ডা. মো. ইব্রাহীম খলিল
বিশ্ব পরিবর্তনশীল। এ পরিবর্তন সব বিষয়কেই স্পর্শ করছে। বাদ নেই খাদ্যাভ্যাসও। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে সচেতনতা। সময় যত যাচ্ছে, তারা নিজেদের উদ্বুদ্ধ করছে গুণগত মানের খাদ্যাভ্যাসের প্রতি। মূলত মানুষের আর্থিক সক্ষমতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আরবানাইজেশনের কারণে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে গত এক দশক ধরে। এর স্বপক্ষে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। তারা জানিয়েছেন, আর্থিক সক্ষমতা বাড়ার সাথে খুব জোরালো সম্পর্ক রয়েছে প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধিতে। বিশেষ করে দুধ, মাংস ও ডিম গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধিতে।
যদি শহরের দিকে একটু খেয়াল করি, তাহলে দেখব দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদিত রকমারি খাবারের প্রতি আসক্তি কিভাবে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ১০ জনের ভেতর ৭ জন শহরে বসবাস করবেন। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০০৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ বেড়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বেড়েছে কয়েকগুণ হারে। এর প্রেক্ষিতে গত ১০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দানাদার খাদ্যের মাধ্যমে ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা ৬০ ভাগ থেকে দাঁড়িয়েছে ৫৪ ভাগ।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এটি আরও কমবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ মাংসের মাধ্যমে ক্যালরি গ্রহণ বাড়বে দ্বিগুণ হারে। এর পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের মাত্রা প্রায় স্থির থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জার্নালে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বরাত দিয়ে উদাহরণ হিসাবে বলা হয়, এশিয়া মহাদেশে জনপ্রতি প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে ২২৫ শতাংশ। ১৯৬১ থেকে ২০০৭ সালের সাথে তুলনা করে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।
এর বিপরীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রাণিসম্পদের খাতের পণ্যসমূহ খাদ্য হিসাবে দ্রুত গ্রহণ করার কারণে গত চার দশকে মৎস্য থেকে উৎপাদিত খাদ্যসমূহ গ্রহণ সামান্য কমেছে। এসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রাণিসম্পদ বিভাগের উপরে অতিরিক্ত চাপ বাড়বে। এ চাপ বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হলো, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য খাদ্যে অ্যামাইনো এসিডের যে চাহিদা পূর্বে নিরূপণ করেছিল, তা এখন বহুগুণ বেড়ে গেছে। কারণ হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রাণিজ আমিষ ওজন কমাতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখার পাশাপাশি কার্যকর শরীর গঠনে সহায়তা করে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০০৬ সালে এক রিপোর্টে দেখিয়েছে, বিশ্বে মাংস এবং দুধ উৎপাদিত পণ্য গ্রহণের মাত্রা বাড়বে যথাক্রমে ১০২ ও ৮২ শতাংশ, ২০০০ থেকে ২০৫০ সালের ব্যবধানে। কিন্তু এসব পণ্যের উৎপাদনের হার উন্নয়নশীল দেশে আরও বেশি থাকবে এবং তা যথাক্রমে হবে ১৬৪ এবং ১৭২ শতাংশ। উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি গত তিন দশকে জনপ্রতি মাংস ও মাংস উৎপাদিত পণ্য গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে ১৫০ ভাগ এবং দুধ ও দুধ উৎপাদিত পণ্যের গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে ৬০ ভাগ। ২০৩০ সাল নাগাদ জনপ্রতি মাংস ও মাংস উৎপাদনের হার বাড়বে আরও ৪৪ ভাগ।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আরও জানিয়েছে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে যেখানে ১৯৯৭-১৯৯৯ সালে জনপ্রতি বাৎসরিক মাংস গ্রহণ ছিল ২৫.৫০ কেজি। সেখানে ২০৩০ সালে দাঁড়াবে ৩৭ কেজি এবং দুধ ও দুধ উৎপাদিত পণ্য ৪৫ কেজি থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৬৬ কেজি। ডিম গ্রহণের পরিমাণ হবে ৬.৫ কেজি থেকে ৮.৯ কেজি। এটা তো হলো উন্নয়নশীল দেশসমূহের চিত্র। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি অভিক্ষেপণ করেছে। এগুলো হবে মূলত জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশসমূহ আদর্শ জীবন ব্যবস্থার প্রতি সচেতন হওয়ার কারণে।
এবার আসি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থানে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২০১৮-২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাংস উৎপাদন ছিল ৭৫.১৪ লাখ মেট্রিক টন, দুধ ৯৯.৩ লাখ মেট্রিক টন ও ডিম ছিল ১৭১১ কোটি। শুধু এক বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে নয়, গত ৮ বছরের (২০০৯-২০১৭) বার্ষিক রিপোর্টের দিকে লক্ষ্য করলে এসব পণ্যের ক্রমবর্ধমান চিত্র সহজে স্পষ্ট হয়। গত এক দশকে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন বেড়েছে যথাক্রমে ৪.৩ গুণ, ৭ গুণ ও ৩.৬ গুণ, যেখানে জনপ্রতি দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদার প্রেক্ষিতে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ১২৫ গ্রাম, জনপ্রতি দৈনিক ২৫০ মিলি দুধের চাহিদার প্রেক্ষিতে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ১৬৫ মিলি ও জনপ্রতি বছরে ১০৪টি ডিমের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।
সব তথ্য-উপাত্তের প্রেক্ষিতে এ কথা স্পষ্ট বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে থাকবে এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রজেকশনের দিকে খেয়াল রেখে এ সেক্টরকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তাই আরও কিছু কর্ম পরিকল্পনা হাতে নেওয়া একান্ত জরুরি-
১. প্রাণিসম্পদ উৎপাদিত পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে জরুরি প্রতিষ্ঠানে রূপদান করার মধ্য দিয়ে খামারিদের পাশে থেকে সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বর্তমান মহামারী পরিস্থিতিতে সবার কাছে বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
২. গ্রাম পর্যায়ে প্রাণিদের চিকিৎসা ও পরামর্শ সার্বক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ সেবা সম্প্রসারণ করার জন্য আমাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
৩. দেশের বিভিন্ন এলাকায় উন্নতমানের গবেষণাগার ও পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা।
৪. দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতীয় ডেইরি ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন, জাতীয় পোল্ট্রি ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ও জাতীয় বিফ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন নামক প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিলে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
৫. প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ইপিডেমিওলজি ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে খামারিদের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার হাত থেকে অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে।
৬. খামারিদের উৎপাদিত পণ্য সুষ্ঠুভাবে বিপণনের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আলাদা বিপণন প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি, যা মহামারীর সংকটকালে এর প্রয়োজনীয়তার বাস্তব চিত্র সবার মাঝে ফুটে উঠেছে।সব তথ্য-উপাত্তের প্রেক্ষিতে এ কথা স্পষ্ট বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে থাকবে এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রজেকশনের দিকে খেয়াল রেখে এ সেক্টরকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তাই আরও কিছু কর্ম পরিকল্পনা হাতে নেওয়া একান্ত জরুরি-
১. প্রাণিসম্পদ উৎপাদিত পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে জরুরি প্রতিষ্ঠানে রূপদান করার মধ্য দিয়ে খামারিদের পাশে থেকে সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বর্তমান মহামারী পরিস্থিতিতে সবার কাছে বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
২. গ্রাম পর্যায়ে প্রাণিদের চিকিৎসা ও পরামর্শ সার্বক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ সেবা সম্প্রসারণ করার জন্য আমাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
৩. দেশের বিভিন্ন এলাকায় উন্নতমানের গবেষণাগার ও পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা।
৪. দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতীয় ডেইরি ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন, জাতীয় পোল্ট্রি ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ও জাতীয় বিফ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন নামক প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিলে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
৫. প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ইপিডেমিওলজি ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে খামারিদের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার হাত থেকে অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে।
৬. খামারিদের উৎপাদিত পণ্য সুষ্ঠুভাবে বিপণনের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আলাদা বিপণন প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি, যা মহামারীর সংকটকালে এর প্রয়োজনীয়তার বাস্তব চিত্র সবার মাঝে ফুটে উঠেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রাণিসম্পদ খাত আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি মানবদেহের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলও সরবরাহ করে থাকে। সর্বোপরি দুধ, মাংস ও ডিম মানুষের মেধা বিকাশের অন্যতম হাতিয়ার। মেধাবী জাতি যদি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, তবে মেধা-মননকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য সেক্টরকে এগিয়ে নিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব হবে ২০৪১ সালের আগেই।
তথ্যসূত্র:
১. খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
২. Trends in food science and technology জার্নালে প্রকাশিত ‘The future supply of animal derived protein for human consumption’ নামক আর্টিকেল
৩. 8 years annual report of fisheries and livestock department (2009-2017)
লেখক: ভেটেরিনারি সার্জন, বিসিএস (প্রাণিসম্পদ), ডিভিএম (সিভাসু), এমএসইন এনিম্যাল অ্যান্ড পোল্ট্রি নিউট্রিশন।
সুত্রঃ জাগো নিউজ