নিউজ ডেস্কঃ
দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার কলারদোয়ানিয়া, দেউলবাড়ী-দোবড়া ও মালিখালী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা বছরের বেশিরভাগ সময় থাকে পানির নিচে। তাই বলে কী চাষবাস থেমে থাকবে? জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে এসব এলাকায় ভাসমান পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন খুবই জনপ্রিয়।
পানিতে ডোবা জমিতে ভাসমান এ চাষ পদ্ধতি স্থানীয়দের কাছে ধাপ চাষ নামে পারিচিত।
বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের অনেকেই ধাপচাষে এগিয়ে আসছেন।
ধাপ চাষের ব্যাপ্তি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে নাজিরপুরের বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন মুগারঝোর গ্রামে।
এছাড়া পাশের উত্তর কলারদোয়ানিয়া, বেলুয়া, চিথলিয়া, গাওখালী, মনোহরপুর, পদ্মডুবি, বিলডুমুরিয়া, গজালিয়া চিলতি, গাওখালী, সাচিয়া, মেদা, পেনাখালী, যুগিয়া গ্রামেও এখন ব্যাপক হারে ধাপ পদ্ধতিতে চাষাবাদ হচ্ছে।
বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী সময়ে এসব ধাপে তৈরি হয় প্রধানত নানা রকম সবজির চারা। স্থানীয় কৃষক জামাল হোসেন জানান, আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত পাঁচ মাস তারা ভাসমান ধাপের ওপর প্রায় বিশ প্রকারের সবজির চারা উৎপাদন করেন।
এ পদ্ধতিতে কচুরিপানা, শ্যাওলা, টেপাপানা, দুলালীলতার মত জলজ উদ্ভিদ ও লতা-গুল্মের সঙ্গে নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়ো মিসিয়ে সেগুলো কয়েকটি স্তরে সাজিয়ে ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। পানিতে লতাগুল্ম পচে তৈরি হয় জৈব সার।
ধাপ তৈরিতে ব্যবহৃত এসব জলজ উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম বিক্রি হয় স্থানীয় বৈঠাকাটা ভাসমান বাজারে। এক নৌকা শ্যাওলা কিংবা কচুরিপনা কিনতে খরচ হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা।
সাধারণত ১০০ ফুট দীর্ঘ, ৫-৬ ফুট চওড়া এবং এক থেকে দেড় ফুট পুরু হয় একেকটি ধাপ।
কৃষকরা জানান, একটি ধাপ তৈরিতে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা লাগে। প্রতিটি ধাপে মৌসুমে কমপক্ষে ৫ বার চারা উৎপাদন করা যায়। একটি ধাপ থেকে সর্বোচ্চ ত্রিশ হাজার টাকার সবজির চারা বিক্রি করা যায়।
বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি হওয়ায় দিনে দুবার জোয়ারের সময় এসব জমির পানি ১০-১২ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। জোয়ার-ভাটার তালে তালে এসব ধাপ ভেসে থাকে।
ধাপ পদ্ধতির চাষাবাদে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীরাও অংশ নেন সমানতালে।
জলাভূমিতে ধাপ তৈরি, চারা রোপণ, পরিচর্যা আর চারা বিক্রির কাজ সামলান পরিবারের পুরুষ সদস্যরা।
আর নারীরা বাড়িতে বসে করেন বীজ থেকে চারা তৈরির কাজটি। বীজ থেকে সদ্য গজানো চারাকে পরিপূর্ণ চারায় পরিণত করতে সেগুলোকে বসানো হয় জলজ লতাপাতা দিয়ে তৈরি একটি গোলকের মধ্যে, স্থানীয় কৃষকরা একে বলেন ‘টেমা’ বা ‘দৌল্লা’।
টেমা বা দৌল্লা তৈরি হয়ে গেলে বাড়ির আঙিনায় কয়েকদিন রেখে বীজ থেকে ভালভাবে চারা গজানোর জন্য অপেক্ষা করা হয়। চারা পুরোপুরি বীজ থেকে বেরিয়ে এলে সেগুলো স্থাপন করা হয় ধাপের উপর।
ধাপের ওপর চারাগুলো পরিপূর্ণ হয়ে উঠলে কৃষকরা তা বিক্রি করে দেন। স্থানীয় কৃষক সেকেন্দার ব্যাপারি জানান, বীজ বপন থেকে চারা পরিপূর্ণ হতে সময় লাগে প্রায় এক মাস।
ধাপের উপর উৎপাদিত এসব সবজির চারার বিকিকিনি হয় পার্শ্ববর্তী বৈঠাকাটা, হারতা এবং মনোহরপুরের ভাসমান বাজারে।
অনেক পাইকার চারা কিনতে নৌকা নিয়ে সরাসরি ক্ষেতেও চলে যান।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, ফড়িয়াদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে বীজ কেনাসহ নানা রকম সমস্যায় তাদের পড়তে হয় নিয়মিত। তাই বৈঠাকাটা বাজারে বাংলাদের কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের একটি বীজ বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপনের দাবি তাদের দীর্ঘদিনের।
কার্তিকের পর জোয়ারের পানি খুব একটা বাড়ে না। সে সময়ে কৃষকরা এসব জমিতে শুরু করেন নানা রকম সবজির আবাদ। তবে সে পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন।
ভাসমান এই সবজি চাষ পদ্ধতি ২০১৫ সালে ‘বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ঐতিহ্য’ হিসেবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) স্বীকৃতি পায়।
সূত্রঃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম