1. mahbub@krishinews24bd.com : krishinews :

বন্যাকবলিত করোনাকালের কৃষি

  • আপডেট টাইম : Monday, July 20, 2020
  • 818 Views
বন্যাকবলিত করোনাকালের কৃষি মোহাম্মদ লোকমান হোসেন মজুমদার
বন্যাকবলিত করোনাকালের কৃষি, মোহাম্মদ লোকমান হোসেন মজুমদার

মোহাম্মদ লোকমান হোসেন মজুমদার

করোনা মহামারি ও আম্পানের ধ্বংসলীলা সামলে উঠার আগেই উপর্যপুরি বন্যার ছোবল কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক অশনি সংকেত। প্রধান প্রধান নদ-নদী সমুহে বিপৎসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বন্যার পানি। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে অগ্রসর হয়ে বন্যা ধাবিত হচ্ছে মধ্যাঞ্চলের দিকে, প্লাবিত হচ্ছে বিস্তৃর্ণ এলাকা ও ফসলের মাঠ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ধান, আমন ধানের বীজতলা, সব্জি ফসল, ভুট্টা, তিল, কাউন, পাট, ভেসে গেছে অসংখ্য মৎসঘের ও পুকুর, প্লাবিত হয়েছে ঘরবাড়ি, খামার ও গবাদি পশুর আশ্রয়স্থল; ১৮ টি জেলার প্রায় ২২ লাখ মানুষ পানিবন্দি। সামনের দিনগুলোতে রয়েছে আরো ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস। অতিবৃষ্টির সাথে উজান থেকে নেমে আসা পানি ও জোয়ারের পানি যোগ হয়ে দক্ষিণাঞ্চলেও দেখা দিতে পারে বন্যা।

করোনার ভয়ংকর থাবায় দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির কথা দেশী-বিদেশী সকল সকল সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। এ অবস্থায় বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় কৌশলগত উৎপাদন ব্যবস্থাপনা হাতে নিতে হবে। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে আমন ধানের চারা রোপনের সময়। চাল উৎপাদনে বোরোর পর আমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এবং তুলনামুলক কম ঝুঁকিপূর্ণ মৌসুম। এ বছর আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে যাতে সম্ভাব্য উৎপাদন হবে ১ কোটি ৫৪ লাখ মে.টন চাল। কাংখিত কৃষি উৎপাদনের জন্য আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং আগাম রবি ফসল আবাদের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই।

বন্যাপ্রবণ এলাকার জন্য নিমজ্জিত অবস্থায় টিকে থাকার ক্ষমতা সম্পন্ন আমন ধানের জাত ব্রিধান ৫১, ৫২, ৭৯ এবং বিনা ধান ১১ ও ১২ সবচেয়ে ভাল। পানি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভবনা থাকলে প্রয়োজন সাপেক্ষে এক মিটার গভীরতা সম্পন্ন বন্যার উপযোগী জাত ব্রিধান ৯১ চাষ করা যেতে পারে। বিলম্ব ক্ষতি কমাতে আগাম বা স্বল্পমেয়াদী জাতসমুহ যেমন: ব্রিধান ৩৩, ৩৯, ৭১ এবং ৭৫ চাষ করা যেতে পারে। উঁচু জমিতে আগাম রবি ফসল আবাদের সুবিধার জন্যও এ জাতগুলো বেশ উপযোগী। বন্যা দীর্ঘায়িত হলে পানি নেমে যাবার পর দ্রæত নাবী জাত যেমন: বিআর ২২, ২৩, ব্রিধান ৪৬, ৭৬, ৭৭; বিনাশাইল ও নাইজারশাইল আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি (সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত লাগানো যেতে পারে। তবে ভাদ্র মাসের (১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) মধ্যে রোপন করাই উত্তম। সরকারী-বেসরকারী নার্সারী সমুহে অতিরিক্ত বীজ ও চারার ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে ফসল একবার নষ্ট হয়ে গেলেও দ্রæত আবার চাষ করা সম্ভব হয়।

আমন ধানের জমি বা বীজতলায় চারা নষ্ট হয়ে গেলে দ্রæত বাড়ীর আঙ্গিনা, নার্সারী বা অন্য কোন উঁচু স্থানে চারা উৎপাদন করা যেতে পারে। শুকনো জায়গার অভাব হলে কলার ভেলা তৈরি করে পানিতে ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যেতে পারে। এ জন্য প্রথমে ভেলা তৈরি করে তার উপর পলিথিন বা কলা পাতা বিছিয়ে কাদা ছড়িয়ে দিতে হবে। বৃষ্টির অবস্থা বুঝে কাদার উপর অঙ্কুরিত বীজ ফেলতে হবে, প্রয়োজনে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আগে রোপনকৃত বিশেষত উঁচু জমির সবল গোছার পাশর্^ থেকে সাবধানে কুশি ভেঙ্গে/তুলে চারার অভাব পূরণ করা যেতে পারে। তবে মুল গোছায় কমপক্ষে যেন ৪-৫ টি কুশি থাকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। রোপন করা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত জমি মেরামতের জন্য এ পদ্ধতি সবচেয়ে ভাল। এছাড়া খুব দ্রæত চারার দরকার হলে দাপোগ বীজতলায় ধানের চারা তৈরি করা যেতে পারে। দাপোগ বীজতলা আপৎকালীন বিশেষ ধরনের বীজতলা- বাড়ীর আঙ্গিনা বা সমান কোন জাগায় পলিথিন বিছিয়ে তার উপর অংকুরিত ধানের বীজ ঘন করে (প্রতি বর্গমিটারে ৩ কেজি) ছড়িয়ে দিয়ে ১৪-১৫ দিনের চারা জমিতে রোপন করা যায়। এ বীজতলায় চারার বৃদ্ধির জন্য মাঝে মাঝে প্রয়োজনমত পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।

আগাম সব্জী উৎপাদনের জন্য এ সময় বাড়ীর আঙ্গিনা, রাস্তা বা বাধেঁর ধারে বা অন্য কোন উঁচু স্থানে বীজতলা তৈরি করে সব্জীর চারা উৎপাদন করা যেতে পারে। কলার ভেলায় সব্জির চারা উৎপাদনের জন্য চাটাই, কলাপাতা বা পলিথিনের উপর শুকনা মাটি, গোবর বা জৈব সার একত্রে মিশিয়ে নিতে হবে। এছাড়াও প্লাস্টিক ট্রে, কাঠের বাক্র, টব, পুরাতন বোল/প্লেট/ মাটির হাড়ি, কাটা ড্রাম/টিন/বোতলে মাটি ও জৈব সার মিশিয়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, মরিচ ইত্যাদি সব্জীর চারা উৎপাদন করা যেতে পারে। অতিবৃষ্টি বা রোদ থেকে চারাকে রক্ষা করার জন্য চালা দিয়ে বীজতলা ঢেকে দিতে হবে। এসব পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধু চারা উৎপাদন নয়, সম্পূর্ন ফসলও চাষ করা সম্ভব। যেমন- স্বচ্ছ পলিথিনের চালা দিয়ে ভরা বর্ষা মৌসুমে টমেটো, মরিচ, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, আলু চাষ করা হচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান কচুরিপানার স্তুপ/ধাপে সামান্য মাটি বা জৈব উপাদান যেমন- কাঠের গুড়া, নারিকেল ছোবড়ার গুড়া, ক্ষুদেপানা, টোপাপানা ইত্যাদি দিয়ে ঢেঁড়শ, টমেটো, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, লাউ ও কুমড়া সহ বিভিন্ন সব্জী চাষ করা যেতে পারে।

বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির চুড়ান্ত ও আর্থিক প্রতিবেদন পাওয়া না গেলেও ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। কভিড-১৯ এর অভিঘাত মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সামগ্রিক কৃষিখাতে ৯,৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ঘোষণা করেছেন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী। খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবেলায় বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে কৃষকদের ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণসহ ঋণ ও প্রণোদনার সুবিধা সমুহ যতদ্রæত কৃষকের হাতে পৌঁছবে ততই মঙ্গল।

মোহাম্মদ লোকমান হোসেন মজুমদার, বিসিএস (কৃষি)
কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ এবং পিএইচডি গবেষক

নিউজ টি শেয়ার করে অন্যদের জানার সুযোগ করে দিন...

এ জাতীয় আরো খবর..

© All rights reserved © 2020 krishinews24bd

Site Customized By NewsTech.Com