ড. আব্দুর রাজ্জাক
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশের সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি এবং সার্বিক জীবনপ্রবাহ কৃষিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বাংলাদেশ এখনো গ্রামীণ বাংলাদেশ-পল্লী বাংলাদেশ। কেননা এ দেশের ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। কৃষিতে ৪১ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। কৃষি বাংলাদেশের ১৬ দশমিক ৫ কোটি মানুষের শুধু খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করে না, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের জোগানও দেয়। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি অদূরভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও উর্বর জমি সারা বছর ধরে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। ফসলের পাশাপাশি এ দেশের কৃষক আদিকাল থেকে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালন করেন এবং বাড়ির আঙ্গিনায় পুকুর, ডোবা-নালা থাকলে সেখানে মাছ চাষ করেন। প্রাকৃতিক জলাশয়-নদী, খাল-বিল, সমুদ্রে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, কৃষি অর্থনীতির চারটি মূল উপখাত—ফসল, প্রাণিসম্পদ, মত্স্য ও বন—বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যমান। বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্পের কারণে বাংলা ছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল, যা সহজেই বিদেশী শাসকগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করত। শাসন ও শোষণের জন্য দীর্ঘদিন দিল্লির মোগল ও ইংরেজ শাসকদের সর্বোচ্চ অর্থসম্পদের উৎস ছিল বাংলা। সর্বশেষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক শাসকদের ন্যায় একটানা ২৩ বছর সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বর্তমান পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলে। এভাবে বাংলার কৃষক ছিলেন চিরদিন শোষণ-শাসনের শিকার এবং চিরবঞ্চিত ও অবহেলিত। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করলেও তার সুফল তারা ভোগ করতে পারেনি। সামন্ত ভূস্বামী, জমিদার, মহাজনদের দ্বারা প্রতারণা ও শোষণের জাঁতাকলের কারণে তাদের দুঃখকষ্টের সীমা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৈশোর-তরুণ বয়স থেকে বাংলার কৃষকের দৈন্য স্বচক্ষে দেখেছেন, যা বঙ্গবন্ধুর হূদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুর সারা রাজনৈতিক জীবনে কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন ও কল্যাণ ভাবনা নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশে জন্মালেই যে দেশ আপন হয় না, সে কথা তিনি সবাইকে মনে করিয়ে বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ দেশকে না জানি, যতক্ষণ তাকে নিজের শক্তিতে জয় না করি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়।’ মনে হয় কবিগুরুর কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেমের চেতনায় সুদৃঢ়ভাবে স্থান করে নিয়েছিল। তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য শ্যামল বাংলার নদী-নালা, খাল-বিল, প্রান্তরে-প্রান্তরে ঘুরেছেন। মানুষের আস্থা ভালোবাসা অর্জন করেছেন, নিজের আত্মশক্তিতে তাদের মন জয় করেছেন। বাংলার দুঃখী মানুষ-কৃষক শ্রমিকের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম।
কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর প্রয়াস: পাকিস্তান পর্ব
পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষক ও কৃষি উন্নয়নের কথা বলতেন অত্যন্ত জোরালোভাবে। পাকিস্তানের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় কৃষি উন্নয়ন, পাটের মূল্য, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় সবিশেষ গুরুত্ব পায়। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন উপলক্ষে ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘এ-যাবৎ বাংলার সোনালি আঁশ পাটের প্রতি ক্ষমাহীন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে।’ এখানে তিনি পাটের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। ‘একটা স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষিপণ্যের অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সব প্রচেষ্টা নিতে হবে। চাষীদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থায় বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক।’ নয় মাসব্যাপী একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে তিনি বলেন, ‘আমাদের চাষী হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’ ষাটের দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ‘সবুজ বিপ্লব’ শুরু হলেও তার ছোঁয়া পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের মাটিতে লাগতে দেয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠনের পর পরই বঙ্গবন্ধু উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন উদ্যোগ
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেই নিলেন কৃষকদের জন্য এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তাদের সব বকেয়া খাজনার সুদ মওকুফ করে দিলেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনাও মওকুফ করার ঘোষণা দিলেন। তিনি কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী ভূমি সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিলেন। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করে উদ্বৃত্ত জমি ও খাসজমি ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীদের মধ্যে বণ্টনের উদ্যোগ নিলেন। পাকিস্তানি শাসন আমলে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেন এবং তাদের সব বকেয়া ঋণ সুদসহ মওকুফ করে দেয়া হয়। দেশের জন্য দ্রুত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করেন প্রথম পরিকল্পনা কমিশন।
বিএডিসির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকার ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচযন্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি সারের ব্যবহার ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন। যেখানে ১৯৭১-৭২ সালে সারের ব্যবহার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টন, ১৯৭৪-৭৫ সালে তা ৩ লাখ ৫০ হাজার টনে উন্নীত হয়। নগদ ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কৃষকের মাঝে সেচযন্ত্র বিক্রির ব্যবস্থা করেন। যেখানে ১৯৭১-৭২ সালে অগভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল ৬৮৫, গভীর নলকূপের সংখ্যা ৯০৬ এবং পাওয়ার পাম্পের সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ২৪৩, তা ১৯৭৪-৭৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪ হাজার ২৯, ২ হাজার ৯০০ এবং ৪০ হাজারে। ১৯৭২ সালের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে বিনা মূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে কৃষি উৎপাদনের জন্য ১৬ হাজার ১২৫ টন ধানবীজ, ৪৫৪ টন পাটবীজ ও ১ হাজার ৩৭ টন গমবীজ সরবরাহ করা হয়। প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী (১৯৭৩-১৯৭৮) পরিকল্পনায় কৃষিতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩১ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৭ শতাংশ। পুরো সময়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বরণের পর সামরিক স্বৈরাচারদের আমলে কৃষিতে বরাদ্দ কমে যায়। যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে কৃষি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ কমে আশঙ্কাজনক হারে। তৃতীয় ও চতুর্থ বার্ষিকীতে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ। ১৯৭১-৭২ সালে যেখানে খাদ্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি টন, মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৭৪-৭৫ সালে তা উন্নীত হয় ১ কোটি ১৪ লাখ টনে।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির জন্য প্রযুক্তি ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কৃষি গবেষণার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমন্বয়ের জন্য কোনো শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর আইনগত কাঠামো দিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন তিনি। আজকের স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ১৯৭৩-এর অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আইনগত কাঠামো পায়। পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা, মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন বা কাঠামোগত উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে শুরু হয়।
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গমন একটি চিরস্মরণীয় ঘটনা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সবুজ বিপ্লব ও কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রমী চাষীদের সঙ্গে সঙ্গে মেধাবী কৃষিবিদদেরও প্রয়োজন হবে। মেধাবী ছাত্রদের কৃষিশিক্ষায় আকর্ষণ করার জন্য কৃষিবিদদের তিনি প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘চাউল পাওয়া যায় না। যদি চাউল খেতে হয় আপনাদের চাউল পয়দা করে খেতে হবে। না হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে বেটে খাওয়ালেও হবে না। সেদিকে আপনাদের নজর দিতে হবে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘খাদ্য শুধু চাউল-আটা নয়, মাছ-মাংস-ডিম-দুধ-তরকারিও আছে। কৃষিতে অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি, পোলট্রি যাই বলেন, সবদিকে নজর দিতে হবে। প্ল্যানওয়েতে চলতে হবে।’ আজ আমরা দানাজাতীয় খাদ্যের সঙ্গে পুষ্টিজাতীয় খাদ্য দুধ, ডিম, মাছ, মাংস ও ফলমূল-শাকসবজির কথা বলছি; যা বঙ্গবন্ধু সেই সময়েই অনেক গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণার ওপর এত গুরুত্বারোপ করেছিলেন কবিগুরুর সেই সময়ের কথাগুলো ধারণ করে।
বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও সাফল্য
গঙ্গা নদীর প্রবাহ থেকে অধিক পানিপ্রাপ্তি, সেচ ব্যবস্থার প্রসার, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকের ব্যবহার, নানা ধরনের প্রণোদনা এবং সার্বিক কৃষকদরদি নীতির ফলে কৃষি ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল, তার অনুসরণে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদে এবং টানা তৃতীয় মেয়াদে—২০০৯-২০১৪ প্রথম মেয়াদ, ২০১৪-২০১৮ দ্বিতীয় মেয়াদ এবং তৃতীয় মেয়াদের (বর্তমান সময় অবধি)—বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে বাংলাদেশ হয়েছে খাদ্য ঘাটতির দেশ। এই খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা করা হয়েছে হয় খাদ্য আমদানি করে অথবা বিদেশী সাহায্য দিয়ে। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলতেন, ভিক্ষুকের জাতির কোনো সম্মান থাকে না। বাংলাদেশ অস্বাভাবিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রায় প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঝড়, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের সম্পদ ও ফসলের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। সম্প্রতি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ফোরাম থেকে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও ঝুঁকি আরো বাড়বে। বাংলাদেশ পৃথিবীর ষষ্ঠতম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। তাছাড়া এ দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১২০০ মানুষ)। একটি দেশের খাদ্য উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সে দেশের চাষাবাদের ভূমি ও পানি। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে (প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে), অন্যদিকে শহর সৃষ্টি, শিল্প-কারখানা নির্মাণ, বাড়িঘর তৈরি ও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমছে। ১৯৭১-৭২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ, তা কমে এখন দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। কৃষি উন্নয়নে আগে বিদেশী সাহায্য পাওয়া যেত ওডিএর ১৮-২০ শতাংশ, যা কমে হয়েছে ৪ শতাংশেরও কম। দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়ায় মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পূরণের জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে অব্যাহতভাবে।
উল্লিখিত প্রতিকূল বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন এবং তা টেকসই রাখা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন চ্যালেঞ্জ। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সূচিত স্বৈরশাসন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারার অবসান হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসেবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন শুরু হয়। মাত্র পাঁচ বছরে উন্নয়ন অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে অর্জিত হয় চমকপ্রদ সাফল্য। প্রথমবারের মতো দেশ খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দেশে ৪০ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক ‘সেরেস’ পদকে ভূষিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আবার কৃষিতে স্থবিরতা নেমে আসে। ২০০১-০২ সালে দানাজাতীয় খাদ্যের উৎপাদন ২৬৮ লাখ টন থেকে নেমে আসে ২৬১ লাখ টনে। সূচিত হয় আবার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা।
দেশরত্ন শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ ও ‘রূপকল্প ২০২১’-এর আলোকে প্রণয়ন করেন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২১)’ এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, যা উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে আসছে। শেখ হাসিনা সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে (২০১৪-১৮) প্রণীত হয় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। রূপকল্প ২০২১ সামনে রেখে ২০০৯ সালে উন্নয়নের যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল, তার গতি ও পরিধি সরকারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। আনন্দের কথা হলো, বিগত বছরগুলোর ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বলয় অতিক্রম করে আজ ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এরই মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচনসহ এমডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশ সফলভাবে অর্জন করেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) গুরুত্ব সবিশেষ বিবেচনায় নিয়ে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বিত করা হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচন করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত লক্ষ্যগুলোর অন্যতম। দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল হচ্ছে কৃষি ও পল্লীজীবনে গতিশীলতা। কৃষিই দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। এ লক্ষ্যে ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন ও বীজ সরবরাহ, কৃষি উপকরণে প্রণোদনা প্রদান, সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রবর্তন এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, কৃষি খাতের উন্নয়নে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষিজমির আওতা সম্প্রসারণ, কৃষকদের ডাটাবেজ তৈরীকরণ, প্রশিক্ষণ, শস্য বহুমুখীকরণ, কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতের সহায়ক পরিবেশ সৃজন, কৃষিপুনর্বাসন সহায়তা প্রদান, কৃষি গবেষণার মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি গবেষণার জন্য এনডাউমেন্ট ফান্ড মঞ্জুর এবং উৎপাদন বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার্থে জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রম প্রতি বছর অব্যাহতভাবে করা হচ্ছে। ফলে, কৃষি খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ধানের উৎপাদন ৩ কোটি ৮৭ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। গম ১২ লাখ টন, ভুট্টা ৫২ লাখ টন এবং আলু উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি ৫ লাখ টন। ডাল, শাক-সবজি, ফলমূল, তেল ইত্যাদি ফসলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ধান উৎপাদনে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী দেশ।
গবাদি পশুপাখির টিকা উৎপাদন, চিকিৎসাসেবা প্রদান, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর ফার্ম, মত্স্য চাষের খামার স্থাপন কার্যক্রমে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। ফলে দুধ, ডিম, মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিজাতীয় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৫ লাখ টন, ১৯ দশমিক ৯ লাখ টন ও ৬০৭ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যথাক্রমে ১ কোটি টন, ৭২ দশমিক ৬ লাখ টন এবং ১ হাজার ৬০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। মত্স্য খাতের উন্নয়নে মত্স্যজীবীদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, অভয়াশ্রম স্থাপন, সমবায়ভিত্তিক মত্স্য ও মত্স্যজাত পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সামুদ্রিক মত্স্য সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য ফিশিং গ্রাউন্ড চিহ্নিতকরণ, মত্স্য সম্পদের প্রজাতিভিত্তিক মজুদ নিরূপণ এবং সর্বোচ্চ সহনশীল মত্স্য আহরণ মাত্রা নির্ণয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে মাছের উৎপাদন ২৭ দশমিক ১ লাখ টন থেকে বেড়ে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বিপন্নপ্রায় মত্স্য প্রজাতির সংরক্ষণ, প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য মুক্ত জলাশয়ে অভয়াশ্রম স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাছ, দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর বাণিজ্যিক উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানির জন্য উৎপাদক পর্যায়ে রাজস্ব ও আর্থিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
উপসংহার
বঙ্গবন্ধু কৃষি সমবায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং সমবায়ের আন্দোলনকে কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সময়ের কারণে সমবায় নিয়ে তার চিন্তাভাবনাগুলো বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। দেশরত্ন শেখ হাসিনা সমবায় ধারণাকে গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে একীভূত করে চালু করেছেন ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প, যা গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও দুষ্প্রাপ্য সীমিত সম্পদের ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখছে। গ্রামীণ মানুষের সঞ্চিত মূলধন কীভাবে আরো উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করা যায়, সে উদ্দেশ্যে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পল্লী এলাকায় মূলধন প্রবাহ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এটা সুদূরপ্রসারী অবদান রাখবে। বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের সাফল্য সারা পৃথিবীতে বহুলভাবে প্রশংসিত ও নন্দিত হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বের গণমাধ্যম বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে অভিহিত করছে।
ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক: মন্ত্রী, কৃষি মন্ত্রণালয়
সুত্রঃ বনিক বার্তা