ফজলুল করিম বাবলু:
রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত গোদাগাড়ীতে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি অধিক লাভজনক ফল চায়না কমলার চাষ শুরু হয়েছে। শুধু চায়না কমলাই নয়; চাষ হচ্ছে মাল্টা, লেবু ও শরিফা (লেওয়া) ফলের। এতে করে একদিকে যেমন বেকারত্ব কমছে, অন্যদিকে আমদানী করতে প্রচুর অর্থ বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে হবে না। সেইসাথে পুষ্টি ও ভিটামিনের চাহিদাও পুরণ হবে অনেকাংশে। গোদাগাড়ীর এই অ লে এক যুগ পূর্বে পানির অভাবে ধান ছাড়া তেমন কোন ফসলের চাষ হত না। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির উপর নির্ভর করে কৃষকেরা একটি মাত্র ফসল হিসেবে ধান চাষ করতেন।
সময়ের বিবর্তনের সাথে ঘুরতে থাকে গোদাগাড়ী অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নের চাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অক্লান্ত পরিশ্রমে বরেন্দ্র অঞ্চল সবুজে ভরে উঠতে থাকে। সময়োপযোগী আধুনিক ও জলবায়ুসহিষ্ণু বিভিন্ন জাতের ফসলের বিস্তৃতিতে ধীরে ধীরে উত্তরের শস্য ভান্ডারে পরিণত হতে থাকে একসময়ের রুক্ষ মাটির অঞ্চল গোদাগাড়ী। এই এলাকার জমি উঁচু হওয়ায় এবং বন্যার পানি মাঠে প্রবেশ না করায় অন্যান্য ফসল ও ফলের পাশাপাশি শুরু হয়েছে একই জমিতে মিশ্র ফসলের চাষ।
অত্র উপজেলার দেওপাড়া, রিশিকুল, গোগ্রাম, মোহনপুর ও পাকড়ী ইউনিয়নসহ অন্যান্য স্থানে কম বেশী ভিটামিন সি জাতীয় ফসলের চাষ করতে শুরু করেছেন কৃষকরা। গোদাগাড়ীর গোগ্রামে চারঘাট উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম ৭০ বিঘা জমি নিয়ে একই জমিতে চায়না কমলা, মাল্টা, লেবু ও শরিফার চাষ করেছেন। তার বাগানে এক হাজার চায়না কমলা, বারি-১ জাতের মাল্টা দুই হাজার দুইশ, লেবু দুই হাজার তিনশ ও শরিফা সাতশটি গাছ রয়েছে। লিজ নেয়া থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তার বাগানে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানান ম্যানেজার আবু সায়েম।
তিনি বলেন, এ বছরই ফল আশা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে লেবু সংগ্রহ করে মার্কেটে বিক্রি করলেও কমলা ও মাল্টা কেবল বড় হওয়া শুরু করেছে। আর শরিফা গাছে এখনো কোনো ফল আসা শুরু করেনি। তিনি বলেন, প্রতিটি গাছে যেভাবে ফল আসছে, প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ না হলে ভাল ব্যবসা হবে। সেই সাথে তারা ভাল লাভ করতে পারেন বলে জানান সায়েম।
বাগান মালিকের ভাগ্নে মাহ্বুবুর রহমান বলেন, লাভজনক জেনেই এই ধরনের ফল চাষে তারা উদ্বুদ্ধ হন। এরপর চুয়াডাঙ্গা থেকে চারা নিয়ে এসে রোপণ করেছেন। কি ধরনের জমি এবং কোন সময়ে চারা রোপণ করতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন উঁচু জমিতে আলু চাষের ন্যায় জমি চাষ করে মাটি ভাল করে আলগা করে এর সঙ্গে বিঘাতে ১২৫ কেজি ডলো চুন মিশিয়ে বেড তৈরী করে চারা রোপণ করতে হয়। ১২ ফিট পর পর একটি করে চারা রোপণ করতে হয় এবং রোপণের পর সেচ প্রদান করতে হয়। জমিতে কোনোভাবেই পানি জমতে দেওয়া যাবে না বলে তিনি সতর্ক করেন। পানি জমে থাকলে গাছ লাল হয়ে যাবে এবং মরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে বলে জানান।
তিনি বলেন, সর্বোচ্চ ১৮ মাস হলেই গাছে ফল দেখা যায় এবং এই চারা একবার রোপণ করলে ১৮ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যাবে বলে। রোগ বালাই সম্পর্কে তিনি বলেন, এই ফসল সমুহে তেমন কোনো রোগবালাই নাই। তবে ল্যাদা ও মাকড় পোকার আক্রমন হয় । এই পোকার আক্রমন এবং গাছ বেড়ে উঠার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গোগ্রাম ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার মওদুদ ইসলাম শিশির এর পরামর্শ মোতাবেক বিষ প্রয়োগ ও গাছের গোড়ায় গোলাকার করে ভার্মি কম্পোষ্ট সার প্রয়োগ করছেন বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন খরা মৌসুমে ১৫দিন পর পর জমিতে সেচ দিতে হবে। এই বাগান থেকে তিনি আগামীতে ভাল অর্থ আয় করতে পারবেন বলে আশা করেন। লেখাপড়া জানা বেকার তরুণ তরুণী ও অন্যান্য কৃষকদের শুধু চাকরী বা চিরাচরিত পেশায় না থেকে অধিক অর্থ আয় করার লক্ষ্যে লেবু জাতীয় এই ধরণের ফল চাষ করার আহবান জানান তিনি।
রোগ-বালাই ও এর প্রতিকার সম্পর্কে গোগ্রাম ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার মওদুদ ইসলাম শিশির বলেন, লেবু জাতীয় ফল যেমন কমলা, মাল্টা ও লেবুর প্রধান সমস্যা হচ্ছে মাকড়, পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা ও লেমন বাটারফ্লাই। মাকড় পোকা গাছের বাড়ন্ত অবস্থায় বেশী আক্রমন করে থাকে। এই পোকা পাতার রস চুষে নিয়ে পাতা কোঁকড়া করে ফেলে। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। গাছ বাড়তে বাধাগ্রস্থ হয় এবং ফলন কম হয় বলে তিনি জানান। এই পোকা দমনে নিয়মিত বাগান পরিদর্শন ও আক্রমনকৃত পাতা ছিড়ে ফেলে মাটিতে পুঁতে ফেলার পরামর্শ প্রদান করেন তিনি।
সেইসাথে মাকড় দমনে এব্যামেকটিন গ্রুপের মাকড়নাশক প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ থেকে ২ মিলি গ্রাম করে পানিতে মিশ্রন করে পরন্ত বিকেলে জমিতে স্প্রে করতে হবে বলে তিনি পরামর্শ প্রদান করেন। পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকার আক্রমণ দেখা দিলে ফেনিট্রথিয়ন জাতীয় কীটনাশক অথবা ক্লোরপাইরিফস জাতীয় কীটনাশক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।
এছাড়াও গাছের আকারের উপর নির্ভর করে এর পরিমান কম বেশী করা যাবে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, লেমন বাটারফ্লাই পোকা গাছের নতুন পাতা ও কুশি কেটে দিয়ে গাছের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এই পোকা দমনে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২মিলি করে মিশ্রণ করে বিকেলে স্প্রে করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এই সকল রোগের সাথে মাল্টা গাছে পঁচন রোগ দেখা দেয়। গাছের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত শুকিয়ে যায় এবং গাছ মরে যায়। এই রোগ প্রতিরোধে ও দমনে কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক ১০ লিটার পানিতে ৪ গ্রাম করে মিশ্রণ করে বিকেলে গাছে স্প্রে করার পরামর্শ দেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মতিয়র রহমান বলেন, গোদাগাড়ী উপজেলায় ব্যাপকভাবে মাল্টা, চায়না কমলা ও লেবু বাগান হয়েছে। একটু পরিকল্পিতভাবে বাগান তৈরি করলে এই সেক্টরে অনেক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে মাল্টার বাজার তৈরি হয়েছে এবং ঢাকা থেকে পাইকাররাও এসে বাগান চুক্তিতে মাল্টা কিনে নিচ্ছে। চাহিদা ও দাম ভালো থাকায় কৃষকেরা অনেক আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ভালো ফলাফল পাওয়ায় পর্যায়ক্রমে মাল্টা, চায়না কমলা ও লেবু চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি বলেন, এসব ফসলের রোগ-বালাই বাড়ন্ত অবস্থায় হয়। গাছ একবার বড় হয়ে গেলে তেমন কোন রোগ মাল্টা গাছের হয়না। যারা চাষ করেছেন এবং আগামীতে করবেন গাছের রোগ-বালাই নিয়ে চিন্তা না করে নির্দিধায় লেবু জাতীয় বাগান করে লাভজনক কৃষি কাজ করার পরামর্শ প্রদান করেন তিনি।
উপজেলা কৃষি অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, “গোদাগাড়ীর বরেন্দ্র এলাকায় উচ্চ মূল্যের ফসল হিসেবে লেবু জাতীয় ফসলের চাষাবাদ করা হচ্ছে। এই এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে লেবু জাতীয় ফসলের চাষাবাদ করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরই প্রথম বিভিন্নভাবে কৃষকদের উৎসাহ দিয়েছে। ফলাফলস্বরূপ বর্তমানে শতাধিক হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে মাল্টা, কমলা ও লেবুর বাগান তৈরি হয়েছে।
যেহেতু এসব ফলচাষে তুলনামূলক অনেক কম পানির প্রয়োজন হয়, রোগবালাই কম এবং আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করার সুযোগ রয়েছে। তাই, গোদাগাড়ীতে এখন আরো বাগান তৈরিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সাইট্রাস প্রকল্পের প্রদর্শনী আকারে আরো বাগান তৈরি করা হচ্ছে এবং কৃষকদের পাশে থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার চেষ্টা করছেন বলে জানান উপজেলা কৃষি অফিসার শফিকুল ইসলাম ।
তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর পার্শবর্তী দেশ ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে কোটি কোটি টাকার এই ফল আমদানী করতে হয়। এতে করে দেশের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এই বাগান করার ফলে যেমন একদিকে বেকারত্ব কমবে অন্যদিকে ভিটামিন ও পুষ্টির চাহিদা মেটাবে। তিনি বলেন, চার বছরের একটি গাছ হতে দুই থেকে আড়াইশ মাল্টা বছরের পাওয়া যায়। আর বাজারের একটি মাল্টা দাম ২৫-৩০ টাকার কম নয় বলে তিনি জানান। এই অঞ্চল সহ দেশের অন্যান্য স্থানে যেভাবে এর চাষ শুরু হয়েছে অদূর ভবিষ্যতে আমদানী না করে বাংলাদেশ এই ফল রপ্তানী করতে পারবে বলে তিনি আশা করেন।