কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম,
মাঠে সোনালি পাকা ধান, মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠেছে চারদিক, কৃষকের চোখে মুখে আনন্দের শিহরণ কিন্ত হঠাৎ ঈষাণ কোণে কালো মেঘ, নিমিষেই হাসিমাখা মুখ অজানা শংকায় মলীন হয়ে যাবে। আবহাওয়ার এই লুকোচুরি খেলায় হাজারো কৃষকের স্বপ্ন প্রতিনিয়ত ভেংগে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ঘাম ঝরানো ফসল ঘরে তুলতে না পারায় বাড়ছে দেনার বোঝা; কর্জ করে কিনা সার,বীজ,বালাইনশাকের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় মহাজনদের কাছে অপমানিত হওয়া, চক্ষুলজ্জার ভয়ে লুকিয়ে থাকা। ভেংগে যায় মেয়েকে লালটুকটুকে শাড়ি পড়িয়ে শশুর বাড়ি পাঠানোর স্বপ্ন, ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে লাটাই কিনে রংগিন আকাশে পেখম মেলার আহ্লাদ কিংবা অসুস্থ মায়ের দু ফোটা ওষুধ কেনার অভিলাষ।
আবহাওয়া পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এভাবেই কৃষি ও কৃষকের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবহাওয়া, কৃষি, কৃষক যেন এক ত্রিমাত্রিক সেতুবন্ধন। এই তিনের সমন্বয়ে কৃষি হয়ে উঠতে পারে সমৃদ্ধ, কৃষকের ফিরে আসতে পারে প্রাণোচ্ছলতা।
সদা পরিবর্তনশীল এই আবহাওয়ার পূর্বাভাস, যদি কৃষকদের কাছে অতি সহজে সময়মত পৌঁছানো যায়, তাহলে বাংলার কৃষকের গোলা আবার ধানে ভরে উঠবে, বসবে ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের পসরা।
কৃষকের এই সুখানুভূতি দেখার জন্যই বাংলাদেশের সম্প্রসারণ বিভাগে নিয়োজিত কৃষি বিশেষজ্ঞগণ স্মার্ট কৃষি প্রবর্তনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আর সেই স্মার্ট কৃষির নব ডাইমেনশন হচ্ছে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদানের মাধ্যম বামিস পোর্টাল (BAMIS)।
বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত দেশ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, ল্যাইলা কনার্স পিটারসন, চাক ক্যাসেলবেরি এবং ব্রায়ান গার্বারের তৈরি করা ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের পরিবেশভিত্তিক তথ্যচিত্র্র (Documentary film) “দ্যা ইলেভেন্থ আওয়ার”-এ (The 11th Hour) দেখানো হয় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিজনিত কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৬৩০লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুর্যোগপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও আবহাওয়া ও জলবায়ু, নদ-নদীর পানির অবস্থা, আগাম সতর্কীকরণ সম্পর্কিত তথ্যাদি কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। এ বিষয়ে কারিগরি দিক থেকে উন্নত মানের এবং নির্ভরযোগ্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। টেকসই কৃষি উৎপাদনের জন্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের কাছে তাঁদের উপযোগী ভাষায় সরবরাহ করা একান্ত প্রয়োজন। উক্ত তথ্যাদি কৃষি উৎপাদনে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের কাছে কৃষকের ভাষায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়েছে নানা পদক্ষেপ। এরকমই একটা পদক্ষেপ “বামিস পোর্টাল” ওয়েব সাইট। কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প (Agro-Meteorological Information Systems Development Project)” এর আওতায় এই ওয়েব পোর্টার তৈরি করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক ঝাঁক মেধাবী কৃষি সম্প্রসারণবিদ। আবহাওয়াবিদ ও কৃষিবিদদের সমন্বয়ে কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পূর্বাভাস প্রদান করে করা হয় এই ওয়েব পোর্টাল থেকে। প্রান্তিক পর্যায়ে পূর্বাভাস প্রদান করার জন্য ইউনিয়ন ভিত্তিক স্থাপন করা হয়েছে ৪০৫১ টি কৃষি আবহাওয়া ডিসপ্লে বোর্ড ও অটোমেটেইক রেইনগজ মিটার, ৪৮৭ টি উপজেলায় কিওস্ক মেসিন, ৩০০০০ কৃষক প্রতিনিধির কাছে এডভাইজরি পূর্বাভাস। ইতোমধ্যেই বামিস পোর্টাল থেকে তথ্য নিয়ে বিভিন্ন উপজেলা কৃষি অফিসের অফিসিয়াল ফেইসবুক আইডিও ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ থেকে দেওয়া হচ্ছে সপ্তাহভিতিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস যা কৃষক ও সচেতনমহলে ব্যাপক সাড়া পরেছে। ব্লক পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ব্যাপারে বিশ্বাসযোগতা বেড়েছে বহুগুণ।
আসুন জেনে নিই বামিস পোর্টাল সম্পর্কে। যে কেউ গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে BAMIS লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন এ্যাপস। ইন্সটল করে পেয়ে যাবেন কাংখিত আবহাওয়ার পূর্বাভাস।
বাংলাদেশ কৃষি আবহাওয়া তথ্য পোর্টাল (BAMIS) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প (কম্পোনেন্ট সি: বিডব্লিউসিএসআরপি) এর আওতায় তৈরি একটি ডায়নামিক ওয়েব পোর্টাল – যেখানে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত নদ নদীর তথ্য উপাত্ত সন্নিবেশিত হয়। তথ্য উপাত্ত সমূহ একটি কারিগরি কমিটির মাধ্যমে যাচাই বাছাই এবং অনুবাদ করে কৃষকের কাছে তাঁদের উপযোগী করে সরবরাহ করা হয়। এই পোর্টাল অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। এ ছাড়াও এর মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের কর্মকর্তা থেকে কৃষক পর্যায় পর্যন্ত সংযোগ রক্ষা করা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি আবহাওয়া তথ্য পোর্টালের আওতায় আরও রয়েছে:
১) সারা বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর তথ্য।
২) হালনাগাদকৃত কৃষি আবহাওয়া বুলেটিন যা সপ্তাহে দুই দিন ৬৪ জেলার জন্য এবং সপ্তাহে একদিন জাতীয় পর্যায়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
৩) কৃষি আবহাওয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য যেমন- ফসলের আবহাওয়া সংবেদনশীলতা, আবহাওয়ার সাথে রোগ-পোকামাকড় আক্রমণের সম্পর্ক ও নিয়ন্ত্রণের উপায়, ফসল আবহাওয়া পঞ্জিকা প্রভৃতি।
৪) কৃষি আবহাওয়ার তথ্য সেই সাথে ভূ-উপগ্রহ হতে প্রাপ্ত তথ্য, যা বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবহারকারীদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
৫) কৃষি আবহাওয়া এবং নদ নদীর তথ্য উপাত্ত, পূর্বাভাসসহ কৃষকদের সমস্যাসমূহের সম্ভাব্য সমাধান কৃষকের কাছে তাঁদের উপযোগী করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কৃষি তথ্য সার্ভিস এর বিভিন্ন সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়মিত সরবরাহ করা।
৬)চরম আবহাওয়ার তথ্য।
৭) গবাদি পশু, হাঁসমুরগী ও মাছের জন্য বিশেষ কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ
৮) এসএমএস এর মাধ্যমে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস পাবার সহজলভ্যতা
৯) রয়েছে কৃষকদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ সহ নানাবিধ বিষয়।
কোনো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই পড়ছে কিনা, তা চারটি মানদন্ডে বিবেচনা করা হয়:
১. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ
২. কোথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে
৩. সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কোথায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে
৪. ক্ষতিগ্রস্থ দেশটি ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য এরই মধ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে। ( সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)
এই মানদন্ড বিচারে বাংলাদেশের কৃষি রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা,ঝড়,বজ্রপাত,ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি সবগুলো প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের কৃষির সম্ভাবনাকে করছে বাধাগ্রস্ত, ভেংগে দিচ্ছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। সেই জন্য ৪ নং মানদন্ডের জন্য অভিযোজন কৌশলের অংশ হিসেবে প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই বামিস পোর্টাল চালু করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যা স্মার্ট কৃষি প্রবর্তনের নতুন এক মাইলফলক।
লেখক:
কামরুল ইসলাম,
৩৫ তম বিসিএস কৃষি
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার,
পুঠিয়া, রাজশাহী