নিউজ ডেস্কঃ
বাজারে বিলুপ্তপ্রায় মাছের সমারোহ বেড়েছে। হাওর, নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর ও জলাশয় থেকে নানা পদ্ধতিতে ধরা এসব মাছ এখন বাজার ভরা। চাইলেই এখন রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে বিলুপ্ত প্রায় দেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। দামেও অনেকটা সাশ্রয়ী। বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে খাল-বিল-নদীতে এই মাছগুলো এখন পাওয়া যাচ্ছে। একসময় এগুলো পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠলেও এখন সেই দুঃসময়টা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। রাজধানীর বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে দেশি প্রজাতির শোল বোয়াল, শিং, মাগুর, কৈ, টাকি, আইড়, পুঁটি, ট্যাংরা, মেনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারগুলোয় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে আবার দেশের নদী. খাল বিলে পুকুরে দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এসব মাছই বাজারে আসছে। শুধু বাজারই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ফেরি করেও বিক্রি হচ্ছে দেশি প্রজাতির এসব মাছ।
ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশে বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতির ওপর গবেষণা করে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এসব প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে ব্যবহার করে এবং নদ-নদী ও বিলে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ানোসহ জীববৈচিত্র্য ফেরত আনা হচ্ছে। এর ফলে এখন এ মাছগুলো অনেক পাওয়া যাচ্ছে এবং এর দামও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে। ওই মাছগুলো হলো – পাবদা, গুলশা, টেংরা, শিং, মাগুর, গুঁজি আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, রাজপুঁটি, মেনি, বালাচাটা, গুতুম, ভাগনা, খলিশা, বাটা, দেশি সরপুঁটি, কালিবাউশ, কই, গজার গনিয়া, বোয়াল, মাগুর, শোল, টাকি ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশের জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। এ খাতের একটি বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ। মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
জানতে চাইলে রাজধানীর কোনাপাড়া বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন জানিয়েছেন, গত দুই মাস ধরেই বাজারে দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছ পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতারাও আগ্রহভরে এসব মাছ কিনছেন। সারাবছর পাওয়া যায়না বলে অনেকেই তা বেশি করে কিনে তা ফ্রিজে সংরক্ষণও করছেন। তিনি জানান, পৌষ মাস শেষ হওয়া মাত্র এসব মাছের সরবরাহ থাকবে না। পুকুর জলাশয় নদী নালা অনেকটাই শুকিয়ে যাবে। আর সেখানকার মাছ ধরা শেষ হয়ে যাবে।
জানা গেছে, এক সময় বাংলাদেশের গ্রামের হাট-বাজার ছিল দেশি মাছের রমরমা সরবরাহ। এখন সেখানে পাওয়া যাচ্ছে চাষের রুই-কাতলা, পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে মিঠা পানির ২৬০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪টি বিলুপ্তপ্রায়। বিগত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, অপরিমিত পানি ব্যবহার, কৃষিকাজে কীটনাশকের যথেচ্ছা ব্যবহার, পানিদূষণ এবং অতি আহরণের ফলে বা পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ অনেক কমেছে। অথচ প্রাকৃতিক জলাশয়ের অনেক ছোট প্রজাতির মাছ যেমন মলা, ঢেলা, পুঁটি, কাচকি, বাইন, চান্দা ইত্যাদি আবহমানকাল থেকে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের পুষ্টির জোগান দিয়ে আসছিল।
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ। দেশে মাছ উৎপাদনে ছোট মাছের অবদান ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনে বর্তমানে চার শতাধিক খামার কাজ করছে। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে বছরে ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর ও কই ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। ইদানীং বাটা মাছের চাষও বেড়েছে।
এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, দেশে মাছের চাহিদা পূরণ করতে দেশি মাছ এবং জলজ প্রাণি রক্ষা করতে সরকার ২০২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যেই প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতি মাছের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই এই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ ও মধ্যপশ্চিম অঞ্চলের খাল বিল, প্লাবনভূমি, নদী ও বাঁওড় সমৃদ্ধ অঞ্চল যেখানে অধিকাংশ জলাশয় বছরের চার থেকে আট মাস পর্যন্ত এবং কিছু জলাশয়ে সারা বছর পানি থাকে। এসব এলাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার ও মাছের উৎপাদন বাড়ানোর উপযোগী পরিবেশ থাকায় এক সময় দেশি কৈ, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, রয়না, সরপুঁটি এবং টেংরা ও বাইনসহ আরও অনেক ধরনের মাছে ভরপুর ছিল। কিন্তু খাল বিল, নদী নালা ভরাট, বেশি হারে মাছ ও শামুক ধরা, কীটনাশক ব্যবহার, অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশীয় মাছ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে বাড়ছে।
এ সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান হানিয়েছেন, একনেকের অনুমোদন পাওয়া ‘দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মাছের উৎপাদন ৪ লাখ ৪৬ হাজার টনে উন্নীত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। বর্তমানে দেশীয় মাছের উৎপাদন হচ্ছে ৩ লাখ ৮৩ হাজার টন।
এদিকে ময়মনসিংহ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সূত্র জানিয়েছে, একসময় এই ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি গবেষণাকেন্দ্র থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা হতো। বর্তমানে ময়মনসিংহ ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা পরিচালনা হচ্ছে। ইনস্টিটিউট থেকে বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা, শোল বাইন, কাকিলা ও ভোল এবং উপকূলীয় কাওন মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিহির কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, সরকারের নজরদারি, মনিটরিং ও হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলো উদ্ধারের জন্য নানামুখী কার্যক্রমের ফলেই দেশে এই মৌসুমে এসব মাছ পাওয়া যাচ্ছে। একইসঙ্গে এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের অবদানও কম নয়। তাদের গবেষণার ফলে এসব মাছ আবার বাজারে উঠছে এবং তা মানুষের ঘরে আসছে। সরকারকে এ উদ্যোগ ধরে রাখতে হবে। আর সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে, যাতে এসব প্রজাতির মাছ হারিয়ে না যায়। নানা ধরনের জাল ব্যবহার করে এসব মাছের বংশ যেন নির্মূল না করি।
সুত্রঃবাংলা ট্রিবিউন