বরুড়ার কচুর লতি রপ্তানি হচ্ছে ‘২৫’ দেশেবরুড়ার কচুর লতি রপ্তানি হচ্ছে ‘২৫’ দেশে

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কচুর লতি চাহিদা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। কুমিল্লার বরুড়ার কচু আর কচুর লতি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত ২৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে এই ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

চাহিদা বাড়ায় এবং উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে কচু চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের। একবার রোপন করলে বছরের নয় মাস ফলন পাওয়া যায়।

তবে মধ্যস্বত্বভোগী থাকায় কৃষকদের লাভের একটি অংশ চলে যাচ্ছে উল্লেখ করে কৃষকরা সরাসরি রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রির সুযোগ করতে সরকারের সহায়তা চেয়েছেন।

বরুড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদা থাকায় কৃষকরাও কচু চাষে ঝুঁকছেন। কম খরচে বেশি লাভ এবং দীর্ঘদিন ফলন পাওয়ার কারণে কৃষকরা এখন বাণিজ্যিকভাবে কচু আবাদ করছেন। ইতোমধ্যে কচুর উপজেলা হিসেবে ‘বিখ্যাত’ হতে শুরু করেছে বরুড়া। কচু আর লতিকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও। বরুড়ার কচুর সাফল্য দেখে দেশের অন্যান্য জেলা থেকেও এ কচুর চারা সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন কৃষকরা।

গত মৌসুমে বরুড়া থেকে প্রায় এক লাখ কচুর চারা গেছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। স্থানীয় কৃষি বিভাগও কচুর উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে কাজ করছে।

বরুড়া উপজেলা কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় কৃষকরা জানায়, প্রায় সাত বছর আগে ধান উৎপাদনে লাভ কম থাকায় মানুষ কচু চাষে ঝুঁকে পড়েন। প্রথমে অল্প কয়েকটি স্থানে ধানের বদলে কচু চাষ শুরু হয়। এতে কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় এবং কচুর লতির চাহিদা থাকায় কচুর চাষ ব্যাপকহারে শুরু হয়।

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আটিওয়ারায় কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপারীদের সংগ্রহ করা লতির স্তূপকুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আটিওয়ারায় কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপারীদের সংগ্রহ করা লতির স্তূপউপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উপজেলার মোট আড়াইশ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কচু চাষ হচ্ছে। উৎপাদনে জড়িত প্রায় চার হাজার চাষি। প্রতি হেষ্টর জমিতে প্রায় ২৫ টন পর্যন্ত লতি উৎপাদিত হয়। সময় ভেদে এসব লতি টন প্রতি ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন চাষিরা।

এই উপজেলায় ‘লতিরাজ’ ও ‘বারি পানি কচু-৩’ নামের দুই জাতের কচুর চাষ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে লতিরাজ স্থানীয়দের কাছে ‘লতিকচু’ নামে পরিচিত। এই কচু থেকে শুধু লতি সংগ্রহ করা হয়। আর পানি কচু থেকে মোটা সাইজের লতি ও মূলসহ কচু সংগ্রহ করা হয়।

নজরুল ইসলাম জানান, একবার কচু গাছ রোপন করলেই বছরের অন্তত নয় মাস প্রতিটি গাছ থেকে লতি উত্তোলন করা যায়। সাত দিন পরপরই লতি উত্তোলন করতে পারেন কৃষকরা। চলমান রবি মৌসুমে কচুর চারা রোপন করা হয়। অন্য সময়ও রোপন করেন অনেকে।

 

“উপজেলার আগানগর, ভবানীপুর ও খোশবাস দক্ষিণ এই তিনটি ইউনিয়নের প্রায় সবকটি গ্রামেই ব্যাপক কচু চাষ হচ্ছে। উপজেলার বাকি ১২টি ইউনিয়নেও বিচ্ছিন্নভাবে কচুর চাষ হচ্ছে।”

কৃষি বিভাগ ও রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে জানা যায়, বরুড়ায় উৎপাদিত পানি কচু ও লতি বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যায় দুবাই, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল দেশে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের প্রায় সব দেশেও যাচ্ছে লতি ও কচু।

আগে লতি ও কচু প্রবাসীদের মাধ্যমে গেলেও বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে ব্যাপকহারে রপ্তানি হচ্ছে।

চিটাগং ফ্রেশ ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন-এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় বলে বরুড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন।

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আটিওয়ারায় কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপারীদের সংগ্রহ করা লতির স্তূপকুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আটিওয়ারায় কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপারীদের সংগ্রহ করা লতির স্তূপতিনি জানান, রপ্তানিকারকরা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে এসব কিনছেন না। আগে কৃষকরা স্থানীয় কয়েকটি বাজারে সাপ্তাহিক হাটের দিন কচু ও লতি নিয়ে যেতেন। এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে এগুলো কিনে নিয়ে যেতেন।

“তবে এখন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের খুব একটা বাজারে যেতে হয় না। স্থানীয় ক্ষুদ্র পাইকাররা (চাষিদের কাছে ব্যাপারী নামে পরিচিত) প্রতিদিনই কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কচু ও লতি সংগ্রহ করছেন। বাড়িতে নারীরা এসব লতি ও কচু পরিষ্কার করে আঁটি বাঁধেন। এতে অন্তত এক হাজার নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে,” বলেন নজরুল।

সরেজমিনে বরুড়ার আটিওয়ারা গ্রামে দেখা যায়, সালাউল্লাহ, রিয়াদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন ব্যাপারী একটি নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করছেন। একটু পরপরই তাদের লোকজন ভ্যানে করে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা কচু আর লতি এতে স্তূপ করছেন।

সালাউল্লাহ ও রিয়াদ হোসেন জানান, চাষিদের এখন আর বাজারে যেতে হয় না। তারাই তাদের কাছ থেকে সংগ্রহের পর প্রতিদিন বিকালে ট্রাকযোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম পাঠান। সেখান থেকে বাছাই করা লতি ও কচু কিনে বিদেশে পাঠাচ্ছে এজেন্সিগুলো। বাকিগুলো চলে যাচ্ছে বিভিন্ন আড়তে।

সালাউদ্দিন বলেন, “পুরো উপজেলায় আমাদের মতো ব্যাপারী রয়েছেন প্রায় অর্ধশত। বর্তমানে শীতের সময় দাম কিছুটা কম। আমরা এখন গড়ে ১৫ টাকা করে লতি কিনছি।”

চিটাগং ফ্রেশ ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন-এর সহ-সভাপতি এবং চিটাগং ফুডস ও ভেজিটেবলের স্বত্বাধিকারী মো. ইসমাইল চৌধুরী হানিফ বলেন, “আমরা ১৯৯৫ সাল থেকে বরুড়ার পানি কচু ও লতি রপ্তানি করছি। তবে ২০১০ সালের পর থেকে ব্যাপকহারে রপ্তানি হচ্ছে এই সবজি দুটি। বলা চলে প্রতি বছরই বিদেশে এই দুটি সবজির চাহিদা বাড়ছে।

চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যাচ্ছে দুবাই; আর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশ ও ইউরোপসহ বিশ্বের ২৫টির বেশি দেশে, বলেন তিনি।

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আগানগর গ্রামের একটি কচু ক্ষেতকুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আগানগর গ্রামের একটি কচু ক্ষেতইসমাইল চৌধুরী বলেন, “বিদেশিদের পছন্দ সবুজ লতি ও কচু। বরুড়ার এই দুটি পণ্যই বিখ্যাত ও সুস্বাদু। রপ্তানিতে আমাদের একমাত্র সমস্যা হচ্ছে সড়কে চাঁদাবাজি। বরুড়া থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম পণ্য আনতে পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। এতে ক্রেতা পর্যায়ে দাম অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া আর তেমন কোনো সমস্যা নেই। আমরা এখন পাইকারদের মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহ করি। স্থানীয় কৃষি বিভাগ উদ্যোগ নিলে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কিনতে রাজি আছি।”

উপজেলার আগানগর, বারাইপুর, জগদাশার, আটিওয়ারা শরাফতী, বড় হাতুয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই কচু চারর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। তবে চাষিদের থেকে বেশি লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। এজন্য চাষিরা কৃষি বিভাগকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

আগানগর গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া, সামছুল আলম, আবুল বাশারসহ বেশ কয়েকজন বলেন, কৃষি বিভাগ উপজেলার মোট আড়াইশ হেক্টর জমিতে জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কচুর চাষ হচ্ছে – এমন কথা বললেও বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক বেশি হবে। কম খরচে বেশি লাখ লাভ হওয়ায় কৃষকরা কচু চাষে বেশি ঝুঁকছে।

কৃষক বাবুল মিয়া বলেন, “আমি ১৭ শতাংশ জমিতে লতিকচু চাষ করেছি। এতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। বিক্রি করব প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। প্রতি সপ্তাহে একবার লতি তুলে বিক্রি করি ব্যাপারীদের কাছে। গত ৪০ বছর ধরে আমরা লতি চাষ করছি। আগে না করলেও বর্তমানে আমাদের এলাকার বেশিরভাগ কৃষকই এখন লতি চাষ করছেন।”

বারাইপুর গ্রামের কৃষক সামছুল হক বলেন, “আমি ১৫ শতক জমিতে পানি কচু চাষ করেছি। খরচ হয়েছে ২৫ হাজার, বিক্রি করব ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এ কচুর ‘ডোগাসহ’ মূল কচু ও লতি বিক্রি হয়। কৃষি বিভাগ থেকে কেউ আমাদের তেমন খোঁজখবর নেয় না। তাদের পরামর্শ পেলে উৎপাদন আরও ভালো হবে।”

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। বরুড়ার কৃষকদের কাছ থেকে অন্য জেলাগুলোও কচুর চারা নিচ্ছে। গত মৌসুমে গড়ে ৩ টাকা দরে ৯০ হাজার চারা বিক্রি করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণে কমপক্ষে এক হাজার নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।

তিনি জানান, সরকারের ‘কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্পে বরুড়া উপজেলা রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বিষমুক্ত উপায়ে কচুসহ সবজি উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, প্রদর্শনী করা হচ্ছে। এখন কৃষির আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। এর সংখ্যাটা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে রপ্তানিকারকদের আনা হবে। তারা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিললে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবেন।

সুত্রঃ  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *