দেখে মনে হয়, ডালে ডালে ফুটে আছে যেন নরম তুলতুলে দুধসাদা ফুল। আসলে ওগুলো তুলার ফুটন্ত বল। বরেন্দ্রর ঢেউখেলানো জমির তুলাখেতগুলোতে এখন এমন তুলার শুভ্রতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারাই যায় না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল মাত্র শুরু হয়েছে। শীতের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে হাঁটছিলাম বরেন্দ্রর উঁচু–নিচু থাক থাক জমির আলপথ ধরে। গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নের বড় দাদপুর মৌজার দিকে। লক্ষ্য আমাদের প্রায় এক কিলোমিটার দূরের তুলাখেত। একসঙ্গে ১৭ বিঘা। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে আমরা নিচের দিকে নামছি। কোথাও বোরো জমি তৈরির প্রস্তুতি চলছে। কোথাও চষা জমিতে দেওয়া হচ্ছে সেচের পানি। ধান রোপণের আগে জমি সমতল করতে ঘোরানো হচ্ছে মই। মইয়ের ওপর ওজন হিসাবে চাপানো হয়েছে বরেন্দ্রর শক্ত মাটির বড় ঢ্যালা। অনেকটা বোল্ডার পাথরের মতো। দুই প্রান্তে বাঁধা রশির মধ্যখানে ধরে টানছেন এক চাষি। এসব পার হয়ে এক দল মেয়ের ওপর আটকে গেল চোখ, গাছ থেকে তুলা তুলছে ওরা। চা–বাগানে মেয়েদের চা তোলার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পার্থক্য শুধু ওদের পিঠে ঝুড়ি নেই। চা–গাছের উচ্চতার মতো গাছের বিভিন্ন শাখা থেকে শ্বেত-শুভ্র তুলার বলগুলো এক হাতে বোঁটা থেকে টুপ টুপ করে তুলছে, আর অন্য হাতে ধরা বস্তায় পড়ছে।
খেত থেকে তোলা তুলা জড়ো করা হচ্ছে খেতের পাশের খৈলানে (ফসল জড়ো করে রাখার স্থান)। বোঝাই হচ্ছে তুলার বড় বড় বিশেষ বস্তা। মাথায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক কিলোমিটার দূরে রাখা ভটভটির কাছে। খৈলানে তুলাচাষি মোতাহার হোসেনের (৩৭) সঙ্গে কথা হলো। বিদ্যুৎ প্রকৌশলবিদ্যায় তিনি স্নাতক। চাকরি করতেন একটি কোম্পানিতে। গ্রামের মুক্ত পরিবেশে কৃষিকেন্দ্রিক কিছু করতে মন চাইত। করোনা পরিস্থিতি গ্রামে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। গ্রামে এসে প্রথমে মানসম্পন্ন চারা তৈরির নার্সারি তৈরি করেছেন। গ্রামে এসে দেখেছেন তার আত্মীয়স্বজনসহ কয়েক বছর থেকে তুলা চাষ করে ভালোই লাভ করছে। প্রথমবারের মতো তুলা চাষ করেছেন। যত্ন নিয়ে পরিচর্যা করেছেন। অন্য পুরোনো চাষিদের তুলনায় তাঁর ফলন বেশি হয়েছে। অন্যরা যেখানে বিঘায় ১০ মণ ফলন পেয়ে খুশি, সেখানে তাঁর খেতে ফলেছে ১২ মণ করে। গত বছরের তুলনায় এবার তুলার দামও বেশি। গতবার দাম ছিল মণপ্রতি ২ হাজার ৭০০ টাকা। এবার ৩ হাজার ৬০০ টাকা। ভালো লাভের মুখ দেখতে পেয়ে বেশ উজ্জীবিতও বোধ করছেন।
তুলা চাষের ভালো দিকগুলো উল্লেখ করতে গিয়ে মোতাহার হোসেন বলেন, ‘তুলা চাষে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ নেই। এই যে এত বৃষ্টি গেল, অন্য ফসলের ক্ষতি হলেও তুলার কোনো ক্ষতি হয়নি। তুলা বিক্রিতেও কোনো ঝামেলা নেই। ক্রেতার কাছে যেতে হয় না। বরং ক্রেতাই এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ছোট আমবাগানের মধ্যেই সাথি ফসল হিসেবে তুলা চাষ করা যাচ্ছে। এখানে প্রায় এক বছর বয়সী আমবাগানের মধ্যেই তুলা চাষ করেছি। আরও অন্তত চার বছর এ বাগানে তুলা চাষ করতে পারব। তুলা চাষে সেচ লাগে না বললেই চলে। বরেন্দ্র এলাকায় যেখানে পানির স্তর দিনে দিনে নেমে যাচ্ছে, সেখানে পানিসাশ্রয়ী তুলা চাষ আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আর আমবাগানের মধ্যে তুলা চাষ করে যে আয় হচ্ছে, তা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল।’
বড় দাদপুরের সাত বিঘার আরেকটি খেতে গিয়েও দেখা যায় তুলার শুভ্রতা। এ খেতের চাষি মওদুদ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই বিঘা দিয়ে শুরু করেছিলাম। লাভ বাড়তে থাকায় তুলা চাষের জমি বাড়িয়েছি। এবার তুলার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় লাভের পরিমাণ বেশি হয়েছে। আমাদের গ্রামের ১২ জন চাষি তুলা চাষ করেছেন এবার। তাঁদের খেতগুলোতেও এখন তুলার বলে সেজে রয়েছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ তুলা গবেষণাকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের কাছ থেকে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের মধ্যে গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলায় এমন তুলার খেত রয়েছে প্রায় ২০টি। সব কটিই এখন শ্বেতশুভ্র বীজ তুলার বলে সেজে রয়েছে। চার বছর আগে ১০০ বিঘা দিয়ে শুরু হয়েছিল তুলা চাষ। এখন এ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বরেন্দ্র অঞ্চলে ৭০ বিঘা, নাচোল উপজেলায় ৮০ বিঘা, গোমস্তাপুর উপজেলায় ২০০ বিঘা, নওগাঁর পোরশা উপজেলায় ১০০ বিঘা ও সাপাহার উপজেলায় ৫০ বিঘা জমিতে এবার তুলা চাষ হয়েছে। এতে অংশ নিয়েছেন ২১০ জন চাষি। তুলার যে ফলন ও দাম পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সব চাষি ভালোই লাভবান হবে বলে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
রাজশাহী অঞ্চলের তুলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা মোজাদ্দীদ আল শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে তুলা চাষের উপযোগী জমি রয়েছে প্রায় দুই লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ৫০ হাজার হেক্টর জমি তুলা চাষের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশে যে তুলা উৎপাদন হয়, তা মোট চাহিদার (৮০ লাখ বেল) তিন ভাগ মাত্র। সে কারণে দেশে উৎপাদিত তুলা ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশের বরেন্দ্র, পাহাড়, চর ও লবণাক্ত অঞ্চলে তুলা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিদের কাছ থেকে তুলা কেনে বগুড়ার আরমাদা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তুলা চাষের এলাকায় সড়কের পাশে তাদের নানা কেন্দ্র রয়েছে। চাষিদের কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া তুলা ওজন করে আরমাদার ট্রাকে তুলে দেওয়া হয়। গোমস্তাপুরের বড় দাদপুর কেন্দ্রে আরমাদার ব্যবস্থাপক মনির হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে তুলাচাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে কম। এখানকার তুলা মানের দিক দিয়ে ভারতীয় তুলার মতোই। তবে উৎপাদন চাহিদার তুলনায় খুবই কম।’
সুত্রঃ প্রথম আলো