসল জাতের মুরগি খামারি পর্যায়ে সম্প্রসারণ সফলভাবে করতে পারলে একদিকে স্বল্পমূল্যে প্রান্তিক খামারিগণ অধিক মাংস উৎপাদনকারী জাতের বাচ্চা পাবেন, অন্যদিকে আমদানি নির্ভরশীলতা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। ফলে মুরগরি বাচ্চা ও মাংসের বাজারমুল্যরে উত্থান-পতন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এছাড়া দুর্যাগ ও মহামারীতে বিদেশি জাত আমদানির পরিবর্র্ত দেশের উদ্ভাবিত জাত মাংসরে চাহদিা পূরণে অগ্রণী ভুমকিা রাখতে পারে। প্রযুক্তিটি দেশের সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষসহ অন্যান্য পুষ্টির চাহিদা পূরণে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়ায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা।

সুত্রঃ কৃষি প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *