নিউজ ডেস্কঃ
পেঁয়াজের বীজ চাষ করে আত্মনির্ভরশীল তো বটেই বরং অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার সাহিদা বেগম।
বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে সাহিদা বেগম বলেন, প্রায় ১৮-১৯ বছর ধরে পেঁয়াজের বীজের আবাদ করে চলেছেন তিনি। আর চলতি বছর প্রায় ২০০ মণ পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করেছেন তিনি।
মৌসুমে এই বীজ মণ প্রতি ২ লাখ টাকা করে বিক্রি করেছেন। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে পেঁয়াজের বীজ বিক্রি হয়েছে ৫-৬ হাজার টাকা কেজি দরে।
বুধবার দুপুরে যখন মুঠোফোনে সাহিদা বেগমের সাথে কথা হচ্ছিল তখন তার বাড়িতে চলছিল পেঁয়াজ লাগানোর তোড়জোর।
তিনি বলেন, এ বছর এরই মধ্যে বীজ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। বাছাই করার পর পেঁয়াজের বাল্ব জমিতে লাগাতে মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাজ করছে ১২ জন শ্রমিক।
তাদের দুপুরের খাবার প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। আর সেই সাথে পেঁয়াজ লাগানো এবং তা থেকে বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার তদারকি তো আছেই।
“এখন আমাদের সিজন। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আমরা পেঁয়াজ লাগাই। অনেক লেবার থাকে। ৩০-৪০, এমনকি ৫০ জনও থাকে”।
তবে বছরের এ সময়টাতে অন্য বছর আরো বেশি শ্রমিক থাকে। এবার কিছু জমির মাটিতে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় কাজ কিছুটা ধীরে চলছে।
“এ বছর কিছু জমি নরম হয়ে গেছে। তাই কাজ কিছু বন্ধও আছে। ওগুলো শুকালে আবার কাজ শুরু হবে।”
বীজ উৎপাদনের জন্য যে পেঁয়াজ এখন লাগানো হচ্ছে তার ফলন আসবে আগামী এপ্রিল-মে মাসে।
সাহিদা বেগম বলেন, কৃষক পরিবারের বউ হওয়ার কারণে আগে থেকেই নানা কৃষিকাজের সাথে পরিচয় ছিল তার। তিনি জানান, তার শ্বশুর মূলত পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কখনোই আসলে বেশি পরিসরে চাষ করা হয়নি।
তিনি নিজেও অনেকটা শখের বশেই এই চাষ শুরু করেন।
“আশপাশের কেউ কেউ খুব কম করে পেঁয়াজের বীজ চাষ করতো। আমারো মনে হলো আমি করে দেখি। তাই করলাম।”তিনি বলেন।
সাহিদা বেগম জানান, ২০০৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের আগে ২০ শতক জমিতে পেঁয়াজের বীজ চাষ করেন তিনি। সে বছর মাত্র দুই মন বীজ উৎপাদিত হয়েছিল।
সেগুলো বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৮০ হাজার টাকা। পরের বছর আরো বেশি পরিমাণ জমিতে পেয়াজের চাষ করতে শুরু করেন তিনি। সেবছর পান ১৩ মণ বীজ।
“বীজ বিক্রি করে দেখলাম যে আমি ভালই লাভবান। পরের বছর আরো জমি বাড়াইলাম। ৩২ মণ বীজ উঠলো। এভাবেই আমার ওঠা।”
এর পর আর থেমে থাকেননি। সাহিদা বেগম জানান, গত বছর ১৫ একর আর চলতি বছর ৩০ একর জমিতে পেঁয়াজের বীজের চাষ করেছিলেন। ঘরে তুলেছিলেন ২০০ মন বীজ।
“অনেক শ্রম দিতে হয়, কষ্ট করতে হয়। পেঁয়াজের বীজের অনেক যত্ন করতে হয়। এখন লাগাবে, দুই দিন পর নিড়াবে (আগাছামুক্ত করা)। বার মাসই লেবার থাকে।”
সাহিদা বেগম বলেন, আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি জমিতে পেঁয়াজের বীজের চাষ করলেও অনেক সময় চাহিদা পূরণ করতে পারেন না তিনি। ফরিদপুর জেলার স্থানীয় কৃষক তো বটেই, পুরো বাংলাদেশে তারা বীজ সরবরাহ করে থাকেন তারা।
“আমাদের বীজ ভাল বলে চাহিদা থাকে। কৃষকরা অনেক খুশি। কারণ এর মধ্যে কোন ঝামেলা নাই। নিজের প্রোডাক্ট, কোন ভেজাল নাই।”
তিনি বলেন, “এবছর আরো ৫০০ মণ থাকলেও বিক্রি করতে পারতাম। এতো চাহিদা।”
তবে পেঁয়াজ চাষে খরচও কম নয় বলে জানান তিনি। পেঁয়াজের বাল্বের দাম অনেক বেশি থাকে। এছাড়া কীটনাশক, সার, সেচ দেয়ার ক্ষেত্রে খরচ বেশ ভাল পরিমাণে হয়।
এছাড়া অতিরিক্ত কুয়াশা, শীলাবৃষ্টি, ঝড়-বৃষ্টি বেশি হলেও বীজ নষ্ট হয়ে যায় বলে জানান তিনি।
সাহিদা বেগমের পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের কাজে সহায়তা করেন তার স্বামী বক্তার উদ্দিন খানও। যিনি পেশায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা।
স্বামী ছাড়াও পরিবারে দুই মেয়ে নিয়ে চার জনের সংসার সাহিদা বেগমের।
সাহিদা বেগম নিজেই গড়ে তুলেছেন পেয়াজের বীজের কারখানা। সেখান থেকেই বীজ প্যাকেটজাত করা এবং ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করা হয়।
তার তৈরি করা বীজ ক্রেতাদের কাছে পরিচিত খান সিডস নামে।
সাহিদা বেগম বলেন, তার এই কারখানায় কাজ করে স্থানীয় অনেকে। আর তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পেয়াজের বীজ চাষ করতে শুরু করেছেন স্থানীয় আরো অনেক নারীও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর পেঁয়াজের বীজের চাহিদা বেশি থাকার কারণে দাম ছিল বেশ চড়া।
প্রতি কেজি বীজ বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা দরে। সে হিসেবে সাহিদা বেগম প্রায় চার কোটি টাকার বেশি বীজ বিক্রি করেছেন।
ফরিদপুরের নগরকান্দা এলাকার পুরাপাড়া বাজারের কৃষিঘর বীজ ভান্ডারের মালিক মিজানুর রহমান জানান, বীজের মান ভাল হওয়ার কারণে খান সিডস থেকে ৫০০ কেজির মতো বীজ কিনেছিলেন তিনি।
মি. রহমান বলেন, এই বীজ থেকে চারা গজানোর হার বেশি থাকে বলে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে চাহিদা রয়েছে প্রচুর।
“সব বারের মতো এবারও বেছন(চারা গজানো) অনেক ভাল হয়েছে। পেঁয়াজও ভাল হবে।”
ফরিদপুর জেলায় পেয়াজের বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সেরা চাষী হিসেবে পুরষ্কারও পেয়েছেন সাহিদা বেগম।
বর্তমানে উৎপাদন করছেন, রাজশাহী তাহিরপুর, সুপারকিং, সুখসাগর ও নাসিরকিং নামে পেঁয়াজের বীজ। এছাড়া হাইব্রিড পেঁয়াজের বীজও উৎপাদনও করছেন তিনি।
সাহিদা বেগম বলেন, “প্রতি বছরই আমরা নতুন জাতের পেঁয়াজ আনি যাতে কৃষকদের প্রতিবছর নতুন কিছু দিতে পারি।”
কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, বাংলাদেশে পেয়াজ উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে ফরিদপুরের অবস্থান দ্বিতীয়।
আর পুরো দেশে পেয়াজের বীজের যে চাহিদা থাকে তার ৬০-৭০ ভাগ এককভাবে আসে ফরিদপুর জেলা থেকে।
সূত্র: বিবিসি