কৃষিবিদ জুয়েল রানা

বাঙালী ভোজন রসিক- কথাটি এই জনপদের সবখানেই প্রচলিত। সুপ্রাচীনকাল থেকেই রন্ধনশৈলীকে চৌষট্টি কলার অন্যতম কলা বলে গণ্য করা হত। আদিম যুগে মানুষ সব খাবারই কাঁচা খেতে অভ্যস্ত ছিলো। কিন্তু আগুন আবিষ্কারের পর ঝলসে খাওয়ার পাশাপাশি খাদ্য গ্রহণ ও প্রক্রিয়াজতকরনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন চলে আসে। শুরু হয় খাবার রান্না করা নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভোজনরসিকদের কাছে খাবারের চেয়ে ভোজনতৃপ্তি বা মুখের স্বাদই হয়ে উঠে বেশি গুরুত্বপুর্ণ।

রবীঠাকুর হেমন্তবালা দেবীর মেয়ে বাসন্তীকে লিখেছেন, ” আমাকে পেটুক বলে যদি কল্পনা কর তাহলে ভুল করবে। আমি যতটা খাই তার চেয়ে বেশি গুণ গাই।” কবি নিজে নতুন রান্না আবিষ্কার করতেন নানারকম নতুন খাবার রান্নার পদ্ধতি শেখাতেন স্ত্রীকে।ই
পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে অদ্ভুত, রুচিহীন কখনো নিকৃষ্ট খাবার খেতেও দেখা যায়। অবশ্য এতে অবাক হবার কিছু নেই। আধুনিক বিশ্বে কৃষি উৎপাদন থেকে শিল্পোৎপাদনের অর্থনীতিতে খাদ্যকে মানুষ চিনেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। একখন্ড আলুর পিস জমকালো প্যাকেটজাত হয়ে এসেছে পটেটো চিপস আকারে। ১০টাকা কেজি টমেটো নান্দনিক বোতলজাত হয়ে এসেছে ১২০টাকার ক্যাচ-আপ হয়ে। খাদ্যের বাহারে এমন চমৎকার উদাহরণের অভাব নেই আজ। খাদ্য যখন এমনই এক জটিল প্রক্রিয়ায় আমাদের সামনে হাজির, তখন ভোজনরসিকদের মুখতৃপ্তির পাশাপাশি অনেক বিষয়ে সচেতন হবার সময় এসেছে।

মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিয়ে। নিরাপদ খাদ্যের অধিকার তাই দেশে দেশে সংবিধানসম্মত অধিকার হিসাব স্বীকৃত। নিরাপদ খাদ্য শুধুমাত্র মানবস্বাস্থ্য ও পূষ্টির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয় বরং একটি সুস্থ্য-সবল জাতি গঠন তথা সমৃদ্ধ অর্থনীতি বিনির্মাণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

অধিক মুনাফা অর্জনের সহজতম পথ হিসাবে এদেশে খাদ্যে ভেজাল বা দূষণকারীরা সক্রিয়। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের খবরে আমরা দেখেছি যে, মুড়িতে হাইড্রোজ-ইউরিয়া, গুড়া মসলায় ইটের গুড়া, হলুদে মটর ডাল, ধনিয়ায় কাঠের গুড়া, পোস্তদানায় সুজি, খাবারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রঙ এর ব্যবহার থেকে শুরু করে শাকসব্জিতে বিষাক্ত রাসায়নিক, অসময়ে ফল পাকাতে কার্বাইড, মাছ-মাংসে মাত্রাতিরিক্ত ফরমালিনের ব্যবহার। এছাড়া রাসায়নিক পেস্টিসাইড ও যথেচ্ছা হরমোনের ব্যবহারতো আছেই। মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুকিপুর্ণ এসব ভেজাল খাবার খেয়ে বাড়ছে ক্যান্সার,লিভার সিরোসিস, কিডনী জটিলতা,বিকলাংগ বা প্রতিবন্ধী শিশুসহ নানাবিধ দূরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ।

সরকার জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে নিরাপদ খাদ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাপক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। সচেতনতা বৃদ্ধিসহ পরিবেশবান্ধব কৌশল অবলম্বনে জোড় আরোপের পাশাপাশি ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করে চলেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নতুন নতুন কর্মসূচীর মাধ্যমে মুনাফালোভীদের হাত থেকে খাদ্যের দূষণরোধে সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা কোন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়-এই গুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি আগে বুঝতে হবে।

এ বছরের জুন মাসের ৭ তারিখে পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস যার প্রতিপাদ্য বিষয় ” ফুড সেফটি, এভরিওয়ানস বিজনেস”।. নীতিনির্ধারনী পর্যায়, বেসরকারী সংস্থা, সিভিল সোসাইটিসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আপামর জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে দিবসটি পালিত হতে হবে। দিবসটির গুরুত্ব বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ যথাযথভাবে অনুধাবন করার দাবী রাখে বৈকি।

কৃষি উৎপাদনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত যে কোন ধাপেই খাদ্য দূষন বা ভেজালের শিকার হতে পারে। নিরাপদ খাদ্যের ধারণাটি ব্যাপকতর। সমগ্র পৃথিবীতে ভেজাল খাদ্যের কারণে অসুস্থ হয় প্রায় ৬শ’ মিলিয়ন মানুষ যার মধ্যে ৪ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য ও পানি বাহিত রোগে মারা যায়। তাই খাদ্য উৎপাদন, রক্ষনাবেক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, রন্ধণ এমনকি ভোক্তা কর্তৃক খাদ্য গ্রহণ প্রতিটি ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বনপুর্বক ফুড স্ট্যান্ডার্ড মেইন্টেইন করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা যৌথভাবে এবারের বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস পালনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কিছু কেমপেইন পরিচালনা করবে।

  • সরকারকে অবশ্যই উৎপাদিত খাদ্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
  • উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং খাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা
  • খাদ্য ব্যবসায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক খাবারগুলোকে নিরাপদ রাখা।
  • নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সকল উন্নয়ন সহযোগীদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা।

অসাধু খাদ্য ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম আইন প্রয়োগ করেও কমানো যাচ্ছেনা। আরেকদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে নানাবিধ জীবাণু,মাইকোটক্সিন বেড়ে চলেছে। হেভি মেটাল পলিউশন ঢুকে পরেছে আমাদের খাদ্য শৃংখলে। ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদার চাপ দেশের কৃষি ব্যবস্থার উপর। করোনাকালীন বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন বেশি করে পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাবার খেতে।

কৃষিতে বিপুল পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই বাড়ছে রাসায়নিক পেষ্টিসাইড আর হরমোনের ব্যবহার। এহেন অবস্থায়, বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে সহযোগিতা ছাড়া নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা দুরুহ কাজ। জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে পারলে এর সুপ্রভাব স্থানীয় ভোক্তা পর্যায়ে পাওয়া যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান বলছে, দরিদ্র দেশে দুষিত খাদ্য গ্রহণের পরিমান অনেক বেশি।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের “বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি” শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়েছে শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে দেশে প্রতিবছর ৩ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া গর্ভবতী মায়েদের শারীরিক জটিলতাসহ বিকলাংগ শিশুর জন্ম হচ্ছে প্রায় ১৫ লাখ। খাদ্যে ভেজাল মুক্ত না হলে মানব উন্নয়ন ও সম্ভব নয়। কৃষি উৎপাদনের সকল ধাপে ফসল নিরাপদ রাখার প্রযুক্তিগুলো কাজে লাগাতে কৃষিবিদবৃন্দ যেন আরো অবদান রাখতে পারে সেরকম একটি কাঠামো দাঁড় করানো প্রয়োজন। বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নামক জাতীয় প্রতিষ্ঠানে কৃষিবিদদের প্রায়োগিক জ্ঞান কাজে লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে করে নি:সন্দেহে উৎপাদনের প্রথম স্তর থেকেই ফসল নিরাপদ রাখার কার্যক্রমটি নতুন মাত্রা পাবে।

আমাদের সকল মানসিক, শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য ও কল্যাণের উৎসই খাদ্য। নিরাপদ খাদ্য এসডিজি অর্জনেরও নিয়ামক। খাদ্যের দূষণরোধে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্যের বাংলাদেশ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করার সময় এখনই।

লেখক: কৃষিবিদ জুয়েল রানা, আইপিএম স্পেশালিস্ট, বিসিএস (কৃষি), পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প, ডিএই,খামারবাড়ি, ঢাকা।

সুত্রঃকৃষি প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *