কাপ্তাই হ্রদের চারপাশের সড়ক আর বসতি এলাকাগুলো নিয়ে গড়ে উঠেছে রাঙামাটি শহর। ওই জেলার এক স্থান থেকে অন্যত্র যাতায়াতের প্রধান পথ ওই হ্রদ। ওই জলাভূমি ধরে ৪০ কিলোমিটার এগোলে চোখে পড়বে বিশাল এক পাহাড়ি বন। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের অন্তর্ভুক্ত ওই বনের নাম সীতা পাহাড়। নামে সংরক্ষিত হলেও বনের ভেতর ফলবাগান, জনবসতি, হোটেল–মোটেলের দেখাও পাওয়া যাবে। বনভূমিটি আছে শুধু কাগজে–কলমে।
কাপ্তাই রেঞ্জের ব্যাঙছড়ি থেকে শুরু করে বালুচর এলাকা, এমনকি বন বিভাগের কাপ্তাই রেঞ্জের সংরক্ষিত বনের প্রধান ফটক থেকেই বনভূমি উজাড় আর দখল শুরু হতে দেখা যাবে। বিরান হওয়া ওই বনের পাশে স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আওতায় থাকা জোতের জমিগুলোর চিত্র অবশ্য ভিন্ন। সেখানে সারি সারি সেগুন বাগান আর আম, কাঁঠাল, লিচুসহ নানা ফলবাগান চোখে পড়বে। ওই বাগানগুলোকে অবশ্য আর বন বলা যায় না। বন থেকে সেগুন কাঠ, আনারস, কাঁঠালসহ নানা ধরনের ফলমূল নৌকায় তুলতে দেখা গেল। এগুলো যাচ্ছে ঢাকা–চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান শহরগুলোর বাজারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বন রক্ষা করে জীবিকা অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। নয়তো বন রক্ষা পাবে না, এখন যে ফলমূল উৎপাদন বাড়ছে, তা–ও টেকসই হবে না।
রাকিবুল হাসান, নির্বাহী পরিচালক, আরণ্যক ফাউন্ডেশন
সীতা পাহাড়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস করা হ্লি চিং মারমা জানান, বনের ভেতরের এসব বাগানের মালিকানা তাঁদের হাতে নেই। শহর ও অন্যান্য অঞ্চলের বড় ব্যবসায়ীরা ইজারা নিয়ে এসব বাগান গড়ে তুলেছেন। একসময় এখানে মূলত রবারবাগান বেশি ছিল। এখন এখানকার বেশির ভাগ ভূমি কাঠ আর ফলবাগানে ভরে উঠেছে। স্থানীয় মানুষ নিজেদের জমি হারিয়ে এসব বাগানের শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। সরে আসছে জুমচাষ থেকে।
সরকারের বন বিভাগ থেকে শুরু করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বেশির ভাগ প্রতিবেদনে দেশের পার্বত্য তিন জেলায় বনভূমি ধ্বংসের চিত্র উঠে এসেছে। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের (ডব্লিউআরআই) হিসাব অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাকৃতিক বন উজাড় হয়েছে। আর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এ হার ৯ শতাংশের বেশি। দেশের মোট বনভূমির ৪০ শতাংশ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে। অন্যদিকে একই সময়ে সারা দেশে যে পরিমাণে বৃক্ষ বেড়েছে, তার ৭৮ শতাংশ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে। সংস্থা দুটি বলছে, ওই নতুন বৃক্ষের বেশির ভাগই প্রাকৃতিক বন কেটে ও কৃষিজমিতে রোপণ করা ফলবাগান ও কাঠবাগান।
এ ব্যাপারে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মোট বনভূমি ও জীববৈচিত্র্যের বড় অংশ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। হাতি, চিতাসহ দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী সেখানে এখনো বাস করে। কিন্তু প্রাকৃতিক বন কমে সেখানে বাগান বাড়লে তা সামগ্রিকভাবে দেশের জীববৈচিত্র্যকে বড় ধরনের হুমকিতে ফেলবে।
দেশের সবচেয়ে বেশি বন ধ্বংস তিন জেলায়
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সংস্থা ইউএনএফসিসিসির কাছে বনভূমি কতটা ধ্বংস হয়েছে, সে ব্যাপারে একটি সমীক্ষা জমা দেয় বাংলাদেশ সরকার। ২০২১ সালে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে দেশের তিন পার্বত্য জেলার বনভূমি কমার বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, অবৈধভাবে গাছ কাটা ও পাচার এবং জুম চাষ এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে ফলবাগান, তামাক ও আদা–হলুদ চাষ দ্রুত বাড়ছে। তামাক পোড়ানোর জন্য পার্বত্য অঞ্চলের বন থেকে দেদার কাটা হয় গাছ।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে যে পরিমাণে বনভূমি উজাড় হয়েছে, তার ৯০ শতাংশ হয়েছে তিন পার্বত্য জেলায়। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৪৪৮ টন কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নিঃসরণ হওয়া মোট কার্বনের ৩১ শতাংশ হচ্ছে বন উজাড়ের কারণে।
বন বিভাগের ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ৫ হাজার দখলদারের হাতে ১৬ হাজার ৬৪৪ হেক্টর বনভূমি দখল হয়ে আছে।
শহরজুড়ে করাতকল ও আসবাবের কারখানা রাঙামাটি আসবাবপত্র প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, কেবল ওই শহরে ১ হাজার ২০০টি আসবাব এবং কাঠ দিয়ে তৈরি নানা সরঞ্জাম তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। বাড়িঘরের দরজা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই এখন ওই শহরে তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। আর তাতে বড় অংশের কাঠের জোগান আসছে বন থেকে।
রাঙামাটি শহরের বনরূপা থেকে শুরু করে কাপ্তাই লেকের ঘাটসহ যেখানে যাওয়া যাবে, ওই করাতকল আর আসবাব তৈরির কারখানা চোখে পড়বে। কাপ্তাই হ্রদ দিয়ে এসব ঘাটে হাজার হাজার গাছ নামছে। হ্রদের পাশে সেখানে চেরাই করে আসবাব তৈরির কারখানায় পাঠাতে দেখা গেল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তিন পার্বত্য জেলার প্রধান কার্যালয়টি রাঙামাটিতে অবস্থিত। সেখানে থাকা তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির ফল চাষের হিসাব কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। সেই তথ্য অনুযায়ী গত ১২ বছরে সেখানে ফলের আবাদ প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে। ২০২০–২১ অর্থবছরে সেখানে প্রায় আট হাজার একর জমিতে ফলের চাষ হচ্ছে। এর বাইরে ধান, ভুট্টা, সবজি, মাশরুমসহ নানা ধরনের ফসলের চাষ বাড়ছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রাকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বন রক্ষা করে জীবিকা অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। নয়তো বন রক্ষা পাবে না, এখন যে ফলমূল উৎপাদন বাড়ছে, তা–ও টেকসই হবে না।
সুত্রঃ প্রথম আলো